কার বিচার চাই, কার কাছে চাই
সেদিনই নুসরাতের চলে যাওয়াটা নিশ্চিত হয়েছিলো, যেদিন তার শরীর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সেদিনই নুসরাত শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত প্রতিবাদ করে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যেদিন মাদ্রাসা অধ্যক্ষ তার শরীরে হাত দিয়েছিলেন। নুসরাত তার কথা রেখেছেন, শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত প্রতিবাদ করে গেছেন।
আপনি-আপনারা, আমি-আমরা নুসরাতের কেউ নই। কেউ যদি হতাম সেদিনই প্রতিবাদ করতাম, শরীরে হাত দেওয়ার অপরাধের বিচার চাইতে যেদিন নুসরাত-নুসরাতের মা পুলিশের কাছে গিয়েছিলেন। আমরা কেউ সেদিন নুসরাতের পরিবারের পাশে দাঁড়াইনি।
নুসরাতের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করেছি। তারপর জোরে-সোরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় তুলেছি ‘বিচার চাই’।
কার বিচার চাই, কার কাছে চাই?
বিচার তো বাতাসের, গাছপালা বা পশুপাখির চাই না। বিচার চাই কিছু মানুষের, কিছু অপরাধীর।
বিচার চাই অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার। যে নুসরাতকে নিপীড়ন করেছিলেন, অপমান-অসম্মান করেছিলেন।
নুসরাতের অভিযোগকে যারা গুরুত্ব দিলেন না, মিথ্যা বলে প্রচারণা চালাতে চাইলেন, সেই ওসি-স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের বিচার চাই না?
সেদিন যদি ওসি-স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা অভিযুক্ত অধ্যক্ষের পক্ষে না হতো, তাহলে হয়তো নুসরাতের শরীরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাই ঘটতো না। ‘নুসরাত নিজেই নিজের শরীরে আগুন দিয়েছে’- যে ওসি এই তত্ত্ব নিয়ে মাঠে থাকলেন, তার দায় কী অধ্যক্ষের চেয়ে কম? তার বিচার করতে হবে না?
সেই ওসিকে ‘প্রত্যাহার’ করা হয়েছে। গণমাধ্যমে বড় করে সেই সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ‘প্রত্যাহার’ যে কোনো শাস্তি নয়, এক্ষেত্রে তো নয়ই, তা আমাদের অজানা নয়। তারপরও আমরা ‘প্রত্যাহারে’ই খুশি কেন?
স্থানীয় জেলা প্রশাসন মাদরাসাটি পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এখন জানা যাচ্ছে অধ্যক্ষের বহুবিধ অপকর্মের কাহিনি। আর্থিক অনিয়ম, জামায়াত-শিবির, তিন বছর আগে জামায়াত থেকে বহিষ্কার, আওয়ামী লীগার হয়ে ওঠা- সব তথ্যই প্রকাশিত হচ্ছে।
জেলা প্রশাসনের কর্তাদের তা অজানা ছিলো, বিশ্বাসযোগ্য কথা নয়। নুসরাতকে নিপীড়ন করার পরে দশ-পনের দিন কেটে গেছে। পুলিশ মামলা নিয়ে টালবাহানা করেছে। জেলা প্রশাসনের কর্তারাও নীরব-নিশ্চুপ থেকেছেন। কেনো?
অভিযুক্ত অধ্যক্ষকে সরিয়ে দেওয়ার কথা তারা চিন্তাও করেননি।
দায় তারা এড়াতে পারেন?
অভিযুক্ত নিপীড়ক অধ্যক্ষের মুক্তির দাবিতে মিছিল-মিটিং হয়েছে। নুসরাতের মতোই অনেক মেয়ে ছিলেন সেই মিছিলে। নেপথ্যে ছিলো রাজনীতি।
আমরা কার বিচারই চাইব? মিছিলে যারা অংশ নিলেন, তাদের? হ্যাঁ, চাই। এ তথ্য তো আমাদের কারোরই অজানা নয় যে, এই মিছিলের আয়োজনের পেছনে একটি চক্র আছে। সেই চক্রটি রাজনৈতিক চক্র। স্থানীয় রাজনীতির সবচেয়ে প্রভাবশালী চক্র। হয়তো গণমাধ্যমের তদন্তে বেরিয়ে আসবে সেই চক্রের পরিচিতি। কিন্তু রাষ্ট্রীয় তদন্তের পাতায় কী উন্মোচিত হবে সেই চক্রের নাম? আশাবাদী হতে পারেন?
