ওয়েলস জানাতে চায় তারা কতটা স্বতন্ত্র

Wales National Assembly House
১৮৩৯ সালে নির্মিত ওয়েলশের ন্যাশনাল এসেম্বলি ভবন। ছবি: একুশ তাপাদার

ইংল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ড আর নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড-আলাদা এই চার দেশ নিয়ে যুক্তরাজ্য। যেহেতু চারটি ভিন্ন দেশ, পুরো অঞ্চলে কিছুটা বৈচিত্র্য থাকা স্বাভাবিক। লন্ডন থেকে ন্যাশনাল এক্সপ্রেস বাসে ওয়েলসের রাজধানী কার্ডিফ আসার পথে পার্শ্বযাত্রী ইভন্‌ লুইস ইভান্সের কাছ থেকে জানলাম বৈচিত্র্য আসলে কিছুটা নয়, বরং বেশ কিছুটা। আবিষ্কার করলাম ওয়েলসবাসীর জাত্যাভিমানও বেশ শক্ত, নিজেদের ভাষা নিয়ে গর্বেরও শেষ নেই। ইংল্যান্ড থেকে যে তারা অনেকটাই আলাদা এবং স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধারণ করে, নানাভাবেই তা বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা আছে তাদের আচারে।

জানালার পাশে সিট বেছে নিয়েছিলাম। ঘণ্টা চারেকের জার্নি। বাইরের প্রকৃতি দেখতে দেখতেই সময় পার করার ভাবনা মাথায়। একা ভ্রমণে কখনোই আমার আপত্তি বা বিরক্তি নেই। যদি নতুন কোনো জায়গায় যাওয়া হয়, তবে আলাদা একটা রোমাঞ্চও কাজ করে। একা ভ্রমণই তখন চারপাশ দেখার সময় বাড়িয়ে দেয় বিস্তর।

কিন্তু ঘণ্টা চারেক কেবল প্রকৃতি দেখেই কাটাতে হলো না। পার্শ্বযাত্রী ইভান্স নিজে থেকেই আলাপ জমালেন। তিনি ওয়েলসেরই মানুষ, কুড়ি বছর থেকে কার্ডিফ শহরে থাকেন। আমি ক্রিকেটের আর তিনি রাগবির পোকা। কাভার করেছেন একটি রাগবি বিশ্বকাপও। তবে ক্রিকেট নিয়েও তার জানাশোনা কম নয়। ইভান্সের প্রয়াত প্রেমিক ছিলেন পাড় ক্রিকেটভক্ত। মূলত টেস্ট ক্রিকেটের। ইভান্স তার কাছ থেকে জ্ঞান বাড়িয়েছিলেন ক্রিকেটের। শচীন টেন্ডুলকারের ব্যাটিং মনে ধরে আছে তার। লন্ডন শহর পেরোতেই ইংল্যান্ডের কান্ট্রিসাইডের অপরূপ প্রকৃতিতে মজে এসব হালকা আলাপই চলছিল। সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির ভক্ত ইভান্সের আগ্রহেই সেই আলাপ গুরুগম্ভীর পর্যায়ে চলে গেল।

ব্রিটিশদের প্রথম কলোনি হচ্ছে এই ওয়েলস। আলাদা দেশ হলেও এখনো গ্রেট ব্রিটেনেরই অংশ তারা। ‘স্বাধীনতা পাইয়াও পাইলাম না’ এই অবস্থা আর কী।

এক সময় ব্রিটিশদের সবচেয়ে বড় কলোনি ছিল ভারতবর্ষ। সেই অঞ্চলের মানুষ হওয়ায় ইভান্সের আগ্রহও তুমুল। ইভান্সের বোনের শ্বশুরবাড়ি ভারতের দিল্লিতে। সেই পরিবারের আবার ১৯৪৭ এর দেশভাগ, দাঙ্গায় বিপর্যস্ত হওয়ার স্মৃতি দগদগে। ব্রিটিশ শাসন, দেশভাগ, ভাষা বৈচিত্র্য, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য নিয়ে আলাপ তাই অবধারিতভাবে গড়াল রাজনীতিতে।

