তামিম ঝলকের পরও কেন এমন ধসে পড়া?
সবুজ ঘাসে ভরা উইকেটের অবয়ব দেখতে যতটা ভীতিকর খেলতে নামার পর ততটা ছিল না। বল ব্যাটে আসছিল দারুণভাবে। সেখানে তামিম ইকবাল যে দুর্দান্ত সুর বেঁধে দিয়েছিলেন, সেটা ধরেই বড় রানের দিকে এগুতে পারত বাংলাদেশ। কিন্তু তামিমের নাচন এক পাশে রেখে আরেক পাশে যেন মুখ থুবড়ে লুটোপুটি খেলেন বাকিরা। শর্ট বল সামলাতে না পারার সেই পুরনো রোগ আবার ফিরে এলো প্রকটভাবে।
হ্যামিল্টন টেস্টে প্রথম দিনে দুই সেশনের কিছু বেশি ব্যাট করে বাংলাদেশ গুটিয়ে যায় মাত্র ২৩৪ রানে। দিনশেষে বিনা উইকেটে ৮৬ রান তুলে নিউজিল্যান্ড দিচ্ছে বড় রানে চাপা দেওয়ার ইঙ্গিত।
টস হেরে সাদমান ইসলামকে নিয়ে ক্রিজে গিয়েই তামিম আভাস দেন ভালো কিছুর। দুজনের ব্যাটই চলছিল সাবলীল। দলের ৫৬ রানে ট্রেন্ট বোল্টের শেষ মুহূর্তের স্যুয়িং করা বলে সর্বনাশ হয় সাদমানের।
কিন্তু আরেক পাশে তামিমের ব্যাট ততক্ষণে উত্তাল। বলের মতিগতি বুঝেই ব্যাট চালিয়ে তরতরিয়ে রান বাড়িয়ে চলছিলেন তিনি। দ্বিতীয় উইকেটে মুমিনুল হকের সঙ্গে চটজলদি গড়ে উঠে ৬৪ রানের জুটি, তাতে কেবলই ১২ রানের অবদান মুমিনুলের। উইকেটের ঘাস দেখে ব্যাটসম্যানরা ঘাবড়াতে পারেন, তামিম সেই ভীতি সরাতেই হয়ত অমন আগ্রাসী খেলে থাকবেন। তার দাপট থেকেই ড্রেসিং রুমে বাকিরাও নিতে পারতেন সাহস। কিন্তু তারা নিলেন হয়ত দুঃসাহস।
মুমিনুলের আউটেই আসলে ছন্দপতনের শুরু। বাঁহাতি নিল ওয়েগনার রাউন্ড দ্য উইকেটে এসে লেগ স্টাম্পের উপর শর্ট বল করে প্রলুব্ধ করে যাচ্ছিলেন মুমিনুলকে। মুমিনুল সেটা বুঝতে পারলে তো! ছেড়ে দেবেন না মারবেন বুঝতে বুঝতে গ্লাভস সরাতে দেরি হয়ে গেল। ততক্ষণে উইকেটরক্ষক বিজে ওয়েটলিং ক্যাচ ধরে উদযাপন শুরু করে দিয়েছেন।
ঠিক এমনই দ্বিধায় পড়ে আউট হয়েছেন সৌম্য সরকারও। অফ স্টাম্পের খানিকটা বাইরে টিম সাউদির বলটি শেষ মুহূর্তে হালকা স্যুয়িং করল। সৌম্য ব্যাট নামিয়েছিলেন, কিন্তু গ্লাভস পর্যাপ্ত পরিমাণে সরতে পারেননি। যাতে চুমু খাওয়া বল ফের উল্লাসে ভাসায় ওয়েটলিংকে।
কিন্তু সৌম্যের আগে যিনি নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে ফিরেছেন তার কথা আলাদা করে বলতেই হয়। ওয়ানডে সিরিজে দুই ফিফটি করে মিডল অর্ডার আশা ছিল মোহাম্মদ মিঠুনকে ঘিরে। লাঞ্চের পরও তামিমের দাপট চলার মাঝে হুট করে মিঠুনেরও স্বাদ জাগে ছক্কা পেটানোর। জায়গামতো বল পেলে, ঠিকঠাক চালানোর হিম্মত থাকলে তাতে অসুবিধার কিছু ছিল না।
ওয়েগনারের বুকের উপরে তাক করা বাউন্সার মিঠুন ভেবেছিলেন উড়িয়ে দেবেন গ্যালারিতে। অমন খেলতে গেলে কব্জির জোর আর রিফ্লেক্স থাকা চাই তড়িৎ। মিঠুনের কোনটাই ছিল না। ওয়েগনার মিড উইকেটে ফিল্ডার রেখে যে ফাঁদ পেতেছিলেন, মিঠুনের লোপ্পা ক্যাচ যায় সেখানেই।
