দেশ কি ‘মুখ চেপে ধরা’ মিন্নিদের নয়?
রিফাত একটি সংখ্যা, মিন্নি একটি নাম।
সুস্থ মিন্নিকে বাড়ি থেকে ডেকে নেওয়া হয়েছে, স্বামী রিফাত হত্যার বিষয়ে তথ্য জানার কথা বলে। গ্রেপ্তার-রিমান্ডের পর মিন্নি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেন না। বাবার কাছে বলেছেন, ‘রিমান্ডে কেমন নির্যাতন করেছে, বুঝে নাও।’
রিমান্ডে আসলে কী হয়? সাধারণভাবে জানি জিজ্ঞাসাবাদ হয়। আমরা পুরনো কিছু মনে রাখি না। বা এত এত নতুন ঘটনা পুরনোকে মনে রাখতে দেয় না। কারও কী মনে আছে রুবেলের কথা? সংখ্যায় পরিণত হওয়া মৌচাকের সেই রুবেলের কথা। ১৯৯৮ সালের ২৩ জুলাই ডিবি পুলিশ নিরীহ রুবেলকে ধরে পিটিয়ে হত্যা করেছিলো। সেই সময়ের ডিবির ডিসি সৈয়দ বজলুল করিম বলেছিলেন, ‘চা-বিস্কিট খাইয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে কেউ অপরাধ স্বীকার করবে না।’
মিন্নিকেও হয়ত ‘চা-বিস্কিট খাইয়ে’ জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি।
রুবেল হত্যা মামলায় ২০০২ সালে বিচারিক আদালত এসি আকরামসহ ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন। তৎকালীন সরকার রুবেল হত্যা তদন্তের জন্য বিচারপতি হাবিবুর রহমান খানের সমন্বয়ে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত শেষে কমিটি ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের পক্ষে কয়েকটি সুপারিশ করে। কিন্তু সেই সুপারিশ বাস্তবায়নের উদ্যোগ কখনও নেওয়া হয়নি।
সুস্থ মিন্নি কেনো পুলিশ হেফাজতে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেন না, বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়।
রুবেল-ত্বকী-নুসরাত-তনু-সাগর-রুনীরা শুধুই সংখ্যা, তার চেয়ে বেশি কিছু নয়। মিন্নির সৌভাগ্য এখনও সংখ্যায় পরিণত হননি।
২.
মিন্নি ছিলো স্বামী রিফাত হত্যা মামলার প্রধান সাক্ষী। এখন স্বামী হত্যার আসামি। অন্য সব ক্ষেত্রের মতো এক্ষেত্রেও মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। কেউ বলছেন মিন্নি ‘অপরাধী’ কেউ বলছেন ‘অপরাধীদের’ বাঁচানোর জন্যে মিন্নিকে ফাঁসানো হচ্ছে।
মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোরের অভিযোগ ‘...ওকে (মিন্নি) নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি আদায় করা হলো। কেনো হলো? কারণ একটাই। আর সেটা হচ্ছে তার (এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু) ছেলে সুনাম দেবনাথ (জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক), মাদক সম্রাট। ছেলেকে সেভ করার জন্য আমার মেয়ে বলি হয়ে যাচ্ছে।’ (কালের কন্ঠ, ২২ জুলাই ২০১৯)।
বরগুনার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন বলেছেন, ‘মিন্নির পরিকল্পনায় রিফাত শরীফ খুন হন। তিনি আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে সব স্বীকার করেছেন।’ (যুগান্তর, ২২ জুলাই ২০১৯)।
সত্য কোনটি? তা জানা যেতে পারে তদন্তের মাধ্যমে। যদি তদন্ত সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ হয়। সামগ্রিক ঘটনার প্রেক্ষিতে প্রশ্ন এসেছে, জেলা পুলিশের করা তদন্ত বিশ্বাসযোগ্যতা পাবে কী-না? সিআইডি বা র্যাবকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়ার দাবি তুলেছেন অনেকে। কারণ পুলিশ ইতিমধ্যে একটি পক্ষ হিসেবে পরিচিতি পেয়ে গেছে।
