নাগপুরে অস্বস্তির কাঁটা আর মন ভরানো বিদর্ভের মাঠ
ভারত বিশাল দেশ। এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে গেলে বদলে যায় আবহাওয়া, বদলায় মানুষের ধরন, ভাষা, সংস্কৃতি। ফারাক তৈরি হয় নিয়ম-কানুনের মধ্যেও। গুজরাটের রাজকোটে স্বস্তির চারদিন পেরিয়ে মহারাষ্ট্রের তৃতীয় বৃহত্তম শহর নাগপুরে এসে ফারাক যে আসলে কতটা তা টের পাওয়া গেল।
প্রথমেই বিড়ম্বনা হোটেল নিয়ে। অনলাইনে হোটেল বুক করে শুক্রবার রাতে নির্ধারিত হোটেলে এসে জানা গেল তৈরি নেই রুম। হোটেলের ম্যানেজার উল্টো বিস্ময়কর এক দাবি জানিয়ে বসলেন। রুম দিবেন পরের দিন সকালে, কিন্তু তিন দিনের টাকা অগ্রিম দিয়ে দিতে হবে এক্ষুনি! সেই থেকে শুরু অদ্ভুত সব বিড়ম্বনার।
নাগপুরে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, চিকিৎসা, অর্থনীতির অনেকগুলো কনফারেন্স চলছে এই সময়ে। বিভিন্ন পেশার মানুষজন এই শহরে ভিড় করায় হোটেল সংকট প্রকট। সঙ্গে যোগ হওয়া এখানকার থমথমে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নানান বিধি-নিষেধের বেড়াজালে বন্দি করে দিয়েছে পর্যটক বা নানা কাজে আসা মানুষদের।
নাগপুরের ছোট্ট সুন্দর বিমানবন্দরে নেমে বড় শান্তিই লেগেছিল। ভারতের ঠিক মাঝখানে পড়েছে নাগপুর। ট্যাক্সি ক্যাবে করে মূল শহরে যেতে দুপাশের প্রকৃতিও দিচ্ছিল মনোরম অনুভূতি। কিন্তু হোটেলে এসে সার্বিক পরিস্থিতি দেখে সব স্বস্তি উধাও। জমা হলো বরং তিক্ততা।
প্রথম হোটেলে বনিবনা না হওয়ায় লাগেজ নিয়ে মাঝরাতে হোটেল খুঁজতে বেরুতে হলো। পাওয়াও গেল। কিন্তু নানান রকমের ফরম, জেরা আর অদ্ভুত সব নিয়ম জেনে মনে হলো- এ কোথায় এসে পড়লাম! হোটেলের মালিক আবার এক গুজরাটি ভদ্রমহিলা। তার নাম ‘আল্প’। মানে কম চাহিদা সম্পন্ন মানুষ। কিন্তু নামের সঙ্গে পুরোই বেমানানভাবে জানিয়ে দিলেন লম্বা চাহিদা। এটা দিতে হবে, ওটা দিতে হবে। এটা করা যাবে না, সেটা করা যাবে না- নানান কিছু। পরিস্থিতির কারণেই যে তাকে এমন রূঢ় হতে হচ্ছে জানিয়ে দিলেন তাও। অগত্যা কি আর করা। তাও রক্ষা যে তিনি জায়গা দিলেন বলে রাত-বিরেতে একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই তো হলো।
হোটেলে ওঠার পরই শুনলাম পরদিন আলোচিত একটি স্পর্শকাতর মামলার রায় দেওয়া হবে। রাজনৈতিক কারণে এই রায় নিয়ে পুরো ভারতের মতো নাগপুরেও নেওয়া হয়েছে বাড়তি সতর্কতা। তার উপর এখানকার রাজ্য সরকার গঠন নিয়ে চলছে অচলাবস্থা। আমরা শহরে ঢুকবার কয়েক ঘন্টা আগেই মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করে বসেছেন। সেই ভদ্রলোকের বাড়িও এই নাগপুরেই। বছরের একটা সময় নাগপুরে মহারাষ্ট্র রাজ্যসভার সংসদও বসে। নাগপুরেই আলোচিত হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আরএসএসের প্রধান কার্যালয়ও। নানান কারণে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় এমন বিরূপ পরিস্থিতিতে শহরে একটা গুমোট ভাব লক্ষ্য করা গেল।
শনিবার হাফ ডে হলেও এখানে অনেক অফিস, স্কুলই কার্যত সারাদিনই বন্ধ ছিল। বাড়তি সতর্কতা হিসেবে মানুষজন ঘর থেকে বেরুতে নানান হিসাব কষছিলেন। শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে বিদর্ভ অ্যাসোসিয়েশনের মাঠে যেতে প্রশস্ত রাস্তার ফাঁকা পড়ে থাকাও সেই সাক্ষ্য দেয়।
এখানে দৃশ্যমান কোনো অশান্তি চোখে পড়েনি অবশ্য। কিন্তু মতাদর্শিক দ্বন্দ্বের প্রেক্ষিতে মানুষে-মানুষে একটা অবিশ্বাস টের পাওয়া গেল। অবিশ্বাসের বীজ কারা কী কারণে পুঁতে রেখেছেন, ক্রিকেট কাভার করতে এসে সে আলাপে যাওয়া বোধ হয় অনধিকার চর্চার মতো।
বরং এখানকার ক্রিকেটে ফিরলে দমবন্ধ পরিবেশ থেকে নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ মেলে। শহরের সমস্ত বিষ ছাপিয়ে ফুরফুরে আমেজ নিয়ে একেবারেই যেন আলাদা বিদর্ভ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের মাঠ। বিদর্ভের দল গত দুইবারই ভারতের প্রথম শ্রেণির সবচেয়ে বড় আসর রঞ্জী ট্রফির চ্যাম্পিয়ন। তাদের মাঠেই সিরিজ নির্ধারণী টি-টোয়েন্টিতে খেলতে নামবে বাংলাদেশ-ভারত। চ্যাম্পিয়ন বিদর্ভের মাঠও তাদের মতোই চ্যাম্পিয়ন।
একটা ইকোপার্কে ঘেরা নয়নাভিরাম পরিবেশে বিশাল স্টেডিয়াম কমপ্লেক্স। বিদর্ভ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের শক্তিশালী অবকাঠামোর সাক্ষ্য বহন করে পুরো এলাকা। অত্যাধুনিক সব সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন দৃষ্টিনন্দন স্টেডিয়াম যে কারোরই মন ভুলিয়ে দেবে। আয়োজকদেরও যত্ন-আত্তির কোনো কমতি নেই। বাংলাদেশি সাংবাদিকদের দেখ-ভালের জন্য তাদের আন্তরিকতাও টের পাওয়া যায় গাঢ়ভাবে। সবকিছুতে পরিকল্পনার ছাপ আর সমন্বয় বুঝিয়ে দেয় সাংগঠনিকভাবেও তারা কতটা দক্ষ।
কাজের ক্ষেত্রে এমন পরিবেশ সত্যিই স্বস্তির। কিন্তু কাজের বাইরেও চোখ, মন তো না চাইলেও চলে যায়। গায়ে লাগা কোনো হাওয়ার তাপ কতটুকু তা এমনিতেই টের পাওয়া যায়। তাতে অস্বস্তির ছোঁয়া পেলে ফেরার তাড়া হয়ে যায় তীব্র।
আরও পড়ুন: উদার রাজকোটে নিবিড় চারদিন
Comments