চা শ্রমিকরা জানেন না মে দিবস কী!

Tea labourer
চা-বাগানে একাগ্র মনে কাজ করছেন একজন চা শ্রমিক। ছবি: মিন্টু দেশোয়ারা

আজ দিনটা শ্রমিকদের। সারাদেশে পালিত হচ্ছে মহান মে দিবস। কিন্তু চা শ্রমিকরা জানেন না মে দিবসের ইতিহাস ও তাৎপর্য।

যখন রোদের প্রখরতা তখনও চা শ্রমিকরা এই কাঠফাটা রোদের মধ্যে কাজ করছেন। সকাল পেরিয়ে দুপুরের খরতাপে মাথা থেকে কপাল চুইয়ে মুখ গড়িয়ে পড়ছে ঘাম। সারা শরীর জবজবে ভেজা। জীর্ণ-শীর্ণ শরীরটা দেখলেই বোঝা যায় কেমন খাটুনি খাটতে হয় এই মানুষগুলোকে।

তারা জানেন না মে দিবস কী, মে দিবসের ছুটির কথা শুনে তারা শুধু হাসছেন, সমাজের অনেকে হাসতে না জানলেও খেটে খাওয়া এ শ্রমিকরা প্রাণ খুলে হাসতে জানেন! তারা এই চা শ্রমিক, কচি চা পাতা থেকে খাওয়ার চা পাতা তৈরিতে দিনভর শ্রম দেন তারা।

গতকাল (৩০ এপ্রিল) দুপুরে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল এলাকায় গিয়ে শ্রমিকদের কর্মযজ্ঞের এমন চিত্রই দেখা গেলো। আলাপে তারা জানালেন, চা বাগানে অমানবিক কষ্টের কাজেও এ হাসি-খুশিটাই তাদের জীবনকে সচল রেখেছে।

হবিগঞ্জের চানপুর চা বাগানে শ্রমিক গৈারা লোহার বলেন, অভাব অনটনের নিজের জাইত (জাতিস্বত্তা) পর্যন্ত ভুইলে গেছি হামরা (আমরা)। আর দিবসতো অনেক দুরের বিষয় লাগেক। সব দিনইতো হামদের লাগি সমান।

শ্রীমঙ্গলের হরিণছড়া চা বাগানের ৪৭ বছর বয়সী মহিলা চা শ্রমিক কৈশলা ঘাটুয়ালের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানালেন নিত্যদিন হারখাটুনি পরিশ্রমের কথা। ১৪ বছর বয়স থেকে কাজ করছেন চা বাগানে।

তিনি জানান, "এক সময় হামি পতেক দিন হাজরি পাইথম ২০ টেকা। এখন হামি হাজরি পাই ১০২। এই পয়সাই কেমনে চলবেক পেট। বড় কষ্ট কইরে দিন পাইর কইরে দেই। কাকে দোষ দিব। এইটা হামার কপাল লাগে।"

তিনি জানালেন, তিনিও স্বপ্ন দেখেন "একদিন তার বাড়ি সুন্দর হবেক"। তার ভাষায়, "আবার এইটা ভাবছি এই হাজরি দিয়ে (মজুরি) কী সম্ভব? যেখানে জামাই-লেইকা-বাচ্ছা লিয়ে দুই বেলা খাইতে নাই পারি। লাখ টেকার ঘর কেমনে বানাবো মাটিটাই হামদের নাই লাগে!"

তিনি বলেন, মে দিবসে রাস্তায় মিছিল বের হয়। এর বেশি কিছু জানি না।

শুধু গৈারা লোহার, কৈশলাই নন, একই অবস্থা বিশাখা রায়, সীতা কৈরীসহ আরও অনেক চা শ্রমিকের। তারা জানান, বছরের এই সময়টি চা বাগানগুলোতে পুরোদমে কাজের ব্যস্ততা থাকে।

আরও জানান, সাতদিনে এই খোরাকি জনপ্রতি স্থায়ী চা শ্রমিক পান ১০২ টাকা করে ৭১৪ টাকাসহ যৎসামান্য রেশন পান। কিন্তু ছুটির আগের দিন কেউ যদি কাজে না যায় তাহলে সে ছুটিবারের কোন মজুরি পাবে না। কাজ করা এসব শ্রমিকদের কোনো স্বাস্থ্যসম্মত আবাসস্থল নেই।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরীর মন্তব্য, মুখে হাসি নিয়ে কাজ করলেও তাদের দুঃখের সীমা নেই। সমাজ ও সভ্যতার ক্রমাগত উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠছে একের পর এক উন্নয়নের সিঁড়ি।

