মানুষের জন্য কাজ করতে হবে, ব্র্যাক শুরু করার সময় এই ছিলো একমাত্র চিন্তা
সত্তরের নির্বাচনের আগে ১১ নভেম্বরের রাতে দেশে খুব বড় একটি ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাস হয়েছিলো। চট্টগ্রাম এবং নোয়াখালীর উপকূলীয় দ্বীপগুলোতে সেদিন রাতে নেমে এসেছিলো ভয়াবহ বিপর্যয়। সন্দীপ, হাতিয়া, মনপুরা এই তিনটি দ্বীপে মৃত্যুবরণ করেছিলো অসংখ্য মানুষ। দ্বীপগুলো একেবারে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিলো। মৃত্যু হয়েছিলো প্রায় তিন লাখ মানুষের। মনপুরা দ্বীপে ছাপ্পান্ন হাজার মানুষ বসবাস করতো। বেঁচে ছিলো মাত্র তের হাজার। বাকি সবাই মারা গিয়েছিলো। ঘূর্ণি-উপদ্রুত দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোটা তখন ছিলো খুব জরুরি। এতোবড় মানবিক বিপর্যয় আমাদেরকে জাতীয়ভাবে নাড়া দিয়েছিলো। স্বাভাবিকভাবেই এই অঞ্চলে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মসূচি নিয়ে আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম।
মনপুরা দ্বীপে বেঁচে থাকা তের হাজার মানুষের কোনো সহায়সম্বল ছিলো না। তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়াটা ছিলো অত্যন্ত জরুরি। আমরা ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত এলাকায় কাজ করতে গেলাম। শেলে চাকরি করলেও আমরা কিন্তু শেলের পক্ষ থেকে যাইনি। আমরা কয়েকজন মিলে ‘হেলপ’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করেছিলাম। এটা ঘূর্ণিঝড়ের তিন-চারদিন পরের ঘটনা। ঘূর্ণিদূর্গতদের পাশে দাঁড়ানোর জন্যই প্রতিষ্ঠানটি তৈরি করতে হলো। আমি একা নই। সঙ্গে আরও তিন-চারজন ছিলেন। ব্যারিস্টার ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী, শেলে আমার সহকর্মী বর্তমান আমেরিকা প্রবাসী কায়সার জামানও ছিলেন। ‘হেলপ’-এর মাধ্যমে আমরা মনপুরাতে কাজ শুরু করি।
২.
কায়সার জামানকে শেলের চাকরি ছেড়ে দিতে বললাম। সে চাকরি ছেড়ে পুরোপুরিভাবে ‘হেলপ’-এ এসে যোগ দিলো। আমি তখনও শেলে। ‘হেলপ’-এর অনুদান জোগাড়ের কাজ করছি। ফাদার টিম তখন ঢাকার নটরডেম কলেজে পড়াতেন। কলেজের গভর্নিং বডির কাছে চিঠি লিখে বললাম, ফাদার টিমকে আমরা ছয়মাসের জন্য ‘হেলপ’-এ নিতে চাই। ফাদার টিম চলে এলেন। মনপুরাতে গিয়ে মাঠ সমন্বয়কারী হিসেবে তিনি কাজ শুরু করলেন।
৩.