বলে রাখা জরুরি, রিফাত হত্যা মামলায় মিন্নিকে আসামি করার ঘটনায় নাটকীয়তা-বিস্ময়-রহস্যের সব উপাদান বিদ্যমান। এর অর্থ এই নয় যে, এমন কিছু ঘটতে পারে না। সত্য এর চেয়েও কঠিন হতে পারে। চাঞ্চল্যকর নাটকীয় দৃশ্যপট পরিবর্তনের নজীর আছে। সুষ্ঠু তদন্তের মধ্যম যে কোনো বিস্ময়কর সত্য প্রকাশিত হতে পারে। মিন্নির ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠেছে ‘সুষ্ঠু’ তদন্তের বিষয়টি নিয়ে।
ক. মিন্নির রিমান্ডের দ্বিতীয় দিনে বরগুনার পুলিশ সুপার প্রথমে ডেইলি স্টারের সঙ্গে টেলিফোন সাক্ষাৎকারে এবং পরে সংবাদ সম্মেলন করে বললেন যে, ‘মিন্নি স্বীকার করেছে রিফাত হত্যায় তার জড়িত থাকার কথা।’
খ. পুলিশ সুপার আরও বললেন, ‘অন্যান্য আসামিরাও স্বীকারোক্তিতে মিন্নির জড়িত থাকার কথা বলেছে।’
গ. তার পরের দিন মিন্নি আদালতে জবানবন্দি দিয়ে হত্যার সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছেন। গণমাধ্যমে সেই সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
গ্রেপ্তারের পর এখন পর্যন্ত মিন্নির একটি কথা শোনা গেছে। প্রথম দিন আদালতের প্রশ্নের উত্তরে মিন্নি বলেছিলেন ‘আমি হত্যার সঙ্গে জড়িত নই।’ এছাড়া সরাসরি মিন্নির মুখ থেকে আর কোনো কথা শোনা যায়নি। মিন্নির কথা পুলিশের মুখ দিয়ে শোনা গেছে।
তার প্রেক্ষিতে তিনটি প্রশ্ন:
ক. রিমান্ডে থাকা অবস্থায় আসামি কী বলেছেন, তা পুলিশ বলে দিতে পারে কী-না?
খ. সুস্থ মিন্নি পুলিশ হেফাজতে থেকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেন না কেনো (মিন্নির বাবার অভিযোগ অনুযায়ী)?
গ. ‘স্বেচ্ছায়’ আদালতে জবানবন্দি দিয়ে বের হওয়ার সময় মিন্নি কিছু বলতে চাইছিলেন। দুই নারী পুলিশ কেনো তার ‘মুখ চেপে’ ধরলেন?
প্রথম প্রশ্নের উত্তরে পুলিশ সুপার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘বলা ঠিক না’। যা ‘ঠিক নয়’ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল সদস্য হয়েও তিনি তা করেছেন।
মিন্নির বক্তব্য তার বাবার মুখ দিয়ে যা শোনা গেলো, রিমান্ডে মিন্নিকে শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রচণ্ড নির্যাতন করা হয়েছে। যার ফলে মিন্নি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেন না।
মিন্নি যদি আদালতে ‘স্বেচ্ছায়’ জবানবন্দি দিয়ে থাকেন, তবে আদালতের বাইরে তার ‘মুখ চেপে’ ধরা হলো কেনো? যুক্তি হতে পারে, রিমান্ডের আসামি আইন অনুযায়ী এভাবে কথা বলতে পারেন না। আইন অনুযায়ী যা পুলিশও বলতে পারে না, তা পুলিশ সুপার বলেছেন। পুলিশ সুপার যদি আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কথা বলতে পারেন, মিন্নিকে কথা বলতে দিলে সমস্যা কী ছিলো? আদালতে যদি মিন্নি ‘স্বেচ্ছায়’ স্বীকার করে থাকেন, বাইরেও তো তার স্বীকারই করার কথা।
মিন্নি কী বলতে চেয়েছিলেন আমরা জানি না। আমরা স্মরণ করতে পারি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের রিমান্ড শেষে আদালতে আনার কথা। ‘আমাকে আঘাত করা হয়েছে। রক্তে ভেজা পোশাক ধুয়ে আবার পরানো হয়েছে’ এ কথা বলার সময় শহিদুল আলমের ক্ষেত্রে মুখ চেপে ধরার ঘটনা ঘটেনি। জাতীয়-আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও তার সামাজিক অবস্থান হয়তো এক্ষেত্রে কিছুটা ভূমিকা রেখেছে। মিন্নির তো আর সেই অবস্থান নেই!
৩.
অন্যান্য আসামিরা স্বীকার করেছে যে, মিন্নি তার স্বামী রিফাত হত্যার পরিকল্পনায় ছিলো। অন্যান্য আসামিরা কি শুধু এই একটি তথ্যই দিয়েছে, আর কিছু স্বীকার করেনি?
