শুধু সুখ চলে যায়
“আমরা দু’জন একটি গাঁয়ে থাকি, এই আমাদের একটিমাত্র সুখ।
তাদের গাছে গায় যে দোয়েল পাখি, তাহার গানে আমার নাচে বুক।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার মতো এরকম সুখ কি আর আছে আমাদের জীবনে? না নেই, থাকার কথাও না। কারণ এই সমাজ ক্রমশ আমাদের জীবনকে প্রতিযোগিতার মুখে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। আর আমরা যত বেশি এই প্রতিযোগিতার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছি, যত বেশি চাহিদা সৃষ্টি করছি, যত বেশি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছি--ততই আমাদের জীবন থেকে সুখ হারিয়ে যাচ্ছে।
জীবনটা এখন অন্যরকম। যার এক লাখ টাকা আছে, সে পাঁচ লাখ টাকা আয়ের জন্য কাজ করছে। যার ১০০ কোটি টাকা আছে, সে হাজার কোটি টাকা আয়ের স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে। যার দুটো ব্যবসা আছে, সে আরও চারটি ব্যবসা করার চেষ্টা করছে। যার মাথা গোঁজার একটি বাড়ি আছে, সে চাইছে আরও চারটি বাড়ির মালিক হতে।
খুব ছোট একটা উদাহরণ দেই, যা দিয়ে বোঝা যাবে আমরা জীবনটাকে কতটা ভোগবাদী করে তুলেছি--এই আমরাই একসময় ছাই দিয়ে থালা-বাসন মাজতাম। এখন কমপক্ষে তিনটি সাবান দিয়ে বাসন-কোসন পরিষ্কার করি। আগে একটা সাবান দিয়ে গোসল করতাম, একটা দিয়ে কাপড় ধোয়ার কাজ সারতাম। এখন হাত, পা, মুখ, শরীর ও চুল ধোয়ার জন্য কমপক্ষে ছয়টি আলাদা সাবান ব্যবহার করি। কাপড় ধোয়ার জন্য দুইটি, টয়লেট ও মেঝে পরিষ্কারের জন্য তিন ধরনের সাবান ব্যবহার করি। তারমানে এখন প্রায় ১৩/১৪ রকমের সাবান ঢুকে বাড়িতে। এমনকি গ্রামেগঞ্জেও সচ্ছল পরিবারগুলোতেও মোটামুটি একই অবস্থা। শহরের বস্তিবাসীদের জীবনেও দেখা যাবে প্রয়োজনীয় জিনিসের বদলে প্রচুর অ-দরকারি ভোগ্যপণ্য ব্যবহার হচ্ছে।
আমরা হয়তো বলতে পারি মানুষ নিজের অবস্থার উন্নতি চাইবে এবং এর পেছনে ছুটবেই। কিন্তু সমস্যাটা হয় তখনই, যখন আমরা সাধ্যের বাইরে গিয়ে কোনকিছু বাগানোর চেষ্টা করি। তখন আমাদের সঠিক পথ ছেড়ে, বেঠিক পথ ধরতেই হয়। . সবাই তো চেষ্টা ও পরিশ্রম করে চাহিদার এই ঊর্ধ্বগতিতে তাল মেলাতে পারে না, তখনই তাদের দরকার হয় টাকা আয়ের জন্য অন্যকোনো উপায় খুঁজে বের করা।
