উদার রাজকোটে নিবিড় চারদিন
হিন্দুর ভারত, মুসলমানের ভারত, দলিতের ভারত। নানান জাত-পাত নির্বিশেষে সকলের ভারত। মহাত্মা গান্ধীর জীবন দর্শনে এই অসাম্প্রদায়িক চিন্তা ছিল প্রবল। বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি আর বহুধর্মের সম্মিলনে ভারতবর্ষের পরিচয়ও করানো হয় এভাবে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ভারত তথা উপমহাদেশের ছবি সেই পরিচয়ে আঘাত হানে প্রায়ই। বারবার খবরে বড় জায়গা দখল করে হিংসা-বিদ্বেষেরই চিত্র। গান্ধীর শৈশবের স্মৃতি ভরপুর রাজকোট শহরে দিন চারেকের অবস্থানে মিলল অবশ্য এক স্বস্তির আবহ। সাম্প্রদায়িক বিষ নয়, এখানে পাওয়া গেল সমন্বয়বাদের বহু প্রত্যাশিত জীবনধারা।
রাজকোট শহরে ‘আলফ্রেড স্কুলে’ তৃতীয় শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন গান্ধী। তার স্মৃতি ঘেরা সেই বিদ্যালয় এখন জাদুঘর। গান্ধীর জীবনের নানান ধাপ সাজিয়ে গুছিয়ে উপস্থাপনের ব্যবস্থা করা আছে ওখানে। কিন্তু গান্ধীকে ঠিক জাদুঘরেই বন্দি করে রাখেনি এখানকার মানুষ।
সকাল বেলা নাগজি ভাইয়ের চায়ের দোকানে যেমন মেলে বাপুজিকে, তেমনি বাপুজিকে মেলে রাত্রিবেলা শিবাজি পার্কে অলস সময় কাটানো মানুষের মাঝেও।
রাজকোটে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলিমের বাস। সিনএনজি চালিত অটোরিকশার বেশিরভাগ চালকই মুসলিম। চলতে ফিরতে তাদের সঙ্গে আলাপ হওয়া অবধারিত। তেমনি একজন ইকবাল জানালেন, ‘এখানে আমরা খুব শান্তিতে বাস করি, কোন ঝামেলা নেই। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে কোনো সমস্যা নেই।’ ইকবালের মুখের কথা-ই নয়, বাস্তবের চিত্রতেও তেমনই আঁচ পাওয়া গেল।
গুজরাট যেমন গান্ধীজীর জন্মস্থান, এই রাজ্যের মানুষ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও। তার দলের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বদনামও চড়া। গুজরাটের দাঙ্গাও বেশি আগের কথা নয়। সেই দাঙ্গার প্রভাব বোধহয় পড়েনি রাজকোট শহরে। না হলে এতটা স্বাভাবিক হয় কি করে জীবনযাপন! তবে মুসলিমরা স্বভাবতই বিজেপিবিরোধী, অনেকেই কট্টরভাবে কংগ্রেসের সমর্থক। পুরো ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে স্পষ্ট সমালোচনা করতেও ছাড়েন না তারা।
