ভুল কৌশল, ভুল অ্যাপ্রোচ নাকি সামর্থ্যের ঘাটতি?
ঘূর্ণি উইকেট বানিয়ে পেসারবিহীন একাদশ নামিয়েছিল বাংলাদেশ। চার বিশেষজ্ঞ স্পিনারের সঙ্গে অনিয়মিত আরও তিন স্পিনার দিয়ে আফগানিস্তানকে কাবু করার ফাঁদ পাতা ছিল চট্টগ্রামে। বাংলাদেশের স্পিনে খুব একটা কাবু হয়নি আফগানিস্তান। কিন্তু আফগানিস্তানের স্পিনে পুরো কুপোকাত হয়ে গেছে বাংলাদেশ। টেস্টে একেবারে নবিশ আফগানদের বিপক্ষে দলের এই অবস্থায় উঠছে কতগুলো প্রশ্নও।
চট্টগ্রাম টেস্টে আফগানদের ৩৪২ রানের জবাবে ৮ উইকেটে ১৯৪ রান নিয়ে শুক্রবার (৬ সেপ্টেম্বর) দ্বিতীয় দিনের খেলা শেষ করেছে সাকিব আল হাসানের দল। হাতে মাত্র ২ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে ১৪৮ রানে। আটে নামা মোসাদ্দেক হোসেন ৪৪ ও দশে নামা তাইজুল ইসলাম ব্যাট করছেন ১৪ রান নিয়ে। নবম উইকেটে ৪৮ রানের জুটিতে তারা গড়েছেন প্রতিরোধ। তবে ম্যাচ পরিস্থিতি বলছে, এই টেস্টের নিয়ন্ত্রণ এখন পুরোটাই আফগানদের হাতে।
স্বাভাবিক কারণেই মরিয়াভাবে জেতার কথা ভেবেই নেমেছিল বাংলাদেশ। তা করতে স্পিন শক্তিতে আস্থা রেখে পুরোপুরি টার্নিং উইকেট বানানো হয়। তাতে নিজেদের বোলাররা ফায়দা তুলতে পারেননি, কিন্তু আগে থেকেই যা আশঙ্কা করা হয়েছিল, সেই আফগান বিষেই নিজেরা হয়েছেন নীল।
উপমহাদেশের দল, যারা অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশের কাছে কিছুই না, কিন্তু স্কিলের দিক থেকে স্পিন শক্তিতে ঢের এগিয়ে, তাদের বিপক্ষে কেন অমন ঘূর্ণি পিচে খেলতে হলো? কোন পেসার ছাড়াই একঘেয়ে বৈচিত্র্যহীন বোলিং আক্রমণই বা রাখা হলো কেন? ম্যাচের দ্বিতীয় দিন পার হতেই দলের এসব পরিকল্পনা পড়ছে বড় প্রশ্নের মুখে।
যাদের উপর ভরসা করা হয়েছিল, সেই স্পিনাররাই বা কতটা দিতে পারলেন, তাও জেরার মুখে পড়ার মতো। এক তাইজুল ছাড়া ধারাবাহিক জায়গায় বল করেননি কেউই। তাও বোলিংয়ে না হয় রান কিছুটা বেশি বেরিয়েছে। ওই রান কি নিজেদের অতি চেনা পিচে নিতে পারবে না বাংলাদেশ?
আফগান রিস্ট স্পিনারদের বিপক্ষে কোন অ্যাপ্রোচে খেললে সফল হওয়া যাবে, বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে দেখা যায়নি তা নিয়ে কোন পরিকল্পনার ছাপ। ভুল শট বাছাই, অদ্ভুত আগ্রাসী মেজাজ রেখে ব্যাট চালানো- সবই গিয়েছে বাংলাদেশের বিপক্ষে।
সব ছাপিয়ে বড় প্রশ্ন উঠেছে, সাদা পোশাকে কি তবে বাংলাদেশের সামর্থ্যই এরকমই? দিনের ছবি যদি একটু কাঁটাছেড়া করা যায়, তাতে এমন গুরুতর প্রশ্নও ঠিক উড়িয়ে দেওয়ার উপায় কোথায়!