বাংলাদেশের মতো একটি দেশে যেভাবে কোটিপতি বা ধনী লোকের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়, এই ধনিক গোষ্ঠীর একটা বড় অংশ সৎ পথ ধরে আসেনি। কারণ তাদের আয় এত বেশি যে তারা এর উৎস দেখাতে পারছে না। আর পারছে না বলেই প্রতিবছরের বাজেটে সরকারকে কালো টাকা সাদা করার একটি সুযোগ রাখতে হচ্ছে। বাড়ি-জমি অবৈধ সবকিছুকে হালাল করার একটা উপায় বের করতে হচ্ছে। নতুবা এসব টাকা পাখা মেলে উড়ে বিদেশে চলে যাবে। আর যেহেতু মানুষ তাদের অর্জিত কালো টাকাকে সাদা করার একটা উপায় পেয়েই যায়, তখন তারা অনায়াসে পথে-বিপথে টাকা আয় করে যেতে থাকে।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আমরা দেখেছি কতিপয় মানুষের আয় কোথায় গিয়ে ঠেকেছিল। তিতাস গ্যাসের মিটার রিডার থেকে শুরু করে বন বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, আমলা, রাজনীতিবিদরা শ শ, হাজার কোটি টাকার মালিক। অবৈধ আয়ের পরিমাণ এত বেশি ছিল যে বালিশ-তোষকের ভেতরেও টাকা রাখতে হয়েছিল তাদের। এই হাজার কোটি টাকার খবর দেখে দেখে জনগণের চোখ ছানাবড়া হয়ে গিয়েছিল। এই তো এবারের বাজেটের পরও বলা হয়েছে শীর্ষ ৩০০ প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫০ হাজার ৯৪২ কোটি টাকা। এই ঋণের টাকা কবে শোধ হবে, আদৌ হবে কিনা, কেউ জানি না। অথচ এগুলো সব জনগণের টাকা।
সে যাক, কে কিভাবে টাকা হালাল করবে, সেটা তাদের নিজেদের ব্যাপার। সরকার ও রাষ্ট্র যদি তা মেনে নেয়, তাহলে তো আমাদের বলার কিছু থাকে না। আমরা শুধু ক্ষুব্ধ হই তখন, যখন কোনো কাজ করাতে গিয়ে আমাদের ঘুষ দিতে হয়, যখন দেখি উন্নয়ন ব্যয়ের একটা বড় অংশ উন্নয়ন কাজে খরচ না হয়ে অন্যের পকেটস্থ হয়ে যাচ্ছে, যখন দেখি সরকারি অর্থ নয় ছয় হচ্ছে। বহু মানুষ কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক হচ্ছে অথচ তাদের আয়ের দৃশ্যমান উৎস নেই। এই টাকার জন্য কোন জবাবদিহিতাও নেই। এরপর যখন দেখি আমাদের দেশ প্রতিবছর দুর্নীতিতে শীর্ষ হচ্ছে, তখন মনঃকষ্ট ১০ গুণ বেড়ে যায়। দেশের সিংহভাগ লোক যে চুরি বা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নয়, তাদের কেন এই অপমানের বোঝা বইতে হবে?
আমাদের বাজেটে টাকা খরচের হার প্রতিবছরই বাড়ছে। বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও সরকারি খরচের পেছনে ব্যয় বাড়লেও দরিদ্র মানুষ এর কতটা ভাগ পাচ্ছে, সে নিয়ে অনেক কথা আছে। টিআইবির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন বাড়লেও দুর্নীতি হ্রাসে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি। তাহলে ব্যাপারটা এই দাঁড়ালো যে, মানুষ অভাবে দুর্নীতি করে না, করে স্বভাবে। যে কারণে তাদের বেতন ভাতা বাড়িয়ে দেওয়া হল, সেই একই কারণ বজায় থাকলো। মানে দুর্নীতি চলমান। শেষ পর্যন্ত হাইকোর্টকেও প্রশ্ন করতে হয়েছে -বেতন ভাতা দ্বিগুণ করে দেওয়ার পরও কেন দুর্নীতি কমেনি?
