১০ টাকার ঐতিহ্য, হলের খাবার ও পোকামাকড়ের ঘরবসতি

DU canteen
কোলাজ ছবি: ‘সাপ্তাহিক’ ম্যাগাজিনের সৌজন্যে

“তুমি পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও পাবে না। ১০ টাকায়... ১০ টাকায় এক কাপ চা, একটি সিঙ্গারা, একটি চপ এবং একটি সমুচা ১০ টাকায় পাওয়া যায় বাংলাদেশে... পৃথিবীতে। এটি যদি কোনো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় জানতে পারে, বিশ্ববাসী... তবে এটা গিনেস বুকে রেকর্ড হবে। ১০ টাকায় এক কাপ চা, গরম পানিও তো ১০ টাকায় পাওয়া যাবে না রাস্তায়। ১০ টাকায় এক কাপ চা, একটি সিঙ্গারা, একটি সমুচা এবং একটি চপ, এইগুলো পাওয়া যাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে। এটি আমাদের গর্ব, এটি আমাদের ঐতিহ্য।’’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ‘ঐতিহ্য’র কথা অত্যন্ত ‘গর্ব’ করে বলেছেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহসী-সংগ্রামী ঐতিহ্যের কথা মানুষের জানা ছিলো। কম দামে খাবার পাওয়া যায় এবং সেটি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঐতিহ্য’ তা মানুষের জানা ছিলো না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কতো উপাচার্য এলেন-গেলেন। অধ্যাপক ড. ফজলুল হালিম চৌধুরীসহ আরও কোনো কোনো উপাচার্যের নাম শ্রদ্ধা-ভালোবাসার সঙ্গে উচ্চারিত হয়। কিন্তু, তারা কেউ কখনো এতো বড় ‘গর্ব-ঐতিহ্য’র কথা বলেননি। বললেন বর্তমান উপাচার্য।

টিএসসিতে যে ১০ টাকায় ‘গর্ব-ঐতিহ্য’র এই খাবার পাওয়া যায়, তা অসত্য নয়। মান ও পরিমাণ নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও ২০ টাকায় খিচুড়ি, ৭ টাকায় চিকেন পেটিস পাওয়া যায়। তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের খাবার-বিষয়ক আলোচনায় সব সময় অস্বাস্থ্যকর, প্রায় অখাদ্য খাবারের প্রসঙ্গ আসে কেনো? একটু সরেজমিন ঘুরে দেখা যাক।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল, মাস্টারদা সূর্যসেন হল, হাজী মোহাম্মদ মুহসীন হল, কবি জসীমউদ্দীন হল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল, বিজয় একাত্তর হল এবং ফজলুল হক মুসলিম হল ঘুরে সেখানকার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি হলেই ক্যান্টিন, মেস এবং হল সংলগ্ন দোকানগুলোতে খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে। সেখানে প্রতি বেলায় খাওয়ার জন্য একজন শিক্ষার্থীকে গড়ে প্রায় ৩০ থেকে ৫০ টাকা খরচ করতে হয়। কয়েকবছর আগের তুলনায় এখন খাবারের দাম বাড়লেও মেন্যু প্রায় অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে।

শিক্ষার্থীদের মতে, হল ক্যান্টিনের খাবারের প্রচলিত মেন্যু সেই একই- ছোট্ট এক টুকরো মাংস অথবা মাছ, সামান্য একটু সেদ্ধ-সবজি, ভাত আর পানির মতো নয়, তার চেয়েও স্বচ্ছ পাতলা ডাল। তার ওপর প্রতি বেলায় খাবারে পোকা বা ময়লা-আবর্জনা পাওয়া তো খুব সাধারণ ঘটনা।

ক্যান্টিনগুলোর রান্না ও খাবার পরিবেশনের মান এবং পরিবেশ চূড়ান্ত রকমের অস্বাস্থ্যকর। সরেজমিনে কয়েকটি হলের ক্যান্টিনে ঢুকতেই নাকে এলো উৎকট গন্ধ। তেলাপোকার অবাধ বিচরণ। অপরিচ্ছন্ন টেবিল ও খাবারের প্লেটে মাছি ভনভন করছে। খাবারের টেবিলগুলো পরিষ্কার করা হচ্ছে দুর্গন্ধযুক্ত অপরিচ্ছন্ন ন্যাকড়া দিয়ে। স্যাঁতসেঁতে রান্নাঘরগুলোর চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ময়লা-আবর্জনা। ঘোরাফেরা করছে পোকামাকড়। এক কথায় রান্না, খাবার সংরক্ষণ ও পরিবেশন সবটাই দেখা যায় অস্বাস্থ্যকর।