দিনের প্রথম সেশনে ৭১ রান দিয়ে আফগানদের বাকি ৫ উইকেট তুলে স্বস্তি মিলেছিল। কিন্তু নিজেরা ব্যাট করতে নেমেই সেই স্বস্তি উধাও। লাঞ্চের আগে ইনিংস শুরু করেই সাদমান ইসলামকে খুইয়েছিল বাংলাদেশ।
লাঞ্চ থেকে ফিরে বেশ কিছুক্ষণ ব্যাট করেছেন সৌম্য সরকার ও লিটন দাস। আফগান বোলারদের নিখুঁত লাইন-লেন্থের কারণে দুজনেই ছিলেন গুটিয়ে। থিতু হতে অনেকটা সময় লেগেছে তাদের। রিস্ট স্পিনার জহির খান আসার পর অহরহ শর্ট বল পেয়ে হাত খোলেন লিটন। তাদের ১৮ ওভারের জুটি থামে ৩৮ রানে। দৃঢ়তা দেখানো সৌম্য ৬৬ বল খেলে ১৭ রান করে এলবিডব্লিউর ফাঁদে পড়েন মোহাম্মদ নবির বলে।
শুরুর নড়বড়ে ভাব সামলে চনমনে হয়ে উঠছিলেন লিটন। খেলছিলেন সাবলীলভাবে। কিন্তু আউট হয়েছেন খুব দৃষ্টিকটু শটে। রশিদ খানের সোজা বল বুঝতে না পেরে পুল করে খুইয়েছেন স্টাম্প।
রশিদ এরপর একই ওভারে ভেঙে দেন বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের মেরুদণ্ড। সাকিবকে এলবিডব্লিউ করার পর মুশফিক ফেরেন তার বলে শর্ট লেগে ক্যাচ দিয়ে। যদিও চা বিরতির ঠিক আগে এই আউট নিয়ে আছে বিতর্ক। রশিদের স্পিন মাটিতে নামাতে গিয়ে বুটে লেগে শর্ট লেগ ফিল্ডারের হাতে যায়। বল বুটে নাকি মাটিতে লেগে ক্যাচ উঠেছে, তা স্পষ্ট হয়নি। কিন্তু মাঠের আম্পায়ার সফট সিগন্যালে আউট দিলে টিভি আম্পায়ার যথেষ্ট প্রমাণ না পাওয়ায় তা বদলাতে পারেননি।
চা বিরতির পর এসেই খানিক পর রশিদের গুগলি ধরতে না পেরে মাহমুদউল্লাহ অফ স্টাম্প গড়াগড়ি খায় মাটিতে। তখন জেগে ওঠে ফলোঅনে পড়ার শঙ্কাও। এই সময়ে মোসাদ্দেক হোসেনকে নিয়ে ওয়ানডে মেজাজ নেন মুমিনুল হক। দ্রুত রান বাড়াতে মন দেন তারা। স্রোতের বিপরীতে ফিফটি পাওয়া মুমিনুলে বাড়ছিল আশা। কিন্তু তার আগ্রাসী মেজাজ থাকেনি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনায়। কেবল উড়াতেই চাইবার কারণে ডানা ভাঙতেও দেরি হয়নি। নবির বলে মিড অনে ক্যাচ দিয়ে ইতি টানেন ইনিংসের।
মেহেদী হাসান মিরাজ নিজের বোলিংয়ের মতো ব্যাটিংয়েও ছিলেন এলেবেলে। কোন মেজাজে খেললে ভালো হবে তা বুঝতে বুঝতেই ফেরেন ১১ রান করে।
মোসাদ্দেককে অতিরিক্ত ব্যাটসম্যান হিসেবে এই টেস্টে খেলিয়েছিল বাংলাদেশ। সেই মোসাদ্দেকই দিন শেষে দিলেন একটু শ্বাস ফেলার অবস্থা। কিন্তু অতিরিক্ত ব্যাটসম্যান খেলিয়ে টেলএন্ডার নিয়ে যদি লড়াই করতে হয়, সেটা নিশ্চয়ই কাম্য নয়!
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
(দ্বিতীয় দিন শেষে)
আফগানিস্তান প্রথম ইনিংস: ১১৭ ওভারে ৩৪২ (ইব্রাহিম ২১, ইহসানুল্লাহ ৯, রহমত ১০২, শহিদি ১৪, আসগর ৯২, নবি ০, আফসার ৪১, রশিদ ৫১, কাইস ৯, ইয়ামিন ০, জহির ০*; তাইজুল ৪/১১৬, সাকিব ২/৬৪, মিরাজ ১/৭৩, নাঈম ২/৪৩, মাহমুদউল্লাহ ১/৯, সৌম্য ০/২৬, মুমিনুল ০/৯, মোসাদ্দেক ০/১)
বাংলাদেশ প্রথম ইনিংস: ৬৭ ওভারে ১৯৪/৮ (সাদমান ০, সৌম্য ১৭, লিটন ৩৩, মুমিনুল ৫২, সাকিব ১১, মুশফিক ০, মাহমুদউল্লাহ ৭, মোসাদ্দেক ব্যাটিং ৪৪* , মিরাজ ১১, তাইজুল ব্যাটিং ১৪*; ইয়ামিন ১/২১, নবি ২/৫৩, জহির ০/৪৬, রশিদ ৪/৪৭, কাইস ১/২২)।
Comments