ক্রিকেটে রাজনীতির ‘অশনি সংকেত’

shakib and papon
স্টার ফাইল ছবি

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখে আর সত্যজিৎ রায় সিনেমা বানিয়ে ‘অশনি সংকেত’ শব্দ দু’টি বাঙালির কাছে প্রিয় ও পরিচিত করে গেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে সেনাবাহিনীর জন্যে অতিরিক্ত খাদ্য সংগ্রহ-মজুদ করেছিল ব্রিটিশ সরকার। যার প্রেক্ষিতে আমাদের এই অঞ্চলে দুর্ভিক্ষের শিকার হয়েছিলেন ৫০ লক্ষাধিক মানুষ। সেই থেকে কোনো খারাপ সময় আগমনের ইঙ্গিত পেলেই বলা হয়ে থাকে ‘অশনি সংকেত’। মাত্র দু’টি শব্দ দিয়ে বহু কিছু বোঝানো যায়।

বাংলাদেশের মানুষের আশা, ভালোবাসা আর গৌরবের নাম ক্রিকেট ও ক্রিকেটার। দুঃখ-কষ্ট-বেদনায় জর্জরিত ছোট্ট এই দেশের ষোলো-সতেরো কোটি মানুষের আনন্দ-গৌরবের উপলক্ষ এনে দেয় ক্রিকেট। ফলে মানুষ ক্রিকেট ও ক্রিকেটারদের ভালোবাসে হৃদয় দিয়ে। মানুষের আবেগ-ভালোবাসার ক্রিকেটে ‘অশনি সংকেত’র ইঙ্গিত গত কিছুদিন ধরে পাওয়া যাচ্ছিল। সুনির্দিষ্ট করে না হলেও কিছু একটা যে ঘটছে বা ঘটতে যাচ্ছে, তা বোঝা যাচ্ছিল। ক্রিকেটারদের আকস্মিক ধর্মঘট ক্রিকেটের ‘অশনি সংকেত’কে দৃশ্যমান করে তুলল। এরপর একে একে বেরিয়ে আসছে বহু কিছু।

১. বাংলাদেশ দলের প্রধান খেলোয়াড় হিসেবে একজনের নাম বলতে হলে অবশ্যই সেই নামটি সাকিব আল হাসান। বাংলাদেশ দল ভারতে খেলতে যাবে। ভারতের গণমাধ্যম বিশ্লেষণ করছে- ‘সাকিব আল হাসানদের সহজে হারানো যাবে না’। বাংলাদেশ দলের এখন আইকন ক্রিকেটার সাকিব। মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে এই গৌরব তিনি অর্জন করেছেন। অথচ দল ভারতে যাওয়ার একদিন আগেও জল্পনা-কল্পনা চলছে সাকিব ভারত সফরে যাবেন কিনা! বিষয়টি বিসিবি সভাপতি নিজেও জানেন না। তিনিও প্রশ্ন করছেন!

দল অনুশীলন করছে, সেখানে সাকিব নেই। প্রস্তুতি ম্যাচ খেলছে সাকিবকে ছাড়া। আরেক গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেটার তামিম ইকবাল ভারত সফরের দল থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। কারণ যে পুরোপুরি যুক্তিসঙ্গত, তাও নয়। দ্বিতীয় সন্তানের আগমনের প্রেক্ষিতে পুরো সফর থেকে সরে দাঁড়ানো জরুরি ছিল না। সফরের শেষ দিকে দ্বিতীয় টেস্ট না খেলেই ফিরে আসার সুযোগ ছিল।

ভারত সফর যে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তা ক্রিকেটারদের চেয়ে ভালো কারো জানার কথা নয়। উল্লেখ্য, ভারত এই প্রথম বাংলাদেশকে পূর্ণাঙ্গ সিরিজ খেলতে আমন্ত্রণ জানিয়েছে।

২. সাকিব আল হাসানরা তাদের ১৩ দফা দাবি নিয়ে ধর্মঘটে গেছেন। দেশের গণমাধ্যম ও জনমানুষ ক্রিকেটারদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। বিসিবিও বাস্তবতা উপলদ্ধি করে দ্রুতগতিতে দাবি মেনে নিয়েছে। কিছু বাস্তবায়ন করতেও শুরু করেছে। ক্রিকেটারদের দাবির অন্যতম ভিত্তি ছিল বিসিবিকে পেশাদারিত্বের সঙ্গে চলতে হবে। সবার আগে দেখতে হবে ক্রিকেটারদের স্বার্থ। বিসিবির আচরণে পেশাদারিত্ব নেই, ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের মতো করে চলছে। সেই আলোচনায় পরে আসছি।

