নিজেই নিজের ডিগ্রিদাতা!

BSMRSTU-1.jpg
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। ছবি: সংগৃহীত

আপনি কি কখনও কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিভাগের চেয়ারম্যানকে সেই বিভাগেই স্নাতকোত্তর কোর্সে ভর্তির জন্য অনুমোদন দিতে এবং শেষ পর্যন্ত ডিগ্রি অর্জন করার কথা শুনেছেন?

বিষয়টি অদ্ভুত শোনালেও, গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল (সিএসই) বিভাগে এমনটিই ঘটেছে।

এমনকি, বিভাগটির চেয়ারম্যান (বর্তমানে সাবেক) আক্কাছ আলী ওই বছর কোর্সটিতে অংশ নেওয়া প্রথম এবং একমাত্র ছাত্র ছিলেন।

বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে স্নাতকোত্তরের তিন সেমিস্টার শেষ করে বশেমুরবিপ্রবির সিএসই বিভাগ থেকে তিনি তার শেষ সেমিস্টারটি সম্পন্ন করেন।

বশেমুরবিপ্রবির নথিপত্র ঘেঁটে জানা যায়, বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে আক্কাছ আলী নিজেই ওই সেমিস্টারের জন্য তার কোর্সের রূপরেখা প্রণয়ন করেন।

নথিপত্র থেকে আরও জানা যায়, ২০১৫ সালের ৭ ডিসেম্বর প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুসারে তিনি বশেমুরবিপ্রবির প্রভাষক পদে আবেদন করেন। সেসময় সিএসই-সহ ১৩টি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষকের ২২টি শূন্য পদের জন্য আবেদন চাওয়া হয়েছিলো।

প্রভাষক পদের জন্য ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিলো, আবেদনকারীদের অবশ্যই স্নাতকোত্তর ডিগ্রি থাকতে হবে।

তবে, শুধুমাত্র তড়িৎ ও প্রকৌশল বিভাগের প্রভাষক পদের প্রার্থীদের জন্য নিয়ম শিথিল করা হয়েছিলো। বিএসসি (ইঞ্জিনিয়ারিং) ডিগ্রি থাকলেই ওই পদে আবেদনের অনুমতি দেওয়া হয়েছিলো।

সেসময় চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) থেকে ২০১১ সালে স্নাতক শেষ করে আক্কাছ আলী বুয়েটে স্নাতকোত্তরে ভর্তি ছিলেন। তারপরও তিনি চাকরি পেয়েছিলেন। যা স্পষ্টত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধির লঙ্ঘন।

যোগাযোগ করা হলে আক্কাছ আলী জোর দিয়ে বলেন যে, বিএসসি (ইঞ্জিনিয়ারিং) ডিগ্রি থাকলেই প্রার্থীরা সিএসই বিভাগের ওই পদে আবেদন করতে পারতেন।

২০১৬ সালে ২ ফেব্রুয়ারি তাকে প্রভাষক পদে নিয়োগ দেয় বশেমুরবিপ্রবি কর্তৃপক্ষ।

দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, “লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় আমি অনেক ভালো করেছিলাম। নিয়োগ কমিটি এবং উপাচার্য খুশি হয়ে আমাকে নিয়োগ দিয়েছিলেন।”

মজার বিষয় হলো- যোগদানের চার মাসের মাথায় আক্কাছ আলীকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এমনকি তার তিন মাস পরই তিনি বিভাগের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন।

আক্কাছ আলী বলেন, “উপাচার্য ওই পদের জন্য আমাকে আদর্শ বিবেচনা করেছিলেন।”

এ বিষয়ে জানতে উপাচার্য খোন্দকার নাসিরউদ্দিনের সঙ্গে কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হতে হয়েছে।

যৌন হয়রানি, শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগে স্বজনপ্রীতি এবং বঙ্গবন্ধু ম্যুরাল কমপ্লেক্স ও শহীদ মিনার নির্মাণসহ অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ এনে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে গত ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে বশেমুরবিপ্রবির হাজারো শিক্ষার্থী আন্দোলন করছেন।