 

‘ব্রিটিশরা শাসন করতে না গেলে ভারতবর্ষের মানচিত্র টুকরো টুকরো হওয়ারও তো দরকার হতো না,’ ইভান্সের এই কথায় যুক্তি আছে বেশ। তবে ব্রিটিশদের প্রতি তার খেদ আসলে নিজেদের প্রেক্ষাপটের কারণেই।

কথার ফাঁকে ইভান্স ব্যাগ থেকে বের করলেন, ‘Wales: England’s Colony?’ Martin Johns নামক এক ভদ্রলোকের লেখা বই (সেই বইটি পরে তিনি আমাকে উপহারই দিয়েছেন)। বইয়ের প্রসঙ্গেই এলো- উনিশ শতকে না-কী এখানকার শিশুরা ওয়েলস ভাষায় স্কুলে কথা বললেই ইংরেজদের শাস্তির মুখে পড়তে হতো। সময়টা বদলেছে। ইংরেজির আধিপত্য এখন অন্যভাবে। সাইনবোর্ডে ইংরেজির পাশাপাশি ওয়েলশ ভাষাতেও লেখা আছে নির্দেশনা। ওরকম কট্টর শাসনও অবশ্য নেই। কিন্তু নানাভাবে ইংরেজির প্রয়োজনটা চড়িয়ে দিয়ে আধিপত্য জারি আছে প্রবলভাবেই। জোর করে নয় বটে, তবে আবহটাই করা আছে তেমন।

একুশে ফেব্রুয়ারি- আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের কথা ইভান্স জানতেন না। আমার কাছ থেকে বায়ান্নর ইতিহাস জেনে বেজায় পুলকিত। এই নিয়ে না-কী পরেরবার ভিডিও স্টোরিও করবেন। আমি তখন ভাবছিলাম, পাকিস্তানিদের কাছ থেকে মাতৃভাষার অধিকার অর্জন করেও আমরা কি এখনো সব মাতৃভাষার প্রতি সমান শ্রদ্ধাশীল? ব্রিটিশ রাজত্ব কবেই মাটিচাপা দিয়েও কলোনিয়াল মানসিকতা থেকে কি বেরোতে পেরেছি? ইংরেজিটা যত না আমরা ভিন্ন ভাষা জানার আগ্রহ আর প্রয়োজনে শিখি, তারচেয়ে বেশি কি নিজেদের জাহিরের ভাবভঙ্গি থাকে না? সে যাকগে। ওসবে জট পাকিয়ে লাভ নেই। ফিরে আসি ওয়েলসের কথায়।

কেবল ভাষা নয়, ওয়েলসকে নানাভাবে নিজেদের কব্জায় রেখেছে ব্রিটেন। খাঁচাটা ছোট নয় আর কী। অনেক বড় খাঁচায় চট করেই বন্দিত্বের কোনো অনুভূতি হয় না। কিন্তু দৌড়ে ছুটতে গেলে একটা জায়গায় গিয়ে বিপত্তি আসেই।

ওয়েলসের ক্ষমতায় যেমন লেবার পার্টি। ফার্স্ট মিনিস্টার মার্ক ড্রেকফোর্ড সমাজতান্ত্রিক। কিন্তু তার হাতে সব ক্ষমতা নেই। সেক্রেটারি অব স্টেট বা রাজ্য সচিব আলুন কেয়ার্নসের হাতেই সব চাবিকাঠি। এই ভদ্রলোক আবার ব্রিটেনের ক্ষমতায় থাকা রক্ষণশীল দলের লোক। তাকে দিয়েই ওয়েলসকে বেঁধে রাখে ব্রিটেন। ইভান্স জানালেন, চিন্তাধারাতেও ইনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছাকাছি। সারা দুনিয়াতেই বোধহয় তাদের রমরমা সময় চলছে।