এত দুর্নীতির পরও, আমরা যারা সাধারণ মানুষ, তারা শুনছি যে আমাদের দেশ উন্নয়নের পথে হাঁটছে, জিডিপি বাড়ছে, মানুষের আয় বাড়ছে, দরিদ্র লোকের সংখ্যা কমছে। আমাদের নীতিনির্ধারকরা বলেছেন দেশে মাত্র ৫০/৬০ লাখ মানুষ হতদরিদ্র। তাদের কথা সত্যি হলে আমরা খুশি। আমরা দেখছি সরকার বলছে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। এই প্রবৃদ্ধির হার যদি সত্যি এমন থাকে, তাহলে তো দেশের লোকের আর্থিক অবস্থা আরও ভালো হওয়ার কথা।
ধনীরা যেভাবে আরও ধনী হচ্ছে, বাকি জনগণের পকেট কিন্তু সেভাবে ভরছে না। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? এর উত্তর পেলাম সেদিন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ইব্রাহীম খালেদ সাহেবের এক সাক্ষাৎকারে--তিনি বলেছেন, উন্নয়ন তো হচ্ছে। যে প্রবৃদ্ধির কথা সরকার বলছে, সেটিও তো হচ্ছে। কিন্তু এই জিডিপি থেকে যে টাকা আসছে তার সুষম বণ্টন হচ্ছে না। যে জাতীয় আয় যোগ হচ্ছে, তা শতকরা মাত্র পাঁচ জন মানুষের হাতে আসছে। সেই পাঁচ ভাগ মানুষ প্রতিবছর আরও বড়লোক হচ্ছেন। বাকি ৯৫ শতাংশের কাছে সেই টাকা আসছে না। অর্থাৎ টাকা ওপর থেকে নিচের দিকে নামছে না।
ইব্রাহিম খালেদ আরও বলেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড হলো সুষম বণ্টনের দেশ। সবচেয়ে অসম বণ্টনের দেশ হলো আমেরিকা। আমরা আমেরিকার মডেল অনুসরণ করছি। তাই স্বাভাবিকভাবেই গরিব আরও গরিব হচ্ছে। আমাদের জন্য আসলেই এই তথ্য ভয়ঙ্কর। সম্পদ আয় করে কী লাভ, যদি না সেই সম্পদ দেশের অধিকাংশ মানুষের কাজে লাগে। এই সম্পদহীনতা, অপ্রাপ্তি, অস্বাচ্ছন্দ্য, অসম সামাজিক প্রতিযোগিতা, অনেক বেশি পাওয়ার তাগিদ, ধনিক গোষ্ঠীর চরম ভোগবাদিতা সমাজে ভয়াবহ রকমের বৈষম্য, ক্ষোভ, হতাশা, দুঃখ, কষ্ট, আশাহীনতা, অপরাধের জন্ম দিচ্ছে। খুব অল্প কিছু মানুষ অনেক বেশি পাচ্ছে, আর অধিকাংশ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে। এককথায় বলা যায় এই অবস্থা মানুষের মনে অ-সুখ সৃষ্টি করছে।
আর সেইকারণেই সুখী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের ১০ ধাপ অবনতি হয়েছে গত এক বছরে। জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউসন্স নেটওয়ার্ক খুব সম্প্রতি জানিয়েছে ১৫৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এবছর ১২৫তম। গতবছর ছিল ১১৫তম। সমাজে দুর্নীতির হার, মাথাপিছু আয়, সামাজিক সহযোগিতা, উদারতা ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে এই তালিকা তৈরি করা হয়েছে। দেখা গেছে যেসব দেশে সম্পদের বণ্টন সুষম, সেসব দেশেই সুখ বেশি।
তাহলে তো দেখা যায় আমাদের কপালে ‘সুখ’ সুদূর পরাহত। কোনোদিনও এদেশে সম্পদের সুষম বণ্টন হবে না, আমরা সুখ পাখিটার দেখাও পাব না। বরং এক শ্রেণির মানুষের করা অপরাধের দায় এবং বিদেশি ঋণের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে বেঁচে থাকব। আমরা সুখের পেছনে ছুটব ঠিকই কিন্তু সুখ মিলবে না।
শাহানা হুদা: যোগাযোগকর্মী
Comments