কৈরী মনে করেন, রোদে পুড়ে এই চায়ের বাজারকে চাঙ্গা রাখতে যারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম একই ভুমিতে দিনানিপাত করেন তারা এক জীবন খাটুনি করেও স্বপ্ন দেখতে পারেন না ভুমির মালিকানার। এ স্বপ্নটা তাদের অধরাই থেকে যায়। তাদের জীবনটা যেনো দুর্বিষহ।

তার মতে, জাতীয় অর্থনীতিতে চা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও এ শিল্পের নেপথ্য মানুষগুলো নানা বঞ্চনা আর অবহেলার শিকার হয়ে আসছেন। চা শিল্পের উন্নয়ন হলেও ভাগ্যের পরির্বতন হয় না চা শ্রমিকদের। মধ্যযুগের ভূমিদাসের মতোই চা মালিকের বাগানের সঙ্গে বাঁধা তাদের নিয়তি। তারপরও পেটের জ্বালায় বারবার ফিরে আসেন বাগানে। যাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকানো তাদের আবার দিবস কী?

"কতো দিবস আসে যায় কিন্তু আমরা যেখানে ছিলাম সেখানে আছি," বললেন বাংলাদেশ চা শ্রমিক নারী ফোরামের কেন্দ্রীয় সভাপতি গীতা রানী কানু।

গোয়াইনঘাট ডিগ্রী কলেজের শিক্ষক চিত্ররঞ্জন রাজবংশী বলেন, চা শ্রমিকদের দুইকক্ষ বিশিষ্ট থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। যা সম্পূর্ণ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। যে কারণে ক্যান্সার ও টিবি রোগের জন্য চা বাগানকে বিপদজনক জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

শ্রমআইনেও চা-শ্রমিকদের প্রতি বৈষ্যমের কথা তুলে ধরে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি বিজয় বুনারজি বলেন, শ্রমআইনের ১১৭ ধারায় সকল শ্রমিকদের জন্য প্রতি ১৮ দিন কাজের জন্য ১ দিন অর্জিত ছুটি সেখানে শুধুমাত্র চা-শ্রমিকদের প্রতি ২২ দিন কাজের জন্য ১ দিন অর্জিত ছুটি প্রদানের বিধান করা হয়েছে।

বাংলাদেশ চা ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি দেবাশিষ যাদব বলেন, "চা গাছ ছেঁটে ছেঁটে ২৬ ইঞ্চির বেশি বাড়তে দেওয়া হয় না। চা শ্রমিকদের জীবনটাও যেনো তেমন ছেঁটে দেওয়া চা গাছের মতো। লেবার লাইনের ২২২ বর্গফুটের কুঁড়েঘরে বন্দি তাদের জীবন। বাগানের সবুজের হাসি আমরা দেখতে পাই; কিন্তু দেখতে পাই না শ্রমিকের কান্না! দেখতে পাই না কীভাবে মাত্র ১০২ টাকা দৈনিক মজুরি দিয়ে জীবন পার করে চা শ্রমিকরা।"

বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক রজত বিশ্বাস বলেন, প্রচলিত শ্রম আইনের ২(১০) ধারায় গ্রাচুইটি, ৫ ধারায় নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র, ২৩৪ ধারায় কোম্পানির মুনাফার ৫% শ্রমিকদের কল্যাণে অংশগ্রহণ তহবিল ও কল্যাণ তহবিলে বরাদ্দ করার আইন থাকলেও কোন চা-বাগানেই তা বাস্তবায়ন করা হয় না।

উল্লেখ্য, দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে ১৮৮৬ সালে শ্রমিকরা আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে সমবেত হয়েছিলেন। তাদেরকে ঘিরে থাকা পুলিশের প্রতি এক অজ্ঞাতনামার বোমা নিক্ষেপের পর পুলিশ শ্রমিকদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। ফলে প্রায় ১০ থেকে ১২ জন শ্রমিক ও পুলিশ নিহত হয়। পরবর্তীতে, বিশ্বজুড়ে শ্রমিক সংগঠনগুলো ১ মে 'বাধ্যতামূলকভাবে কাজ না করার' সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে ১ মে হয়ে উঠে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস।

Comments

The Daily Star  | English
explanations sought from banks for unusual USD rates

Explanations sought from 13 banks for higher dollar rate

BB issued letters on Dec 19 and the deadline for explanation ends today

2h ago