কিন্তু পেশাদারিত্ব কি ক্রিকেটারদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়? সাকিব আল হাসানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়? আমি দলের এক নম্বর খেলোয়াড়, আমাকে ছাড়া দল চলবে না, এমন ভাবনা ভাবতে পারেন কোনো ক্রিকেটার? দেশের চেয়েও আপনি বড়? শুনতে যত কঠিনই হোক না কেন, আচরণ দিয়ে সাকিব দৃশ্যমান করেছেন- এই অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত।

বিসিবির সঙ্গে ক্রিকেটারদের চুক্তিতে পরিষ্কার নিয়ম আছে, কোনো টেলিকম কোম্পানির সঙ্গে কোনো খেলোয়াড় ব্যক্তিগত কোনো চুক্তি করতে পারবেন না। মাশরাফি বিন মর্তুজা, তামিম ইকবালরা ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও এই নিয়মের কারণে এমন চুক্তি করতে পারেননি। কিন্তু সাকিব আল হাসান শতভাগ নিয়মবহির্ভূতভাবে গ্রামীণফোনের সঙ্গে চুক্তি করে তাদের ‘পণ্যদূত’ হয়েছেন। বিসিবিকে কোনো কিছুই জানাননি। এমন এক সময়ে তিনি গ্রামীণফোনের সঙ্গে চুক্তি করেছেন, যখন তার নেতৃত্বে ক্রিকেটাররা ন্যায্য দাবিতে আন্দোলন করছিলেন। সেই সময়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে গোপনে সবচেয়ে বড় ‘অন্যায্য’ কাজটি সাকিব নিজে করেছেন।

৩. এবার আসি বিসিবি প্রসঙ্গে। বিসিবি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভারত সফরে দল পাঠাবে, সেই দলে কে খেলবেন, কে খেলবেন না- বোর্ড সভাপতি আগের দিনও তা জানেন না। তিনি গণমাধ্যমের সামনে তার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন, যেন ক্রিকেটারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। ক্রিকেটারদের নিয়ন্ত্রণে রাখা ও নিয়ম মেনে চলতে বাধ্য করার মতো আইনি ক্ষমতা বিসিবির হাতে আছে। প্র্যাকটিস সেশনে না আসলে, কু-যুক্তি দিয়ে দলের সঙ্গে সফরে যেতে না চাইলে, শর্তভঙ্গ করে চুক্তি করলে কী ব্যবস্থা বা শাস্তি হবে তা বিসিবির আইনে পরিষ্কার করে বলা আছে। বিসিবি যুক্তিসঙ্গতভাবে দেশের স্বার্থে স্বচ্ছতার সঙ্গে সেই আইন প্রয়োগ করতে পারে। প্রয়োগ করতে পারে সাকিব, মাশরাফি, তামিম বা যে কোনো ক্রিকেটারের ক্ষেত্রে। এই আইনের প্রয়োগ তখনই করা যায় যখন বোর্ড নিজে পেশাদারিত্বের সঙ্গে চলে। বিসিবি চলে ব্যক্তি সভাপতির ইচ্ছে বা অনিচ্ছেয়। বিমানবন্দরে বসে বেতন বাড়িয়ে দেয়া, ক্রিকেটারের মোবাইল নম্বর ডিলিট করার হুমকি দেয়ার সঙ্গে পেশাদারিত্বের কোনো সম্পর্ক নেই। ফলে বিসিবি সভাপতি নিয়মভঙ্গ করা ও কথা না শোনা ক্রিকেটারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছেন না। গণমাধ্যমের সামনে হুঙ্কার দিচ্ছেন। পেশাদার রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠান যার পরিধি আন্তর্জাতিক অঙ্গন পর্যন্ত বিস্তৃত, তার সভাপতি হয়ে গণমাধ্যমে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখানো যথাযথ বা ভালো কোনো লক্ষণ নয়।

৪. ক্রিকেটে এই ‘অশনি সংকেত’র পেছনে রাজনীতির একটি বড় ভূমিকা আছে। ম্যারাডোনা জমানার লাতিন আমেরিকার ফুটবলের দিকে একটু নজর দিয়ে দেখেন। ম্যারাডোনা বা আর্জেন্টিনার ফুটবলকে শাসকরা কীভাবে ব্যবহার করেছে বা করার চেষ্টা করেছে। আমাদের এই অঞ্চলে পাকিস্তান, ভারত বা বাংলাদেশে ক্রিকেটের সাফল্যকে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের সাফল্য হিসেবে দেখাতে চান। ভারতে অন্যান্য প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী হওয়ার কারণে নানা প্রতিকূলতা তারা মোকাবিলা করতে পারে। খেলোয়াড় ও খেলার ওপর তেমন একটা প্রভাব পড়ে না। পাকিস্তানের ক্ষমতাসীনরা তো তাদের ক্রিকেটকে প্রায় ধ্বংসই করে দিয়েছে। রাজনীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটও। বাংলাদেশের ক্রিকেট বোর্ড কখনো রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগের ঊর্ধ্বে ছিল না। কিন্তু ক্রিকেটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সাংগঠনিকভাবে দক্ষ-যোগ্যরা দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। সেই সময়ও নিয়োগ রাজনৈতিক বিবেচনাতেই হয়েছিল। দায়িত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে যোগ্যতা-দক্ষতাও বিবেচিত হয়েছিল। তারপর থেকে যোগ্যতা-দক্ষতার দিকটি তেমন একটা বিবেচিত হতে দেখা যায়নি। উল্টো ক্রিকেটাররা নিজেরাও জড়িয়ে গেছেন রাজনীতিতে। জাতীয় দলে খেলা অবস্থাতে মাশরাফি এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। সাকিবও সেই ধারাতে থেকে শেষ মুহূর্তে নিজেকে সরিয়ে নেন। বাংলাদেশের মানুষের কাছে মাশরাফির যে অবস্থান, তাতে যে কোনো নির্বাচনেই হয়তো তিনি বিজয়ী হতেন। সেটা হতে পারতো খেলা থেকে অবসর নিয়ে।