মে মাসের প্রথম দিকে সিদ্ধান্ত নিলাম ইংল্যান্ডে চলে যাবো। আগে থেকেই সেখানে আমার জানাশোনা ছিলো। আমি ভাবলাম, ইংল্যান্ড গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য একটা সংগঠন তৈরি করবো। তখন ঢাকা থেকে করাচি যেতে হলে একটা ছাড়পত্র নিতে হতো। বাঘমার্কা পরিচয়পত্র থাকায় করাচি যেতে কোনো সমস্যা হলো না। করাচি বিমানবন্দরে নামার পর আমরা যারা বাঙালি ছিলাম, তাদের আলাদা করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হলো। বাঘমার্কা পরিচয়পত্রের সুবাদে আমি সহজেই ছাড়া পেলাম।
বিমানবন্দর থেকে বেরোনোর সময় ‘শেল’ কোম্পানির একজনের সঙ্গে দেখা হলো। তিনি করাচিতে এসেছেন ছুটি কাটাতে। আমি কেনো এসেছি জানতে চাইলেন।
বললাম, আমিও ছুটি কাটাতে এসেছি। কয়েকদিন থেকে আবার চলে যাবো।
করাচিতে কয়েকদিন থেকে ইসলামাবাদ চলে গেলাম। ইসলামাবাদ গিয়ে উঠলাম আমার বন্ধু আসাফউদ্দৌলাহর বাসায়। আসাফউদ্দৌলাহ তখন পাকিস্তান সরকারের উপসচিব। পরদিন ইসলামাবাদে ‘শেল’ কোম্পানির এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। ভাবলাম, আছি কয়েকদিন, একটু দেখা করে আসি। তার ওখানে গিয়ে কথাবার্তা বলছি। কিছুক্ষণ পর দেখি, ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই)-এর কিছু লোক এলো।
তারা এসে বললো, আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে।
পরে জানলাম, বিমানবন্দরে যে সহকর্মীর সঙ্গে দেখা হয়েছিলো, তিনিই আমাদের কোম্পানির চেয়ারম্যানকে আমার কথা বলে দিয়েছেন। চেয়ারম্যান চিঠি লিখেছেন ‘আইএসআই’-কে, আমাকে খুঁজে বের করার জন্য। অভিযোগ, আমি ঢাকায় কাউকে কিছু না বলে পালিয়ে চলে এসেছি। চেয়ারম্যান পাঞ্জাবের গভর্নরকেও লিখেছিলেন যে, আমাদের একজন অফিসার পালিয়েছে। তাকে ধরার চেষ্টা করুন।
আইএসআই-এর অফিসার আমাকে তাদের এক কর্নেলের কাছে নিয়ে গেলো। অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো। আসাফউদ্দৌলাহর বাসা থেকে আমার সব মালপত্র আনানো হলো। তন্নতন্ন করে তল্লাশি করা হলো।
অভিযোগ করার মতো কিছুই পেলো না।
বারবার তারা জানতে চাইলো কেনো আমি চলে এসেছি। তিন-চারমাস আগে আমার একটা প্রমোশন হয়েছিলো। সেই কাগজটা সঙ্গে ছিলো। সেখানে আমার বেতনের অঙ্ক উল্লেখ ছিলো। চার হাজার একশ টাকা। তখনকার হিসাবে অনেক টাকা। আইএসআই-এর কর্মকর্তা বিশ্বাস করতে পারছিলো না, আমি অতো মোটা টাকা বেতনের চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছি।
তারা বললো, এতো টাকা বেতনের চাকরি ছেড়ে কেনো চলে এলে? তুমি তো ভেরি এলিজিবেল ব্যাচেলর। বিয়ে করনি কেনো?
৪.
দুদিন পর আমাকে ছেড়ে দিলো। ‘শেল’ কোম্পানির যে বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, সে আমাকে আসাফউদ্দৌলাহর বাড়িতে পৌঁছে দিলো। তারপর বললো, তুমি যদি সত্যি সত্যি দেশের বাইরে যেতে চাও, তাহলে এক্ষুনি একটা ট্যাক্সি করে খাইবার গিরিপথ দিয়ে আফগানিস্তানে চলে যাও।
আমার উদ্দেশ্যও ছিলো তাই। আফগানিস্তান হয়ে ইংল্যান্ডে যাবো বলেই আমি ইসলামাবাদ গিয়েছিলাম।
তখন প্রায় সকলেই যাচ্ছিলেন ভারতে। ভারতে গেলে অনেক সহজে যেতে পারতাম। কিন্তু আমি ভারতে যেতে চাইনি। কারণ আমি জানতাম ভারতে গিয়ে আমার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। ইংল্যান্ডে গেলে আমার পক্ষে অনেক কিছু করা সম্ভব। লন্ডন আমার পরিচিত জায়গা। সেখানে লেখাপড়া করেছি। দেশি-বিদেশি অনেক বন্ধুও আছেন সেখানে। আমি তো শুধু দেশ থেকে পালাতে চাইছিলাম না। আমি মনে করেছিলাম টাকাপয়সা সংগ্রহ বা জনমত গঠন যা-ই হোক না কেনো, ভারতের তুলনায় ইংল্যান্ডে গেলে ভালো করতে পারবো।
৫.
