ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী কালা জাহাঙ্গীর কোনো মিথ নয়

kala jahangir
কালা জাহাঙ্গীরের একমাত্র ছবি যা পুলিশ সরবরাহ করেছিলো। এর বাইরে কালা জাহাঙ্গীরের আর কোনো ছবির সন্ধান পাওয়া যায় না। ছবি: সংগৃহীত

১৯৯৩-৯৪ সাল। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের আবাসিক ছাত্র। এক বিকালে পুলিশ হলের চারদিক ঘিরে ফেলে। খোঁজ নিয়ে জানলাম হলে পুলিশের অভিযান চালানো হবে। অনেক উৎসুক ছাত্রের মতো আমিও বেরিয়ে আসি হলের প্রধান ভবনের নিচতলার বারান্দায়। এরই মধ্যে একটি ছেলেকে প্রধান ফটকের দিক থেকে মেইন বিল্ডিংয়ের পশ্চিম পাশের বর্ধিত ভবনের দিকে হনহন করে হেঁটে চলে যেতে দেখলাম।

ছেলেটি শ্যামলা, ছিপছিপে গড়নের। লম্বা ৫ ফুট ৪ ইঞ্চির মতো হবে। মুখটা একটু লম্বাটে ধরনের। কেউ একজন ফিস ফিস করে বললো- “ঐ যে কালা জাহাঙ্গীর যায়।”

তখন ঢাকার অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসীর আনাগোনা ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের এই হলে। তাই অবাক হলাম না। কিছুক্ষণ পরে পুলিশ হলের ভিতরে প্রবেশ করলো। শুরু করলো বিভিন্ন রুমে তল্লাশি। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক তল্লাশি চালানোর পর পুলিশ ফিরে যায় খালি হাতে। পুলিশ চলে যাওয়ার পর ছাত্রদের মধ্যে শুরু হয় কানাঘুষা। কালা জাহাঙ্গীর কীভাবে তার উপস্থিত বুদ্ধির মাধ্যমে নিশ্চিত গ্রেপ্তার এড়িয়েছে সবাইকে চমকে দিয়েছিলো।

পুলিশি তল্লাশির সময় যখন ছাত্ররা রুম থেকে বেরিয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়ায়, তখন কালা জাহাঙ্গীর হলের এক রুমে প্রবেশ করে। শুয়ে পড়ে লেপ মুড়ি দিয়ে। এমন একটা ভান করে যেনো সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং প্রচণ্ড জ্বরে ভুগছে। পুলিশ যখন তার লেপ উঠিয়ে পরিচয় জানতে চায়, সে বলে- “স্যার, আমি অনেক অসুস্থ। উঠে দাঁড়াতে পারছি না। তাই শুয়ে আছি।”

তার নিখুঁত অভিনয়ে পুলিশ তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মনে করে চলে যায়।

এই কালা জাহাঙ্গীরকে পাড়ার সিনিয়র বড় ভাই হিসেবে চিনতেন একটি শীর্ষস্থানীয় দৈনিক পত্রিকায় কর্মরত একজন সিনিয়র রিপোর্টার। তিনি বলেন, তিনি কালা জাহাঙ্গীরের সাথে শৈশবে কচুক্ষেত ইব্রাহীমপুর এলাকার মাঠে ক্রিকেট খেলেছেন। একই পাড়ার হওয়ার কালা জাহাঙ্গীরের পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের চিনতেন বলে জানান তিনি।

সচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান জাহাঙ্গীরের শীর্ষ সন্ত্রাসীতে রূপান্তরিত হওয়ার গল্প বিস্ময়কর।

কচুক্ষেত এলাকার এক দোকানি দ্য ডেইলি স্টারের নিজস্ব প্রতিবেদক শাহীন মোল্লাকে বলেন, কালা জাহাঙ্গীরের মা ঢাকা সেনানিবাস এলাকার একটি স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন। সে ১৯৯০ এর দিকে এসএসসি পরীক্ষায় পাশ করার পর তেজগাঁও কলেজে ভর্তি হয়। শুরু করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের রাজনীতি।

তৎকালীন সন্ত্রাসী কচি গ্রুপ সক্রিয় ছিলো ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায়। কচির ভাই আজাদ এবং জাহাঙ্গীর এর মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয় এলাকায় প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে।

কালা জাহাঙ্গীরের এলাকার বড় ভাই হিসেবে পরিচিত এক ব্যক্তি ইব্রাহীমপুরে খুন হন এবং এই ঘটনার ফলশ্রুতিতে আজাদকে ঢাকা কোর্ট প্রাঙ্গণে হত্যা করে আলোচনায় আসে কালা জাহাঙ্গীর। এ কথা জানান ওই দোকানদার।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তখন কালা জাহাঙ্গীরের একটি ছবিসহ পোস্টার ঢাকার বিভিন্ন দেয়ালে সাঁটায় এবং জনগণকে তথ্য দিয়ে তাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য সহযোগিতা কামনা করে।

পরবর্তীতে সে শীর্ষ সন্ত্রাসী কালা জাহাঙ্গীর হিসেবে পরিচিতি পায়।

এরপর কালা জাহাঙ্গীর পুরান ঢাকায় (গেন্ডারিয়ার) একজন ওয়ার্ড কমিশনারের ছত্রছায়ায় সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যায়। সে পুরান ঢাকার আরেক ওয়ার্ড কমিশনারকে উত্তরা এলাকায় হত্যা করে আবারও আলোচনায় আসে।

এভাবে ঢাকায় আলোচিত অনেকগুলো হত্যাকাণ্ডের সাথে তার নাম জড়িয়ে পড়ে।

১৯৯৭ সালের পর ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হান্নান এর সাথে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে। তারপর মাঝেমধ্যেই কালা জাহাঙ্গীর এর সাথে পিচ্চি হান্নানের নিয়ন্ত্রিত কারওয়ানবাজার তেজতুরী বাজার এলাকায় যৌথ মহড়া দিতো এবং এই এলাকায় কালা জাহাঙ্গীর ও পিচ্চি হান্নান যৌথভাবে অনেক সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করে বলে জানান তেজতুরী বাজার এলাকায় এক দোকানদার। ওই দোকানি যিনি ১৯৮৬ সাল থেকে এই এলাকায় ব্যবসা করেন তিনি বলেন, কালা জাহাঙ্গীরসহ অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসীর আস্তানা ছিলো এই ফার্মগেট, তেজতুরী বাজার এলাকায়।

২০০৩-০৪ সালের মধ্যে তাদের অনেকেই খুন হন। আর লাপাত্তা হয়ে যায় কালা জাহাঙ্গীর। এখনও অজানা যে এই সন্ত্রাসী কি অন্তর্কোন্দলে মারা গেছে, গুম হয়েছে নাকি অন্যান্য সন্ত্রাসীদের মতো পাড়ি জমিয়েছে সীমান্তের ওপারে।

কালা জাহাঙ্গীর এক সময়ে দোর্দণ্ড প্রতাপে সন্ত্রাস করেছে। সে কোনো মিথ নয়।

শরিফুল ইসলাম, হেড অব ক্রাইম ডেস্ক, দ্য ডেইলি স্টার

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English
Nat’l election likely between January 6, 9

EC suspends registration of AL

The decision was taken at a meeting held at the EC secretariat

1h ago