শিক্ষার্থীরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের খাবারের পেছনে আলাদা কোনো বরাদ্দ নেই। ২০১৭-১৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট ছিলো ৬৬৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। যার ৭৮.৪৯ শতাংশ খরচ হয় বেতন-ভাতা হিসেবে।

মেয়েদের হল, টিএসসি ক্যাফেটেরিয়া এবং ডাকসুর ক্যান্টিনে কিছু ভর্তুকি দেয় প্রশাসন। ছেলেদের হল ক্যান্টিনগুলোর সবই ইজারা দেওয়া। ইজারাদার এক্ষেত্রে বিনা ভাড়ায় ডাইনিং রুম, আসবাবপত্র, থালা বাসন এবং কোনো কোনো হলে এককালীন কিছু ভর্তুকি পেয়ে থাকেন। ইজারাদারের খরচ থাকে খাবারের উপকরণ ও পরিবেশনায়। সেটি তারা তুলে নেন খাবারের দাম থেকে।

২০১৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের খাবারের মান নিয়ে পরিচালিত এক গবেষণায় উঠে এসেছে, বয়স ও পরিশ্রম অনুপাতে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর প্রতি দিনের খাবারে গড়ে ২ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার কিলো ক্যালোরি থাকা প্রয়োজন। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের ক্যান্টিন ও মেসে খাবার গ্রহণ করা শিক্ষার্থীরা পাচ্ছেন সর্বোচ্চ ১ হাজার ৪৪৯ কিলো ক্যালোরি। সে হিসাবে প্রয়োজনের অর্ধেক ক্যালোরিও পান না দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে অধ্যয়নরত এসব শিক্ষার্থীরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মাহমুদ হাসান নাভিদ বলেন, “হলগুলোতে খাবারের মান খুবই জঘন্য, স্বাদহীন, অস্বাস্থ্যকর।”

শিক্ষার্থীরা জানান, সব শিক্ষার্থীকে আবাসিক হিসেবে দেখানো হয় এবং তাদের কাছ থেকে এই মর্মে টাকাও নেওয়া হয়। প্রত্যেক শিক্ষার্থী ভর্তির সময় বাসন-কোসনের জন্য ৩০ টাকা ফি দেন।

প্রায় ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে মাস্টারদা সূর্যসেন হলের ক্যান্টিন পরিচালনা করে আসছেন লোকমান মিয়া এবং একই হল সংলগ্ন ক্যাফেটেরিয়ার দায়িত্বে রয়েছেন গোলাম মওলা স্বপন। তারা জানান, এই দুটি ক্যান্টিন ও ক্যাফেটেরিয়ার মাধ্যমে প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থীর তিনবেলার খাবারের জোগান দিয়ে আসছেন তারা। কিন্তু, পানি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সুবিধা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে আর কোনো ভর্তুকি বা বরাদ্দ পান না বলেই জানান।

আরেকটি হলের ক্যান্টিন পরিচালক দাবি করেন, প্রায় প্রতিদিনই গড়ে ৩৫-৪০ জনের বেশি ছাত্র ‘ফাও’ (টাকা না দিয়ে) খেয়ে চলে যায়। মূলত সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের একটা অংশ ‘ফাও’ অথবা বাকিতে খায়। অনেক চেয়েও সে টাকা পরে আর পাওয়া যায় না।

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রাফিয়া তামান্না বলেন, “বন্ধুদের কাছে শুনেছি, ছেলেদের হলে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা চাঁদা তুলে। সেই জন্য হল ক্যান্টিনের খাবারের মান এতো নিম্নমানের হয়।”

তবে, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, “এ অভিযোগ ভিত্তিহীন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট পর্যাপ্ত না থাকার কারণেই হল ক্যান্টিনগুলোর খাবারের এই দুরবস্থা।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯টি আবাসিক হলে বর্তমানে প্রায় ২০ হাজারের মতো শিক্ষার্থী অবস্থান করছে। ছেলেদের হলে গুটিকয়েক শিক্ষার্থী রান্না করে খায়। বাকিদের ভরসা হলো ক্যান্টিন, মেস অথবা হল সংলগ্ন দোকান। তবে, একটু সচ্ছল শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস সংলগ্ন নীলক্ষেত ও চাঁনখারপুল এলাকায় খেতে যান। মেয়েদের হলগুলোতে রান্না করে খাওয়ার প্রবণতাই বেশি। তবে, প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের রান্না করে খাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে বলে জানা যায়। অন্য উপায় না পেয়ে হল ক্যান্টিন বা ক্যাম্পাসের খাবার দোকানগুলোতেই খেয়ে থাকেন তারা।