ইংল্যান্ডের সীমানা পার হয়ে ওয়েলসে ঢুকতে সেভার্ন ক্রসিংয়ে প্রশস্ত নদী পার হতে গিয়ে চোখে পড়ল প্রিন্স অব ওয়েলস সেতু। এই সেতুই ইংল্যান্ড-ওয়েলসকে যুক্ত করেছে। প্রিন্স অব ওয়েলস মানে প্রিন্স চার্লস। তার নামই জুড়ে দেওয়া হয়েছে এখানে। ওই নদীর বুকে বাদবাকি সব সেতুও নাকি ব্রিটিশ রাজপরিবারের নানান সদস্যের নামে। নামের রাজনীতি তাহলে এখানেও আছে! ইভান্সের আক্ষেপ ওয়েলসের কত ঐতিহ্য, কত ঋদ্ধ সংস্কৃতির ইতিহাস আছে। সেসব বাদ দিয়ে কেন সব কিছু রাজ পরিবারের নামে হবে? বাংলাদেশে থেকে এসে এই প্রশ্নের আর জবাব দেওয়া কি মানায়!

ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বের হওয়া নিয়ে জটিলতায় আছে ব্রিটেন। কেন লোকে ব্রেক্সিটের পক্ষে ভোট দিয়েছিল এই প্রসঙ্গ আনতেই ইভান্স জানালেন, ভুল-ভাল প্রচারে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে ব্রেক্সিটের পক্ষে গণভোট আনা হয়েছিল। কিন্তু মানুষ নিজের ভুল বুঝতে পেরে এখন আবার হতাশ। ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের কোনো উপায়ও তাই বের করতে পারছে না ব্রিটিশ সরকার। কিন্তু ব্রেক্সিটের এই প্রভাব পড়েছে ওয়েলসের অর্থনীতিতে। এখানকার গাড়ির কারখানাগুলো বন্ধ হওয়ার জোগাড়। যদি ব্রেক্সিট বাস্তবায়ন হয়ে যায়, তাহলে ইউরোপে শুল্কমুক্ত বাজার হারাবেন তারা। বাড়তি ট্যাক্স দিয়ে ওই ব্যবসা চালানো আর পোষাচ্ছে না তাদের।

রাজনীতির মার-প্যাঁচ নিয়ে আলাপ করতে করতেই ওয়েলসের উঁচু-নিচু টিলা, নয়নাভিরাম সবুজের সমারোহ অভ্যর্থনা জানাল। প্রকৃতি এখানে অবারিত দ্বার খুলে বসে আছে। সমুদ্র আছে, পরিপাটি টিলার মাঝে অতি পুরাতন স্থাপত্যশৈলীর মনোমুগ্ধকর আভিজাত্য আছে। সবচেয়ে বড় কথা, কেউ কোনো কিছু ধ্বংস করছে না। প্রকৃতিকে তার মতো চলতে দিয়ে চলছে জীবন অবারিত। বাস থেকে নেমে টাফ নদীর পাশ দিয়ে হেঁটে ইভান্স আমাকে হোটেল পর্যন্ত পৌঁছে দিলেন। কার্ডিফের মাঠে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের সাফল্য প্রত্যাশা করলেন, ‘সাবাস, বাংলাদেশ’ বলে।

ক্রিকেট খেলা কাভার করতে এসে রাজনীতির মধ্যে ঢুকে যাওয়া হয়তোবা অনভিপ্রেত। কিন্তু ক্রিকেটেও তো চাইলে রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি সবই খুঁজে নেওয়া যায়, কারণ ‘ইট’স মোর দ্যান জাস্ট আ গেম’।

Comments

The Daily Star  | English
Yunus condemns lawyer’s murder in Chattogram

Keep calm, refrain from violence

Chief Adviser Prof Muhammad Yunus yesterday condemned the murder of a lawyer in the port city of Chattogram.

6h ago