নয়ন বন্ড গ্রুপের সন্ত্রাসীরা কি রিমান্ডে তাদের গডফাদারের নাম বলেনি? পুলিশ কি রিমান্ডে তা জানতে চেয়েছিলো? কোন জনপ্রতিনিধির সন্তানের মাদক ব্যবসার সূত্র ধরে নয়ন বন্ডের জন্ম, তা কি পুলিশের কাছে স্বীকার করেনি অন্যান্য আসামিরা? পুলিশ কেনো নয়ন বন্ড সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতো না, তা পুলিশ সুপার জানেন না?
নয়ন বন্ড গ্রুপের সন্ত্রাসীদের জামিনের ব্যবস্থা কারা করতো, তা কি পুলিশ জেনেছে?
এক প্রভাবশালী লিখে আহ্বান বা ‘নির্দেশ’ দিলেন, কোনো আইনজীবী যেনো মিন্নির পক্ষে না দাঁড়ায়। তা ঘটতেও দেখা গেলো। পুলিশ কি বিষয়টি তদন্ত করছে?
প্রভাবশালী সন্তান মানববন্ধন করে মিন্নিকে গ্রেপ্তার করতে বলছেন, নেপথ্যের কারণ কী? পুলিশ কী তা বিবেচনায় নিয়ে তদন্ত করছে?
মিন্নির আইনজীবী মিটিং করছেন প্রভাবশালী এমপি ও তার সন্তানের সঙ্গে। পুলিশের দৃষ্টিতে বিষয়টি কী স্বাভাবিক?
৪.
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই বলেছেন, নুসরাতের বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করলে, তার চরিত্র নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে যেতো। মিন্নির ক্ষেত্রে যা হয়েছে। প্রভাবশালীরা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিন্নির চরিত্রহনন করা হয়েছে। যে কোনো ঘটনার সঙ্গে একজন নারী সম্পৃক্ত থাকলে বা করা গেলে, প্রসঙ্গ ভিন্ন দিকে নিয়ে যাওয়া সহজ হয়।
সর্বত্রই সিরাজদ্দৌলাদের রাজত্ব। একেক জায়গায় তাদের একেক নাম। কোথাও সিরাজদ্দৌলাদের নাম আলোচনায় আসে, কোথাও ‘প্রভাবশালী’ বলে পাশ কাটাতে হয়। দেশ তো আসলে সিরাজদ্দৌলা বা প্রভাবশালীদের। দেশটি কি নুসরাত বা ‘মুখ চেপে’ ধরা মিন্নিদেরও?
প্রশ্নের উত্তরে কী হ্যাঁ বলা যায়?
ভিডিও ফুটেজ দেখেও এখন আবিষ্কার করার চেষ্টা চলছে, ‘মিন্নি নয়ন বন্ডকে জড়িয়ে ধরেছিলো, কিন্তু নয়ন বন্ড তাকে আঘাত করেনি। সুতরাং আগে থেকেই নয়নের সঙ্গে মিন্নির বোঝাপড়া ছিলো।’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন আলোচনা চলছে। একই সঙ্গে আলোচনা, মানুষ দাঁড়িয়ে দেখলো, কিন্তু কেউ রিফাতকে বাঁচাতে এগিয়ে গেলো না। মিন্নির বাঁচানোর চেষ্টাও যদি ‘সেভাবে’ না হয়, এরপর আর কেউ বা আর কোনো মিন্নিও কি স্বজনকে বাঁচাতে যাবেন!
ভিডিও ফুটে দেখে ‘প্রভাবশালী’রা যদি আবিষ্কার করেন ‘সেভাবে’ চেষ্টা করেননি। রাস্তায় চলাচলকারী কেউ বাঁচানোর চেষ্টা করবেন, না ভাববেন ‘বিপদ’ হতে পারে!
৫.
হত্যা বা অন্যায়ের ন্যায় বিচার হওয়া জরুরি। কে জড়িত, তা বলে বিতর্কের উপাদান যোগান দেওয়া প্রশাসনের কাজ নয়। তাতে তদন্তের আগেই, তদন্তের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে যায়। রিফাত হত্যার ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই তা দৃশ্যমান। মিন্নি জড়িত থাকলে অবশ্যই তাকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। তা করতে হবে বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের মাধ্যমে, বিতর্কে বা প্রশ্নের জন্ম দিয়ে নয়।
স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, জনপ্রতিনিধি, আইনজীবী সবাই যেন একটি পক্ষ হয়ে কথা বলছেন। মনে হচ্ছে মিন্নি ন্যায্যতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এই মনে হওয়াটাকেই বলে পাবলিক পারসেপশন। মিন্নি যদি অপরাধী হয়েও থাকেন (প্রমাণের আগে বলা যাবে না) তার ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। পুলিশ নিজে অভিযুক্ত করে যে মিন্নির ‘মুখ চেপে’ ধরছে, দেশটি তার-তাদেরও।
Comments