২০১৭ সালের ১৯ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হলের ক্যান্টিনে খাবারের নতুন মূল্য-তালিকা প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। নতুন তালিকা অনুযায়ী হলের ক্যান্টিনগুলোতে সকাল, দুপুর ও রাতে একই মূল্যে বিভিন্ন খাবার পাওয়া যাওয়ার কথা জানানো হয় শিক্ষার্থীদের। তবে, হল ক্যান্টিনের জন্য এমন নিয়ম বেঁধে দেওয়া হলেও ক্যাম্পাসের সর্বত্র এ নিয়ম প্রযোজ্য নয়। খাবারের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে একই সঙ্গে উন্নত বিশ্ব এবং তৃতীয় বিশ্বের অবস্থা বিরাজমান।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ফুডকোর্টটি এর একটি বড় উদাহরণ। সেখানে সর্বনিম্ন ১৫ টাকার চা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১৯০ টাকা দামের খাবারের প্যাকেজ রয়েছে। এছাড়াও, বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে ‘ডিইউ কফি হাট’ নামের একটি ফুডকোর্ট রয়েছে। সেখানে সর্বনিম্ন খাবারের দাম ৯০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১৮৫ টাকা। এছাড়াও, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের (আইবিএ) ক্যান্টিনেও তুলনামূলক বেশি দামে খাবার পরিবেশন করা হয়। একজন সাধারণ শিক্ষার্থীর জন্য প্রতি বেলায় এতো টাকা দিয়ে খাবার খাওয়া প্রায়শই সম্ভব হয় না।

বিজয় একাত্তর হলের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নাজমুল ইসলামের কণ্ঠে এমন আক্ষেপের কথাই শোনা যায়। মাস্টারদা সূর্যসেন হলের এক দোকানে বসে ৩০ টাকার খিচুড়ি খেতে খেতে তিনি বলেন, “ক্যাম্পাসের ফুডকোর্টগুলোর মতো অন্যান্য খাবারের দোকানগুলোতেও খাবারের দাম অনেক বেশি। আমার মতো বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরই সেসব জায়গায় প্রতি বেলা খাবার খাওয়া সম্ভব হয় না। তাই বেঁচে থাকার জন্য বাধ্য হয়ে হলের খাবারই খাই।”

বাণিজ্য অনুষদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ফুডকোর্টে খেতে বসা ওই অনুষদেরই শিক্ষার্থী রাফিজা খানম বলেন, “মোস্ট অব দ্য টাইম আমরা এখানেই খাই। হলের খাবার নোংরা, মাছ-মাংসে গন্ধ থাকে। ডালে ডাল নেই, শুধু পানি থাকে।”

একই অনুষদের শিক্ষার্থী নাঈমুল ইসলাম বলেন, “নরমালি হলের খাবার খাওয়া হয় না। কারণ- হলের খাবারে কোনো স্বাদ নেই, অস্বাস্থ্যকর।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে নিম্নমানের খাবার পরিবেশন সম্পর্কে জানতে চাইলে উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনকে বলেন, “আমি হলের ক্যান্টিনগুলোতে খেয়েছি এবং এই বিষয়টি আমার নজরে আছে। কোথায়, কোন হলে নিম্নমানের খাবার দেওয়া হচ্ছে, এ ব্যাপারে তথ্য দিলে প্রভোস্টদের খোঁজ নিতে বলবো। প্রভোস্টদের বলে দেবো, হল ক্যান্টিনগুলোর খাবারের সাথে কোনোভাবেই যেনো কম্প্রোমাইজ না করা হয়।”

প্রশাসনের নির্ধারণ করে দেওয়া দামের খাবারে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীদের পুষ্টি চাহিদা পূরণ হয় কী না?- জানতে চাইলে উপাচার্য বলেন, “সেটি পরীক্ষা করে দেখতে হবে যে চাহিদা পূরণ করছে কী না, খাবারে ক্যালোরি কতো আছে। প্রয়োজনে পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের মাধ্যমে পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া হবে।”

এর আগে, হল ক্যান্টিনের খাবারের পুষ্টিগুণ পরীক্ষা করা হয়েছে কী না?- জানতে চাইলে উপাচার্য বলেন, “আমার মনে হয় না।”

হল ক্যান্টিনের খাবারের মান উন্নয়নে বরাদ্দ বা ভর্তুকি দেওয়ার চিন্তা রয়েছে কী না?- এ প্রসঙ্গে উপাচার্য বলেন, “দেখা যাক, বিষয়টি যাচাই করে দেখি আগে। কী আছে, কোন অবস্থায় আছে।”

Comments

The Daily Star  | English

No place for Islamic extremism in Bangladesh

Islamic extremism will never find a place in Bangladesh again, said Chief Adviser Muhammad Yunus recently.

19m ago