পাকিস্তান থেকে আফগানিস্তান পাড়ি দেওয়াটা সহজ ছিলো না। শেষে সেই কঠিন পথটাই বেছে নিলাম। পরদিন সকালে ইসলামাবাদ থেকে ট্যাক্সিতে করে পেশোয়ারে পৌঁছলাম। সময় লাগল চার-পাঁচ ঘণ্টা। পেশোয়ারে গিয়ে একটা হোটেলে উঠলাম। হোটেলের নামটা মনে নেই। ওটা ছিলো পেশোয়ারের সবচাইতে ভালো হোটেল। আমার সঙ্গে দু-তিন হাজার টাকার বেশি ছিলো না। তবু চিন্তাভাবনা করে বড় হোটেলে উঠেছিলাম। কেননা ছোট হোটেলে হয়তো কেউ প্রশ্ন করার সুযোগ পেয়ে যেতে পারে।
পরদিন সকাল বেলা খাইবার পাসের বাসে চড়লাম। পাসপোর্ট দেখিয়ে চেকপোস্ট পার হয়ে আফগানিস্তান ঢুকলাম। সেখান থেকে আরেকটা বাসে চড়ে গেলাম জালালাবাদ। অতঃপর অন্য একটা বাস ধরে কাবুল। পেশোয়ার থেকে রওনা হয়েছিলাম সকাল বেলা। কাবুল পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো।
এটা মে মাসের কথা। কাবুলে পৌঁছে ‘হোটেল কাবুল’-এ উঠলাম। ওখান থেকেই টেলিগ্রাম করে লন্ডন থেকে সেখানে যাওয়ার টিকিট আনালাম। কাবুল থেকে ইস্তানবুল। ইস্তানবুল থেকে লন্ডন। লন্ডনে পৌঁছে দেখি, আমাদের বন্ধুরা ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠন তৈরির চেষ্টা করছেন।
৬.
তখন জুন মাস। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডনে পৌঁছেছেন। তিনি লন্ডনের প্রবাসী বাঙালিদের উদ্বুদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধের জন্য তহবিল সংগ্রহ করছিলেন। পরে তিনি মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি মনোনীত হন। এতে আমাদের কাজ করতে সুবিধা হলো। তিনি তহবিল সংগ্রহের কাজ অব্যাহত রাখলেন।
আমরা দেখলাম অনেক ক্ষেত্রে কাজ করা দরকার। ব্রিটিশ এমপিদের সঙ্গে দেখা করতে শুরু করলাম। তাদেরকে পরিস্থিতির অমানবিক ভয়াবহতা সম্পর্কে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে বোঝানো হলো। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশ বিষয়ে প্রশ্ন তোলার জন্য তাদের সঙ্গে দেনদরবার চলতে থাকলো। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে যাওয়া শুরু করলাম। প্যারিসে গেলাম, কোপেনহেগেন গেলাম।
আমরা শুধু ইংল্যান্ডেই আমাদের কার্যক্রম সীমিত রাখতে চাইছিলাম না। ইউরোপের দেশগুলো মানবিক বিষয়ে খুবই সহানুভূতিশীল এবং সহমর্মী। জানতাম তাদের কাছে প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরতে পারলে তারা সক্রিয় হয়ে উঠবেন।
৭.
ডিসেম্বরের ৬ তারিখে ভারত যেদিন স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলো, সেদিন আমি ছিলাম কোপেনহেগেনে। সেদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সেদিন আমরা দেখা করতে গিয়েছি। মন্ত্রীকে বললাম, ভারত আজ আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছে। আপনারা কবে স্বীকৃতি দেবেন?