এতো ঘটনা ঘটে গেলো স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কোথাও দেখেছেন? শুনেছেন তাদের কোনো বাণী?
আমরা বিচার চাই, কার বিচার চাই? আংশিক জানি- আংশিক জানতে চাই না। আমরা ‘নির্দেশ দেওয়া হয়েছে’তেই পুলকিত হই। অনেকেই বলছি ‘অন্তত’ নুসরাত হত্যার বিচার হোক। পূর্বের হত্যাগুলোর বিচার হয়নি বলে কি নুসরাত হত্যার বিচার হবে না? একটি বিচার ‘অন্তত’ হোক।
নিশ্চয়ই এই প্রত্যাশা অত্যন্ত আন্তরিক। দ্বিমত করছি না।
কিন্তু, মিছিল করানোর নেপথ্যের খলনায়কদের বিচার চাইতে হবে না? তাদের বিচার করতে হবে না?
বিচার কী শিলা-বৃষ্টি, যে আকাশ থেকে পড়বে! বিচারহীনতার পরিবেশ বিচ্ছিন্নভাবে তৈরি করা যায়। ভয়ের সংস্কৃতিও তৈরি করা যেতে পারে বিচ্ছিন্নভাবে। ন্যায্যতা-বিচারের সংস্কৃতি, একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। বিচ্ছিন্ন বা হুট করে তা প্রতিষ্ঠা করা যায় না।
তনু হত্যার বিচার কী কারণে হয় না, তা আপনার অজানা নয়। তনু হত্যার বিচার চাওয়া বাদ দিয়েছি! ত্বকী হত্যার বিচার চাই বছরে একদিন। সাগর-রুনীকে ভুলে গেছি।
প্রতিবাদহীন-প্রশ্নহীন আত্মসমর্পণ-আনুগত্যের মোসাহেব সর্বস্ব সমাজে আমরা বাস করছি। আমাদের চিন্তা-উদ্যোগ এডহকভিত্তিক। একটি ঘটনায় সাময়িক জেগে উঠি, আরেকটির অপেক্ষায় থাকি। আগেরটি চাপা দিয়ে, পরেরটি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। নুসরাত-তনু-ত্বকী-সাগর-রুনীরা ক্রমশ হারিয়ে যায় অন্ধকারে।
কেনো বিচার চাই না, কেনো ভুলে গেছি- প্রশ্নের উত্তর সবাই জানি। এসব হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে আছে ‘প্রভাবশালী চক্র’, আছে ‘রাজনীতি’।
নুসরাত রাফি হত্যার পেছনেও আছে ‘প্রভাবশালী চক্র’, আছে ‘রাজনীতি’। যে কারণে তনু-ত্বকী-সাগর-রুনী হত্যার বিচার হয় না, সেই একই কারণে ‘অন্তত নুসরাত হত্যার’ বিচার কি সম্ভব?
হয়তো বলছেন, হতাশার কথা বলছি- আমাদের আশাবাদী হতে হবে। হ্যাঁ, বলতে পারেন, ভাবতে পারেন। আমি হয়তো পারছি না। এই হতাশা-ব্যর্থতার দায়ভার একান্তই আমার। আমরা আর কিছু করতে পারি না। দু’একটি কথা বলতে পারি, দু’লাইন লিখতে পারি। নুসরাতরা মগজে জট তৈরি করে দেয়। আশাবাদী হতে পারি না, পারি না ঘুমাতে। যাদের অনেক কিছু করার আছে, তাদের মগজ পরিষ্কার, সেখানে নুসরাতদের কোনো স্থান নেই। স্থান নেই হতাশার। তাদের জীবন ‘প্রটোকল’র নিরাপত্তার চাদরে মোড়ানো। তাদের সন্তানরা নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করেন। তাদের ঘুমে কোনো সমস্যা হয় না।
আরও পড়ুন:
বাঁচানো গেল না ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রীকে
নুসরাতের হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ
Comments