এতসবের মাঝেও তামিম তার ধরণ পাল্টাননি। কলিন ডিগ্র্যান্ডহোমকে ৬৫ রানে ক্যাচ দিয়ে বেঁচেছিলেন, সেঞ্চুরির পর তেড়েফুঁড়ে মারতে গিয়ে উঠিয়েছিলেন আরেকবার। দ্বিতীয় দফা বাঁচার পর দাপট বাড়ান আরও। যেমন চাইছিলেন খেলতে পারছিলেন তেমনই। ২১ চার আর ১ ছক্কা বলে দেয় স্ট্রোক ঝলমলে দিনে তামিম পাচ্ছিলেন সেরা ছন্দ। অন্য পাশের ব্যাটসম্যানদের মাঝে বিবর্ণ দিনে আলোর রোশনাই ছিল তামিমের ব্যাটে। এমন দিনে তার সমালোচনা তেতো শোনাতে পারে। কিন্তু তিনিও যেভাবে থামিয়েছেন ঝলমলে ঝলক সেটাও বড় দৃষ্টিকটু। যে গ্র্যান্ডহোম আউট করতে করতে তাকে করতে পারছিলেন না, তামিমকে শেষ পর্যন্ত ফেরান তিনিই।
গালিতে ফিল্ডার রেখে অফ স্টাম্পের বেশ বাইরে বল করলেন, তামিম তাড়া করে ক্যাচ দিলেন সেখানেই। ১২৮ বলে ১২৬ রানের তামিমের দাপট শেষ হওয়ার পর পুরো পরিস্থিতি স্থির করে নিতে পারতেন মাহমুদউল্লাহ। মাত্রই দ্বিতীয় সেশনে তাড়ার কিছুই ছিল না। কিন্তু অধিনায়ক আউট হয়েছেন সবচেয়ে বাজেভাবে।
সেই শর্ট বলই তারও হন্তারক। লং লেগে ফিল্ডার রেখে বাউন্সার তাক করে ওয়েগনার আহবান জানালেন মাহমুদউল্লাহকে। টি-টোয়েন্টির মেজাজে ক্ষ্যাপে গিয়ে মারতে গিয়ে ওই লং লেগেই ক্যাচ দেন ২২ রান করা মাহমুদউল্লাহ।
শর্ট লেগে ফিল্ডার টেনে মেহেদী হাসান মিরাজও ওয়েগনারের ফাঁদের শিকার। টেল এন্ডারদের টিকে থাকার চেষ্টা দেখা যায়নি। কিংবা বলা যায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ করা লিটন দাস তাদের নিয়ে লম্বা করতে পারেননি দৌঁড়।
প্রথম দিনেই হ্যামিল্টন টেস্টের যা অবস্থা তাতে নিস্তেজ হয়ে পড়বার ইঙ্গিত মিলছে বাংলাদেশের। টস হারলেও রান করা যায় এমন উইকেটে সুযোগ হারিয়ে এখন কেবল আফসোসই করতে পারেন বাংলাদেশ। কিউই দুই ওপেনার কোন তাড়াহুড়ো ছাড়া যেভাবে অনায়াসে খেলছেন তাতে ব্যথা এখনই বোধহয় টের পাচ্ছে বাংলাদেশ। দুই ওপেনারের অন্তত একজনকে অবশ্য ফিরিয়ে দিন শেষ করে একটা স্বান্তনা পাওয়া যেত, সেটা হয়নি সৌম্যের কারণে। এখানে অভিষিক্ত ইবাদতের আফসোসটা চড়া। বেচারা নিজের দ্বিতীয় বলেই টম ল্যাথামকে স্লিপে ক্যাচ বানিয়েছিলেন। সৌম্য তা হাতে জমিয়েও জমাতে পারেননি। ঠিক যেমন দিনটা শুরুতে হাতে জমিয়েও ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশ।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
(প্রথম দিন শেষ)
বাংলাদেশ প্রথম ইনিংস: ৫৯.২ ওভারে ২৩৪ (তামিম ১২৬, সাদমান ২৪, মুমিনুল ১২, মিঠুন ৮, সৌম্য ১, মাহমুদউল্লাহ ২২, লিটন ২৯ মিরাজ ১০, জায়েদ ২, খালেদ ০, ইবাদত ০* ; বোল্ট ১/৬২, সাউদি ৩/৭৬, ডি গ্র্যান্ডহোম ১/৩৯, ওয়েগনার ৫/৪৭, অ্যাস্টল ০/১০)।
নিউজিল্যান্ড প্রথম ইনিংস: ২৮ ওভারে ৮৬/০(রাভাল ৫১*, ল্যাথাম ৩৫* ; জায়েদ ০/১৫, ইবাদত ০/২৬, খালেদ ০/৬ , সৌম্য ০/৮, মিরাজ ০/৩১)
Comments