তিনি বললেন, যতো দ্রুত সম্ভব। ইউরোপের মধ্যে আমরাই প্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে চাই। তবে আমরা আরও কয়েকদিন অপেক্ষা করবো।
১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেলো। ১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ডেনমার্কসহ ব্রিটেন, পশ্চিম জার্মানি, ফিনল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে, আইসল্যান্ড ও ইসরাইল আমাদের স্বীকৃতি দিলো।
ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী তখন শিলংয়ে অবস্থান করছিলেন। তিনি সিলেট অঞ্চলে খাদ্য প্রেরণের জন্য আসাম সরকারের অনুমতি গ্রহণের চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। তিনি আমাকে লিখলেন, তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। আমরা এখন বাংলাদেশে যাবো।
আসামে সিলেট অঞ্চলের যে শরণার্থীরা ছিলো, তাদের সঙ্গে ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী তামাবিল সীমান্ত দিয়ে সিলেটে ঢুকলেন।
১৭ জানুয়ারি আমি দেশে ফিরে এলাম।
ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী বললেন, সিলেটের শাল্লা এলাকা ছিল হিন্দু অধ্যুষিত। পাকিস্তানি সেনারা পুরো এলাকাটাই ধ্বংস করে ফেলেছে। আমরা ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বসবাসরত লোকজনদের দেখতে গেলাম। তখন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন ওখানকার এমপিএ। ভিকারুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের দেখা হয়েছিল সুনামগঞ্জে। তিনিও ওই এলাকায় আমাদের যেতে বলেছিলেন।
শাল্লায় গেলাম। দেখলাম, অনেক গ্রাম প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে। ঘরবাড়ির অস্তিত্ব নেই।
আমরা শাল্লায় কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ভেবেছিলাম, শহরাঞ্চলে তো অনেকেই অনেক কিছু করবে। প্রত্যন্ত গ্রামে অনেকেই আসতে চাইবে না। অথচ এ অঞ্চলের মানুষের জন্য কাজ করাটা জরুরি। যারা সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে, পাশে না দাঁড়ালে, তাদের বেঁচে থাকা কষ্টকর হবে। এত যুদ্ধ আর রক্তপাতের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হলো, এখন দেশের মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার চাইতে জরুরি কাজ আর কী আছে?
৮.
এতোদিন বিদেশে বসে দেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করছিলাম। এবার স্বাধীন দেশের দরিদ্র, অসহায়, সবহারানো মানুষের পুনর্বাসনের কাজ শুরু করলাম। এজন্য একটা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন। গ্রামের মানুষের জন্য কাজ করবো, তাই প্রতিষ্ঠানের নাম দিলাম ‘বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন অ্যাসিস্ট্যান্স কমিটি’, সংক্ষেপে ‘ব্রাক’।
এটা ছিলো ১৯৭২ সালে ফেব্রুয়ারি মাসের ঘটনা।
৯.
স্বাধীনতার পর যখন বিদেশ থেকে ফিরে আসি, তখন আমার সঙ্গে টাকাপয়সা তেমন একটা ছিলো না। আমরা বিভিন্ন উৎস থেকে যে অর্থ সংগ্রহ করতাম, তা প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের কোনো না কোনো কাজে ব্যয় করা হতো।
ভিকারুল ইসলাম চৌধুরীর কলকাতার ব্যাংক একাউন্টে ২৫ হাজার ভারতীয় রুপি ছিলো। এই সামান্য টাকা দিয়ে তো আর কাজ চলবে না। আরও টাকা চাই। কাজ করার ইচ্ছে যতোই প্রবল হোক না কেনো, টাকা না থাকলে এগোনো যাবে না। সুতরাং অর্থসংগ্রহই তখন প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ালো।
লন্ডনে আমার ছোট একটা ফ্ল্যাট ছিলো। আমি তখন বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের জন্য কাজ করছি, তখন তো আমার চাকরি ছিলো না। নিজের খরচ চালানোর জন্য ওই ফ্ল্যাটটি বিক্রি করে দিয়েছিলাম। বিক্রি করে পেয়েছিলাম ৬৮০০ পাউন্ড। লন্ডনের একটি ব্যাংকে এই অর্থ রেখে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, এটা দিয়ে পরবর্তী তিন-চার বছর আমার চলে যাবে।
ব্র্যাকের কাজ শুরু করার জন্য লন্ডনের ব্যাংক থেকে ওই অর্থ তুলে দেশে নিয়ে এলাম। কলকাতায় ভিকারুল ইসলাম চৌধুরীর অ্যাকাউন্টের ২৫ হাজার ভারতীয় রুপি এবং আমার ফ্ল্যাট বিক্রির ৬৮০০ পাউন্ড দিয়ে ব্র্যাকের প্রথম কার্যক্রম শুরু হলো। শাল্লার মানুষের জন্য ‘রিলিফ অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন’ কর্মসূচি শুরু করলাম। সেদিক থেকে ব্র্যাকের প্রথম ‘ডোনার’ আমি নিজে।
১০.
