হামলার অভিযোগ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে, প্রক্টর বলছেন ‘দায় চাপানো হচ্ছে’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে গত ৪ ফেব্রুয়ারি হামলার শিকার হয়েছেন কোটাসংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন। এই হামলার বিষয়ে দ্য ডেইলি স্টারকে মামুন জানান, মাস্টারদা সূর্যসেন হল শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি রাইসুল ইসলামের নেতৃত্বে ২০-২৫ জন এতে অংশ নেয়। এরা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সঞ্জিত চন্দ্র দাসের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
বিভিন্ন সময় কোটাসংস্কার আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের ওপর ছাত্রলীগের হামলার অভিযোগ উঠেছে। গত ২৪ জানুয়ারি বাংলা একাডেমি এলাকায় ছাত্রলীগ তাদের অবরুদ্ধ করে রাখে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। তবে, বরাবরেও মতো এবারও হামলায় নিজেদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করেছে ছাত্রলীগ।
এ বিষয়গুলো নিয়ে গতকাল (৫ ফেব্রুয়ারি) দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতা এবং প্রক্টর এ কে এম গোলাম রাব্বানীর কথা হয়।
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ঢাবি শাখার সভাপতি ফয়েজ উল্লাহ বলেন, “কোটাসংস্কার আন্দোলনের নেতা হাসান আল মামুনকে পিটিয়েছে ছাত্রলীগ। নিজের হলেই (জগন্নাথ হল) ছাত্রলীগের আক্রমণের শিকার হয়েছেন ছাত্র ইউনিয়নের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক রাজীব দাস। সর্বত্র ছাত্রলীগের দখলদারিত্ব চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন আছে, আইন আছে। এখানে কোনো শিক্ষার্থী অপরাধ করলে, দেখার দায়িত্ব প্রশাসনের। শিক্ষার্থীদের মারধর করে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার অধিকার ছাত্রলীগকে কে দিয়েছে? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই তারা এসব করছে। ক্যাম্পাস বা হলে সহাবস্থান আছে, এটা খুবই হাস্যকর কথা।”
বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি উম্মে হাবিবা বেনজির বলেন, “গত ৪ ফেব্রুয়ারি মামুনকে প্রচণ্ড মারধর করা হয়েছে। তারপরও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যে সহাবস্থানের কথা বলছে, যা পুরোটাই মিথ্যাচার। যেহেতু ডাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেক্ষেত্রে আমরা বলবো এভাবে মিথ্যাচার না করে তারা যেনো আন্তরিকভাবে সহাবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টি করে। আমরা দেখেছি যে, সাম্প্রতিক প্রায় সবগুলো হামলায় ছাত্রলীগ জড়িত। মামুনের উপর হামলাকারীরাও ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সঞ্জিত চন্দ্র দাসের অনুসারী। তাদের নেতৃত্ব দিয়েছে মাস্টারদা সূর্যসেন হল শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি রাইসুল ইসলাম। এ সকল তথ্য ও প্রমাণ আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের কাছে লিখিত অভিযোগ আকারে দিয়েছি। প্রক্টর আমাদের আশ্বস্ত করেছেন, তিনি ব্যবস্থা নেবেন। যদিও আমরা জানি যে, এর আগের সব হামলায় লিখিত অভিযোগ দেওয়া সত্ত্বেও তারা কোনো ব্যবস্থাই নেননি। ফলে, এ ঘটনারও নিশ্চয়ই কোনো সুরাহা হবে না।”
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (মার্কসবাদী বাসদ সমর্থিত) ঢাবি শাখার সভাপতি সালমান সিদ্দিকী বলেন, “ডাকসু নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র হলের বাইরে একাডেমিক ভবনে করার দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে স্মারকলিপি দিতে এসেছিলেন মামুন। সে সময় তাকে ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সঞ্জিত চন্দ্র দাসের নির্দেশে ব্যাপক মারধর করে আহত করা হয়। পরবর্তীতে আমরা যখন এ অভিযোগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের কাছে গেলাম, তখন উনার মন্তব্য ছিলো এমন- তোমাদের এতো করে বললাম যে ওদিকে চা খেতে যাওয়ার দরকার নেই, তোমরা তো কোনো কথাই শুনো না!”
“বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে প্রশাসনের কোনো কর্তৃত্ব নেই। সেখানে ছাত্রলীগের একক আধিপত্য বিরাজমান। কয়েকদিন আগে কবি জসীমউদ্দীন হলের প্রভোস্ট ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ধাওয়া খেয়েছেন। একজন হল প্রভোস্টকে যদি ধাওয়া খেতে হয়, তাহলে সাধারণ ছাত্রদের অবস্থা যে কতোটা ভয়াবহ তা সহজেই অনুমেয়,’’ যোগ করেন সালমান।
কোটাসংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক নূরুল হক নূর বলেন, “মামুনের ওপর হামলার নেতৃত্বে দেয় মাস্টারদা সূর্যসেন হল শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি রাইসুল ইসলাম। ছাত্রলীগ মূলত প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের দ্বারা এই ধরনের হামলা পরিচালনা করে বিধায় তাদের সবাইকে চেনা যায় না। সুতরাং আমরা যাকে চিনতে পেরেছি, তার নাম-পরিচয়সহ প্রক্টর ও ভিসির কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। ছাত্রলীগ প্রতিবারই আমাদের ওপর হামলা করে তার দায় এড়িয়ে গিয়ে উল্টো আমাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ তোলে। আমাদের মধ্যে কোনো কোন্দল নেই, এই অভিযোগ ডাহা মিথ্যাচার। মামুনের উপর কারা হামলা করেছে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তো সিসিটিভি ফুটেজ দেখে চিহ্নিত করতে পারে। তাছাড়া, সেখানে প্রত্যক্ষদর্শী ছিলো ছাত্র ইউনিয়নের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক রাজীব দাস। তিনিও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের কাছে সাক্ষ্য দিয়েছেন। আসলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, সে কারণেই ডাকসু নির্বাচনে আমাদের নিরুৎসাহিত করা ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভীতি প্রদর্শনের জন্য ছাত্রলীগ পরিকল্পিতভাবে এই হামলাগুলো করছে।”
হামলার বিষয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সঞ্জিত চন্দ্র দাস বলেন, “ছাত্রলীগের কেউ এই হামলায় জড়িত নয়। যেহেতু সামনে ডাকসু নির্বাচন, সেই নির্বাচনে ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য তাদের আভ্যন্তরীণ কোন্দলকেও তারা ছাত্রলীগের হামলা বলে চালিয়ে দিচ্ছে।”
কোটাসংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর বারবার আক্রমণ করছে ছাত্রলীগ- ভুক্তভোগীদের এমন অভিযোগ সত্ত্বেও ‘আমরা মারিনি বললেই ছাত্রলীগের দায় মুক্তি ঘটে কী না?’- এমন প্রশ্নের উত্তরে ছাত্রলীগ সভাপতি বলেন, “এখন আমরা যদি বলি ওদেরকে ভূত বা জ্বিনে মেরেছে তাহলে কি আপনি বিশ্বাস করবেন? তাদের প্রমাণ কোথায়? ছাত্রলীগ তাদের মেরেছে এর কোন ভিডিও, কোন ফুটেজ কি তারা দিতে পেরেছে? এখন প্রমাণ ছাড়া শুধু অভিযোগ করলেই তো হবে না। সামনে ডাকসু নির্বাচন, তাই ওরা পাগলের প্রলাপ বকছে।”
মাস্টারদা সূর্যসেন হল শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি রাইসুল ইসলামের নেতৃত্বে ২০-২৫ জন অতর্কিতভাবে হামলা করেছে বলে হাসান আল মামুন ও অন্য সংগঠনের নেতৃবৃন্দের অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সঞ্জিত চন্দ্র দাস বলেন, “রাইসুল কালকে আমার সঙ্গে মধুর ক্যান্টিনে বসে ছিলো। আমি তো আর অন্ধ নই। আর রাইসুলও তো জ্বিন-ভূত হয়ে যায়নি, সে তো মানুষ। আমার সঙ্গে বসে থাকা অবস্থায় সে কী করে হামলা করে। এই কারণেই অভিযোগকারীরা ধরা খেয়েছে। তারা অন্য কারো নাম বললে না হয় বুঝতাম যে, অন্য কেউ হয়তো তাদের মারধর করতে পারে।”
এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম গোলাম রাব্বানী বলেন, “যে অভিযোগটি দিয়েছে, সে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নয়। তারপরেও যেহেতু অভিযোগ এসেছে, সেক্ষেত্রে গতকালই তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে এবং তারা কাজ করছে। কে, কোন উদ্দেশ্যে এই হামলা করেছে, লাইব্রেরির সামনে কেনো, এ বিষয়গুলো আমরা সামগ্রিকভাবেই দেখবো।”
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কোটা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্তদের ওপর বারবার হামলা হচ্ছে। নূরুল হক নূরকে সবার সামনে নির্মমভাবে পিটিয়ে রক্তাক্ত করা হয়েছিলো, ভিডিও ফুটেজেও তা দেখা গেছে। গত ৪ ফেব্রুয়ারি মামুনকে মারধর করা হয়েছে। লিখিত অভিযোগও দেওয়া হয়েছে আপনার কাছে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, “ওদের একটি অভিযোগের উদ্দেশ্যও খুব পরিষ্কার নয়। কোনো কিছু ঘটলেই একটি সংগঠনের উপর দায় চাপিয়ে দেওয়ার মানসিকতা থেকে আমাদের সরতে হবে। আর হামলা হলে অবশ্যই লিখিত অভিযোগ দিতে হবে। লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে যদি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় সেখানে এসে সাক্ষীও দিতে হবে। এ বিষয়গুলো যদি আমরা সম্মিলিতভাবে করতে পারি, আমরা আশা করি এসব ঘটনা অনেকটাই কমে আসবে।”
এবারও লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে, এর আগে বিভিন্ন হামলায় লিখিত অভিযোগের কী ব্যবস্থা নিয়েছেন?- জানতে চাইলে প্রক্টর বলেন, “যতোগুলো অভিযোগ এসেছে আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যবস্থা নিয়েছি। বিভিন্ন ঘটনায় বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তবে, সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, কেনো এই ঘটনাগুলো ঘটছে, তাদের উদ্দেশ্যটি আসলে কী? ছাত্রত্ব শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনকে কারা বিতর্কিত করতে চায়, ভাবমূর্তি নষ্ট করতে চায়, সেগুলোও আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে।”
অভিযোগকারীরা বলছেন, যেখানে মামুনকে মারধর করা হয়েছে সেখানকার সিসিটিভি ফুটেজ দেখলেও বোঝা যাবে কারা হামলাকারী। হামলাকারীদের চিহ্নিত করতে সিসিটিভি’র ফুটেজের সহায়তা নিচ্ছেন না কেনো?- এ প্রশ্নের জবাবে প্রক্টর রাব্বানী বলেন, “তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করুন। এ বিষয়টি নিয়ে আর কথা না বলি।”
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পেতে কতোদিন লাগতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “কমিটিকে খুব দ্রুতই প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। দিনক্ষণ ঠিক করে তো আর কাজ করা যায় না। একটি ঘটনাকে উদঘাটন করতে যতোটুকু সময়ের প্রয়োজন, তারা নেবে এবং আমরা আশা করছি যে যথাসময়েই তারা একটি প্রতিবেদন জমা দেবে।”
আগের বিভিন্ন ঘটনায় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জমা না দেওয়া এবং দোষীদের যথোপযুক্ত বিচারের আওতায় না আনাসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ইচ্ছাকৃত সময়ক্ষেপণের অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এসব ঘটনার সঙ্গে যেমন শর্ত আছে তেমনি এক ধরনের মানসিকতাও আছে। সবকিছু মিলেই বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কারোও প্রতিপক্ষ নয়। সবক্ষেত্রেই প্রশাসন তার সঠিক দায়িত্বপালন করে যাচ্ছে।”
Comments