‘জিতেছে তো বৈচিত্র্যময় বহু সংস্কৃতির মেলবন্ধন’
‘আল্লাহ আমাদের সঙ্গে ছিলেন, আমি আদিলের সঙ্গে কথা বলছিলাম, সে বলেছে আল্লাহ অবশ্যই আমাদের সঙ্গে ছিলেন। আমি বললাম ভাগ্য আমাদের সহায় ছিল। এটা আমাদের দলের আকর্ষণীয় ব্যাপার যে বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় পরিবেশ আর নানান সংস্কৃতির দেশ থেকে এসে আমরা একসঙ্গে খেলছি। সেকারণে সময়টা বেশ উপভোগ্য।’ বিশ্বকাপ জিতে সংবাদ সম্মেলনে ইংল্যান্ড অধিনায়ক ইয়ন মরগ্যান বললেন এরকম কিছু।
পুরো ইংল্যান্ড ঘুরলেই মরগ্যানের কথাটার সত্যতা গাঢ় হয় আরও। নানান দেশের মানুষ আর তাদের সংস্কৃতিকে যে আত্তীকরণ করে নিয়েছে এই দেশ। তাদের নিয়েই যাচ্ছে এগিয়ে, নানান ক্ষেত্রে উড়াচ্ছে বিজয় কেতন।
অবিশ্বাস্য এক ফাইনাল ম্যাচের ঘোরে আচ্ছন্ন থাকায় এসব কিছু নিয়ে ভাবার সময় হয়নি। গোটা একদিন পার হওয়ার পরও বিশ্বকাপ ফাইনালের ঘোর কাটানো গেল না। মাথার মধ্যে কেবলই ঘুরছিল নিউজিল্যান্ড, স্টোকস, উইলিয়ামসন। সেই ঘোর কাটাতেই লন্ডনের রাস্তায় ঘুরতে বের হওয়া। কিং ক্রস রেল স্টেশন থেকে বেরিয়ে খানিকটা হাঁটলেই ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকার অফিস। ব্রিটেন তো বটেই, পুরো বিশ্বেরই প্রভাবশালী গণমাধ্যম। বন্ধুপ্রতিম বড় ভাই মাহবুবুর রহমানের আমন্ত্রণে সোমবার বিকেলে ওখানে যাওয়ার সুযোগ ঘটল। এক কর্মশালায় যেখানে জড়ো হয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা সাংবাদিকরা। খেলা কাভার করতে বাংলাদেশ থেকে আসা সাংবাদিক জেনেই অবধারিত ভাবে আলাপ গড়াল ক্রিকেটে।
‘কি একটা খেলা হলো...অবিশ্বাস্য, আমি তো উত্তেজনায় কাঁপছিলাম’। কর্মশালার প্রজেক্ট কোর্ডিনেটর সাংবাদিকতার শিক্ষক ভদ্রমহিলা ইলিন মূলত অ্যান্টিগার মানুষ। অভিবাসী হয়ে এখন যুক্তরাজ্যের নাগরিক। আলাপের শুরুটাই তাই করলেন এভাবে। তারছেলে মিডলসেক্স কাউন্টি ক্লাবে ক্রিকেট খেলে। খেলাটা ভালোই বুঝেন। কিন্তু আরও যারা আছেন তাদের অনেকেই ক্রিকেট বোঝেন না।
কুর্দিস্তান, কিরগিজিস্তান, রাশিয়া, স্পেনের মানুষদের ক্রিকেট বোঝার কোন কারণও নেই। কিন্তু ক্রিকেট না বুঝলেও রোববার বিশ্বকাপ ফাইনালে তোলপাড় করা কিছু একটা যে হয়েছে তা সবাই টের পেয়েছেন। কেউ বন্ধুর কাছে শুনেছেন, কেউ পরিচিত মানুষের উত্তেজনা দেখে কান পাততে গিয়ে খোঁজ পেয়েছেন। লন্ডনে একই দিনে উইম্বলডনের ফাইনাল ছিল। সিলভারস্টোনে ছিল ফরমুলা ওয়ানের রেস। তবু ক্রিকেটটা সেদিন সবচেয়ে আলোড়ন তুলেছে ইংল্যান্ড-নিউজিল্যান্ডের রোমাঞ্চকর ম্যাচের জন্যই। যারা বুঝেন না তাদের কানেও তাই এসেছে ক্রিকেটের ঝাঁজ।
দ্য টেলিগ্রাফ হেডিং দিয়েছে ‘হু সেইড ক্রিকেট ইজ এ বোরিং গেম’। এই কথারই অনুরণন মিলল আরও দুএক জায়গায়। এদেশে উচ্ছ্বাসের ধরণ ভিন্ন। আমাদের দেশের মতো মিছিলে সরগরম হয়নি সত্যি, সেদিন যেমন ট্রাফারলগার স্কয়ারেই হয়েছে কয়েক হাজার মানুষের উৎসব। বাকি সব জায়গা সুনসান। কিন্তু একটু টোকা মারলেই বুঝতে পারবেন, ক্রিকেট ম্যাচের রোমাঞ্চটা তাদের ছুঁয়েছে কত। কিন্তু এদেশের অভিবাসী মানুষদের সবচেয়ে বেশি স্পর্শ করেছে আসলে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের জয়গান।
ফুটবলে ‘সুপার ঈগল’ বলে খ্যাত নাইজেরিয়ার সাংবাদিক আলি বললেন সবচেয়ে সুন্দর কথা, ‘জানেন, এই ফাইনালে সবচেয়ে সুন্দর ব্যাপারটা কি? এটা তো আসলে ইংল্যান্ডের জয় নয়, জিতেছে তো বৈচিত্র্যময় বহু সংস্কৃতির মেলবন্ধন।’
আসলেই তো তাই। ইংল্যান্ডকে সেদিন যিনি বিশ্বকাপ জেতালেন তিনি তো নিউজিল্যান্ডের মানুষ। বেন স্টোকসের জন্ম, বেড়ে উঠাও সেদেশে। বাবা-মা এখনো নিউজিল্যান্ডেই বসবাস করেন। অধিনায়ক মরগ্যান আইরিশ, আদিল রশিদের শেকড় পাকিস্তানে, ওইদিন না খেলা মঈন আলিরও তাই। সুপার ওভারের সুপার হিরো জোফরা আর্চার বার্বাডোজের বংশোদ্ভূত, জেসন রয়ের পূর্বপুরুষ নাকি দক্ষিণ আফ্রিকান। অর্থাৎ ইংল্যান্ডকে তো আপনি বৈশ্বিক দলই বলবেন।
মঈন আলি যেমন বলছিলেন, ‘এই বৈচিত্র্যই আমাদের বড় শক্তি, এই কারণও বিশ্বকাপ জিততে রেখেছে ভূমিকা।’
আমাদের উপমহাদেশে জাতীয়তাবাদের তিক্ততা, সাম্প্রদায়িক উগ্রতার কথা ভাবলে এমন ছবি অবিশ্বাস্যরকমের উদারতার স্বস্তি দেয়। অবাক করা ব্যাপার হলো দেশে তিক্ত সংকীর্ণ গণ্ডিতে আটকে থাকারাও এসব দেশে এসে এমন উদারতার প্রশংসা করেন। এবার বিশ্বকাপ তাই যেন সংকীর্ণতার গণ্ডি ডিঙিয়ে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যময় জীবনের জয়গানও যে জানিয়ে রাখল।
Comments