অপরদিকে, যৌন কেলেঙ্কারির ঘটনায় গত এপ্রিল মাসে আক্কাছ আলীকে আজীবনের জন্য চেয়ারম্যানশিপ ও আট সেমিস্টারের জন্য একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।

অদ্ভুতুড়ে স্নাতকোত্তর কোর্স

২০১৭ সালের শুরুর দিকে বশেমুরবিপ্রবির সিএসই বিভাগে স্নাতকোত্তর কোর্স চালু করা হয়।

নাম না প্রকাশের শর্তে আক্কাছ আলীর এক সহকর্মী বলেন, “তিনি (আক্কাছ আলী) ওই কোর্সের প্রথম শিক্ষার্থী ছিলেন। তার জন্যই ওই কোর্সটি চালু হয়েছিলো।”

ওই কোর্সের জন্য আক্কাছ আলীর জমা দেওয়া ভর্তি ফরম, জীবনবৃত্তান্ত এবং সনদের অনুলিপি ডেইলি স্টারের হাতে এসেছে।

ভর্তি ফরমে দেখা গেছে, ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে শুরু হওয়া স্নাতকোত্তরের সেমিস্টারে ভর্তির জন্য আবেদন করেন আক্কাছ আলী।

ফরমের পেছন পৃষ্ঠার নীচে হাতে লেখা রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী ৬০ শতাংশ ক্রেডিট গ্রহণ করা হলো (যা তিনি বুয়েটে সম্পন্ন করেছেন)।

এর ঠিক নীচেই ওই সেমিস্টারে ভর্তির অনুমোদনের জন্য আক্কাছ আলী নিজেই স্বাক্ষর করেছেন।

সিএসই বিভাগের এক শিক্ষক বলেন, “কাগজপত্র ঘাঁটলে দেখতে পাবেন যে, তিনি (আক্কাছ আলী) নিজেই তার ভর্তির বিষয়টি অনুমোদন করেছেন।”

নিজের কোর্সের রূপরেখা প্রণেতা নিজেই

ওই স্নাতকোত্তর কোর্স পরিচালনার জন্য বশেমুরবিপ্রবি রেজিস্ট্রার অধ্যাপক মো. নুরউদ্দিন আহমেদ ২০১৭ সালের ২ এপ্রিল একটি আদেশ জারি করেন।

আদেশে বলা হয়, বিভাগের পাঠ্যক্রম অনুসারে চেয়ারম্যান কোর্সের একটি রূপরেখা প্রণয়ন করবেন এবং কোর্সের জন্য ক্লাসের সংখ্যা নির্ধারণ করেন। এক ঘণ্টার প্রতিটি ক্লাসের জন্য পারিশ্রমিক নির্ধারিত হয় এক হাজার টাকা।

ওই কোর্সের জন্য নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য প্রযুক্তি অনুষদের সহকারী শিক্ষক ও পরিচালক সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ নুরুজ্জামান ভূঁইয়াকে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন রেজিস্ট্রার।

নুরুজ্জামানের তিনটি কোর্সের ক্লাস (অ্যাডভান্স কম্পিউটার কমিউনিকেশন অ্যান্ড নেটওয়ার্কস, ডিস্ট্রিবিউটেড কম্পিউটিং সিস্টেমস এবং ওয়ারলেস সেন্সর নেটওয়ার্ক) নেওয়া এবং আক্কাছ আলীর গবেষণা কাজের তত্ত্বাবধান করার কথা ছিলো।

যোগাযোগ করা হলে নুরুজ্জামান জানান, চার মাসব্যাপী সেমিস্টারে তিনি মাত্র চারটি ক্লাস নিয়েছিলেন।

রেজিস্ট্রার অধ্যাপক নুরউদ্দিনও জানান, উপাচার্য তাকে ওই আদেশ জারির নির্দেশ দিয়েছিলেন।

দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, “কে চেয়ারম্যান আর কে পরীক্ষার্থী তা যাচাই করা আমাদের কাজ নয়।”