কিন্তু তিনি এমপি নির্বাচিত হয়েছেন জাতীয় দলের অধিনায়ক থাকা অবস্থাতে, ভোটারবিহীন-প্রশ্নবিদ্ধ একটি নির্বাচনে। এতে শুধু ক্ষতি তার নিজের হয়নি, ক্রিকেটেরও হয়েছে। সাকিবের অবাধ্যতা, নিয়ম না মানার সঙ্গেও জড়িয়ে আছে রাজনীতি। সাকিবের আচরণে এমনটা দৃশ্যমান যে, কেউ যেন তাকে কিছু বলতে পারবে না। রাজনীতি তাকে রক্ষা করবে।

সব কিছুরই একটা পরিণতি থাকে। সব পরিণতি শুভ হয় না। দেশ বা দলকে উপেক্ষা করে, বোর্ডকে তোয়াক্কা না করে, দাপট-প্রভাব দেখানো কোনো অর্থেই শুভফল বয়ে আনে না। সাকিবকে কেন্দ্র করে জাতীয়-আন্তর্জাতিক অঙ্গণে যে গুঞ্জন ডালপালা মেলছে, তা সম্পর্কে অবগত নন স্বয়ং বোর্ড সভাপতিও। এই দায় কার, সাকিবের না বোর্ড সভাপতিরও? দায় আসলে বিসিবি পরিচালনা পদ্ধতির। বিসিবির কর্তারা নিয়ম অনুসরণ করছেন না। নিয়ম ভঙ্গ করছেন ক্রিকেটাররাও।

৫. বাংলাদেশ ক্রিকেটে অনেক উন্নতি করেছে, সর্বত্রই এমন প্রশংসা শোনা যায়। এমন প্রশংসা সত্য এবং বাংলাদেশের প্রাপ্য। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ পৃথিবীর সবক’টি বড় দলকে দাপটের সঙ্গে পরাজিত করেছে। আন্তজার্তিক মানদণ্ডে তারকা, এমন একাধিক ক্রিকেটার আছেন বাংলাদেশ দলে। সবই ক্রিকেটের জন্য ইতিবাচক ও উন্নতির প্রমাণ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি অভিজ্ঞ ও অত্যন্ত শক্তিশালী একটি দল হয়েও বাংলাদেশ কোনো ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সাফল্য পায়নি। অথচ সাফল্য পাওয়াটা প্রত্যাশিত ছিল। কারণ এটাই বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা দল। একদল তারকা ক্রিকেটার এক সঙ্গে বহুদিন খেলছেন। শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটের এমন সময়কালে তারা বিশ্বকাপসহ অনেক বড় টুর্নামেন্টে বিজয়ী হয়েছে। বাংলাদেশ তার এই গৌরবোজ্জ্বল সময়ে বিশ্বকাপ দূরে থাক, বড় কোনো টুর্নামেন্ট জিততে পারেনি। ক্রিকেটে এমন সুবর্ণ সময় স্থায়ী হয় না। একঝাঁক তারকা খেলোয়ার অবসরে গেলে, কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়। যেমন কঠিন সময়ে আছে শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট। বাংলাদেশ যখন মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ শূন্য হবে, হুট করে তা পূরণ হবে না। সেই কঠিন সময় বাংলাদেশের সামনে অপেক্ষা করছে। তার আগেই বাংলাদেশের ক্রিকেটে অরাজকতা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।

বিসিবি এবং ক্রিকেটাররা কেউই সঠিক পথে চলছেন না! নি:সন্দেহে জনমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক সম্ভাবনাময় ক্রিকেটের জন্যে তা ‘অশনি সংকেত’।

s.mortoza@gmail.com

আরও পড়ুন: হায় ক্রিকেট, হায় বিসিবি

Comments

The Daily Star  | English

Mindless mayhem

The clashes between students of three colleges continued yesterday, leaving over 100 injured in the capital’s Jatrabari.

6h ago