রাজকোট গুজরাট রাজ্যের চতুর্থ বৃহত্তম নগরী। ভারতের হিসেবে মফস্বল শহরই বলা চলা। মূল শহরেও খুব একটা ভিড় নেই। জীবন চলছে সহজ সুন্দর। আমার বরাবরই এমন পেছনের সারির শহর পছন্দ। অতো ভিড়ভাট্টা, অকারণ ছুটোছুটি দেখতে ভালো লাগে না। কোথাও স্থির হয়ে তাকিয়ে দেখার সুযোগ থাকা চাই। রাজকোটের জীবন ব্যবস্থা তেমনই। এখানে নিবিড় একধরনের স্থবিরতা আছে।
শহরের চরিত্র আসলে কেমন তা বোঝা যায় রাত দিয়ে। রাতে যে শহর যত বেশি আপন, যত বেশি স্বস্তির বা নিরাপদ, সে শহরকে সভ্যতার মাপকাঠিতে তত বেশি মার্কস দেওয়া যায়। রাজকোটে সবচেয়ে যা স্বস্তি দেবে তা রাতের শহর।
পরিষ্কার নির্ঝঞ্ঝাট ফুটপাত দিয়ে হাঁটাচলার পথ অবারিত। কিছু দূর পর পর আছে জিরিয়ে নেওয়ার বেঞ্চি। একদম ব্যস্ততম মোড়েও হাঁটাচলার পাশাপাশি বসে পড়ার ব্যবস্থা মুগ্ধ করার মতোই। আমাদের দেশের শহরগুলোর কথা ভাবলে মন খারাপই হয়ে যায়।
সবচেয়ে অবাক করে এই শহরের মানুষের নিরাপত্তাবোধ। রাত ১২টাতেও পার্কের, রাস্তার পাশের বেঞ্চিতে ছেলেমেয়েরা বসে আড্ডা দিচ্ছে, কোথাও একলা নারী বসে নীরবতা উপভোগ করছেন। শিশুরাও বাবা-মার সঙ্গে অবাধ হুল্লোড়ে ব্যস্ত। এক মুহূর্তের জন্যও কারও নিরাপত্তাহীনতার বোধ নেই। শহরে আগন্তুক হয়ে আসা আমাদের নির্জন রাস্তা দিয়ে হাঁটলেও ভিন্ন কিছুর চিন্তা করতে হয়নি একবারও। পুলিশের কেইস ফাইল বলে রাজকোটে অপরাধ প্রবণতা কম। তাই পুলিশের খামাখা বাড়বাড়ি করার দায় নেই।
শহরময় হরদম ছুটে বেড়ানো স্কুটিও আলাদা নজর কাড়বে এখানে। কম বয়সী মেয়েরা তো বটেই, বয়স্ক নারীদেরও বাহন স্কুটি। রাজকোটের আরেকটা ব্যাপার আপনার নজর কাড়বেই। এখানে পাড়ায়-মহল্লায়, অলিতে-গলিতে আছে আইসক্রিম পার্লার। জানা গেল, কমপক্ষে শতাধিক আইসক্রিম পার্লার আছে শহর জুড়ে। বেশ বড় পরিসর নিয়ে যেখানে বিক্রি হয় কেবলই আইসক্রিম। কোনো কোনো দোকানের বয়স আবার শত বছরও পেরিয়ে গেছে।
গুজরাটের মানুষ নিরামিষভোজী। কেবল হিন্দুরা নন, এখানকার বড় অংশের মুসলিমদের খাদ্যাভ্যাসের মূল অংশে নিরামিষ। তবে এই চিত্র আবার সম্প্রতি বদলাতে শুরু করেছে। শহরে গড়ে উঠেছে কয়েকটি নন-ভেজিটেরিয়ান খাবারের দোকান। যার ক্রেতা মূলত পর্যটকরা।
ঢাকা থেকে দিল্লিতে এসে পড়তে হয়েছিল হাঁসফাঁস পরিস্থিতিতে। দিল্লি ছেড়ে রাজকোট ফুরফুরে হাওয়ায় ভরিয়ে রেখেছে মন। যার সঙ্গেই ক্ষণিকের পরিচয় হয়েছে, টের পাওয়া গেছে গাঢ় আন্তরিকতা। ফেরার সময় এই শহরকে প্রণাম জানিয়ে আসতে হলো। আর কখনো হয়তো এই শহরে আসা হবে না। সমন্বয়বাদ, অহিংসার বাণী আর আন্তরিকতার দুয়ার খুলে ভালো থাকুক রাজকোট। বলা যায় না, কী অপেক্ষা করছে নাগপুরে!
Comments