এই ঘটনাটি বিভাগের অন্যান্য শিক্ষকদের বিস্মিত করেছিলো।

সিএসই বিভাগের এক শিক্ষক বলেন, “এটি হাস্যকর। আক্কাছ আলী চেয়ারম্যান ছিলেন এবং তিনিই ঠিক করেছেন তিনি কী পড়বেন। এই বিভাগ ছাড়া বিশ্বের কোথাও আপনি এমনটি খুঁজে পাবেন না।”

নথিপত্রে দেখা গেছে, সেমিস্টারের চূড়ান্ত পরীক্ষায় তিনজন শিক্ষক প্রশ্নপত্র তৈরি এবং আক্কাছের উত্তরপত্র মূল্যায়ন করেছেন।

সহকারী অধ্যাপক নুরুজ্জামান তাদের একজন। অপর দুজন হলেন- খণ্ডকালীন শিক্ষক মৌসুমি বালা এবং হুসনুল আজরা। তারা দুজনেই প্রশাসনিকভাবে আক্কাছ আলীর নিম্নপদস্থ ছিলেন।

২০১৭ সালের ৪ মে চূড়ান্ত পরীক্ষার আগে হুসনুল আজরাকে সভাপতি করে ছয় সদস্যের একটি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কমিটি গঠন করেন আক্কাছ আলী।

১৪ মে বশেমুরবিপ্রবি উপাচার্য সেই কমিটিকে আনুমোদন দেন।

পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক গোলাম হায়দার জানিয়েছেন, সিএসই বিভাগের নির্দেশনা মেনেই তিনি দায়িত্বপালন করেছেন।

হুসনুল আজরা জানান, আক্কাছ আলীর নির্দেশ পালন করেছেন তিনি।

“আমি ওইসময় খণ্ডকালীন শিক্ষক ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিবিধান সম্পর্কে আমি সচেতন ছিলাম না। তিনি (আক্কাছ আলী) যেহেতু বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন, এ ব্যাপারে আমার চেয়ে তিনি অবশ্যই বেশি জানতেন”, বলেন তিনি।

ভুল তথ্য উপস্থাপন

আক্কাছ আলীর স্নাতকোত্তরের সনদে দেখা যায় যে, ২০১৭ সালের জুলাই মাসে তিনি ডিগ্রিপ্রাপ্ত হন।

সেখানে উল্লেখ রয়েছে, ২০১২ সালে বুয়েটের প্রথম দুটি সেমিস্টারে ৪-এর মধ্যে সিজিপিএ ৩.৫ এবং ২০১৩ সালে তৃতীয় সেমিস্টারে ৪-এর মধ্যে ৪ অর্জন করেন আক্কাছ।

আর ২০১৭ সালে বশেমুরবিপ্রবিতে তিনটি কোর্স এবং গবেষণায় সিজিপিএ ৪-এর মধ্যে ৪ পেয়ে উত্তীর্ণ হন তিনি।

তবে, বুয়েটের সাময়িক নম্বরপত্রে তার ফলাফলের ভিন্নতা দেখা গেছে।

সেখানে দেখা যায় যে, আক্কাছ আলী প্রথম সেমিস্টারে ৩, দ্বিতীয় সেমিস্টারে ৩.২৫, তৃতীয় সেমিস্টারে ৪ এবং চতুর্থ সেমিস্টারে ২.৫ পেয়েছেন।

তবে আক্কাছ আলী জানান যে, নিয়ম মেনেই তিনি পরীক্ষা দিয়েছেন।

নম্বরপত্রের গরমিলের ব্যাপারে কোনো ব্যাখ্যা না দিয়েই তিনি বলেন, “আমি চক্রান্তের শিকার হয়েছি।”

Comments

The Daily Star  | English

Disrupting office work: Govt employees can be punished within 8 days

The interim government has moved to amend the Government Service Act-2018 to allow swift disciplinary action against its employees who will be found guilty of disrupting official activities.

6h ago