দর্শকদের বিরক্তির কয়েকঘন্টা
বৃষ্টির মাত্রা খুব তীব্র নয়, কিন্তু থামারও তো কোন লক্ষণ নেই। একবার টিকেট কেটে ভেতরে ঢুকলে বাইরে যাওয়ারও কোন উপায় নেই। পশ্চিম পাশের খোলা গ্যালারিতে তাই পুরোটা সময়েই ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ভিজতে দেখা গেল কয়েকশত দর্শককে। ভিজে কাক হয়েও অপেক্ষা, যদি মন ভাল হয় আকাশের, যদি শুরু হয় খেলা। শহীদ জুয়েল স্ট্যান্ডের উপরের অংশ আছে শ্যাডো। সেখানকার দর্শকরা মাথা গোঁজার ঠাঁই পেলেও বিরক্তি কাটানোর পথ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। সেই পাঁচটায় মাঠে ঢুকেছেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও খেলার শুরুর নাম গন্ধ নেই। মাঠকর্মীরা কেউ মাঠে ঢুকলেই তাই ‘চার’, ‘ছক্কা’ হওয়ার মতো চিৎকার করে উঠছিলেন তারা। কেউ আবার দলবেঁধে গাইছিলেন গান। জমজমাট ফাইনাল দেখতে এসে এসবই ছিল বিনোদন!
শরতের ইলশে-গুঁড়ি বৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে বাংলাদেশ-আফগানিস্তানের মধ্যকার ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনাল। দু’দলেরই সময় কেটেছে আয়েশি হালে। রাত নয়টায় ম্যাচ পরিত্যক্ত হলে যৌথ চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হয় দু’দলকেই। কিন্তু বিপুল আগ্রহ নিয়ে আসা দর্শকরা পেয়েছেন কেবল যন্ত্রণা। আগের দিন বিশাল লাইনে দাঁড়িয়ে কেউ টিকেট কিনেছেন। কেউ দ্বিগুণেরও বেশি দামে কালোবাজারির কাছ থেকে কিনে নিয়েছেন বহু কাঙ্ক্ষিত প্রবেশ পত্র। খেলা না হওয়ার বিরক্তির সঙ্গে তাদের কারো কারো কণ্ঠে ঝরেছে রিজার্ভ ডে না থাকায় ক্ষোভ, টিকেটের টাকা ফেরত পাওয়ার নিয়ম না থাকাতেও কেউ কেউ জানিয়েছেন খেদ। বড় একটা অংশ অবশ্য বৃষ্টির আভাস দেখে টিকেট কেটেও আসেননি মাঠে।
একটি বহুজাতিক সংস্থায় কাজ করেন আলি আহমেদ মানিক। তীব্র যানজট পেরিয়ে এসেছেন গাজীপুর থেকে। খেলার জন্য অফিস কামাই করেছেন। নানামুখী আক্ষেপ তার কণ্ঠে, ‘গতকালও অফিস থেকে ছুটি নিয়ে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট কিনেছি। খেলা দেখব বলেও আজও অফিস থেকে ছুটি নিয়ে এসেছি। খেলা না হলে ভীষণ খারাপ লাগবে। টাকা তো যাবেই, সময়টাও নষ্ট হলো। রিজার্ভ ডে থাকা দরকার ছিল।’
তার বন্ধু মোহাম্মদ শামীমের অবস্থা আরও করুণ। কাউন্টারে টিকেট না পেয়ে সেনা কল্যাণ সংস্থায় চাকরি করা ভদ্রলোক টিকেট কেনেন কালোবাজারির কাছ থেকে। ৩০০ টাকার টিকেট কিনতে হয়েছে তাই ১০০০ টাকায়। খেলা হলে তবু সেসব গায়ে মাখতেন না, ‘একটু আনন্দ করার জন্য এসেছি। খেলা হলে কোন কষ্টই অনুভব হতো না। এখন চূড়ান্ত বিরক্ত লাগছে।’
শারমিন সুলতানা শ্যামলি থেকে এসেছেন পাঁচটা বাজার আগেই। কালোবাজারির কাছ থেকে টিকেট কিনেছেন তিনিও। ১ হাজার টাকার টিকেট কিনতে খসাতে হয়েছে আড়াইহাজার টাকা। টাকা নিয়ে তার চিন্তা নেই। কিন্তু খেলা না হওয়ায় জানালেন তীব্র হতাশা, ‘ভেবেছিলাম আজ বাংলাদেশ আফগানিস্তানকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হবে। এখন মনে হচ্ছে খেলা হবে না। না খেলে শিরোপার মীমাংসা ঠিক হলো না। একটা রিজার্ভ ডে দিলে কি এমন ক্ষতি হতো?’
টুর্নামেন্টের প্লেয়িং কন্ডিশনে রিজার্ভ ডে নেই। লিগ পর্বের বেশি পয়েন্ট পাওয়ার হিসেবও বিবেচিত নয়। যুগ্মভাবেই তাই দু’দল চ্যাম্পিয়ন। এমন ট্রফি চাননি কোন দর্শকই। পঞ্চাশোর্ধ্ব খাদেমুল করিমের অবশ্য সান্ত্বনা আছে, ‘কি আর করা যাবে, প্রকৃতির উপর তো কারো হাত নেই।’
মিরপুরেই থাকেন মিন্টু রায়। অনেকের মতো টিকেট কাটতে হ্যাপা পোহাতে হয়নি তার। কিন্তু বৃষ্টির যন্ত্রণায় ত্যক্ত ফিরে যাচ্ছিলেন বাড়ি, ‘খুব বিরক্ত লাগছে, এখন মনে হচ্ছে চলে যাই বাসায়।’ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার পর তার মতো অনেকেই মাঠ ছাড়তে উদ্যত হন। তাদের কাউকে কাউকে আবার আটকে রাখে হুট করে সাউন্ডবক্সে ভেসে আসা আইয়ুব বাচ্চুর কন্ঠ, ‘সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে’। পুরো গ্যালারি তখন কনসার্টের মঞ্চ। আফগানিস্তানের খেলোয়াড়দেরও হয়ত ঝিম ধরে থাকবে। দলবল নিয়ে তারাও ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতেই চক্কর দিলেন মাঠ। তাদের দেখে দর্শকদের অভ্যর্থনায় থাকল নানামুখী মাত্রা। বাংলাদেশ দল নেমে শুরু করল ফুটবল খেলা। মজা পেলেন দর্শকরা। এসব খুরচো বিনোদন তারা পেয়েছেন, কিন্তু যে বিনোদনের জন্য এসেছিলেন তা থেকেছে চূড়ান্ত বিরক্তি হয়ে।
Comments