মানুষের জন্য কাজ করতে হবে, ব্র্যাক শুরু করার সময় এই ছিলো একমাত্র চিন্তা। কখনও ভাবিনি যে, ব্র্যাক হবে পৃথিবীর সবচাইতে বড় এনজিও, এও ভাবিনি, দেশের সীমানা ছাড়িয়ে এর পরিচিতি ছড়িয়ে পরবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।
আমি একটা বিষয়ে সবসময় সচেতন থাকার চেষ্টা করেছি। এমন কোনো কাজ আমি করতে চাইনি, যে কাজ সুষ্ঠুভাবে করতে পারবো না। যে কাজই করি না কেনো, ভালভাবে করবো, এটাই আমার নীতি।
ব্র্যাক শুরু করার সময়ও কথাটা আমার মাথায় ছিলো।
নিজেদের অর্থ দিয়ে ব্র্যাকের কাজ শুরু করেছিলাম। আমাদের অর্থের পরিমাণ খুব বেশি নয়, কিন্তু তা দিয়ে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে কাজ শুরু করেছিলাম। সেজন্যই আমরা সাফল্য অর্জন করেছি। পরবর্তী সময়ে বিদেশি দাতা সংস্থাগুলো আমাদের কার্যক্রমে তহবিল জোগান দিয়েছে। ফলে কাজ করা সহজ হয়েছে।
প্রথম যে বিদেশি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাককে অর্থ প্রদান করেছিলো, সেটা হলো অক্সফাম-জিবি। অক্সফাম প্রায় দু’লক্ষ পাউন্ড দিয়েছিলো। এই অর্থ দিয়ে আমরা অনেক কাজ করেছিলাম।
১৯৭২ সালের অক্টোবরে আমি লন্ডন গেলাম। অক্সফামের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করলাম। লক্ষ্য করলাম তারা আমাদের কাজে খুবই খুশি। তারা বললেন, সারা পৃথিবীতে আমাদের প্রায় সাতশ প্রজেক্ট আছে। এর মধ্যে যে প্রজেক্টগুলো সবচাইতে ভালো চলছে, ব্র্যাক তার মধ্যে অন্যতম। অল্প সময়ের মধ্যে ব্র্যাক অনেক কাজ করেছে, যে কাজগুলো মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ছিলো খুবই জরুরি। অক্সফামের কর্তাব্যক্তিদের এই সন্তুষ্টির যথাযথ কারণ ছিলো। আসলে অল্প সময়ের মধ্যে আমরা অনেক কাজ করেছিলাম।
১১.
মার্চ মাসে প্রথম যেদিন শাল্লায় গেলাম, সেদিনকার কঠিন পরিস্থিতির কথা আজও মনে পড়ে আমার। থাকার জায়গা নেই। কোথায় ঘুমাবো জানি না। বাজারের একটা দোকানের মাচার উপর শুতে হলো। রাতে প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি হলো। মাচায় পানি পড়লো সারারাত। ঘুমাতে পারলাম না। পরদিন ডাকবাংলোয় থাকলাম।
তখন আমার বয়স ছত্রিশ। সতের মাইল পথ হেঁটে গেছি। সবকিছুকেই জীবনের অংশ বলে মনে করেছি। বাধা পেয়ে পিছিয়ে আসার কথা কখনও ভাবিনি।
কাজ করতে গিয়ে অনেক মানুষকে সঙ্গে পেয়েছি। অনেক মুক্তিযোদ্ধা ফিরে এসে আমাদের কাজে যোগ দিয়েছেন। সবাই মিলে একত্র হয়ে পরিশ্রম করেছি। কাজ করেছি মানুষের জন্য। সেই পরিশ্রম, সেই কাজের ফসলই হচ্ছে ব্র্যাক।
(‘ফজলে হাসান আবেদ ও ব্র্যাক’ বই থেকে)
আরও পড়ুন:
চলে গেলেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ার কারিগর
Comments