কে পঙ্গু, তারা মিয়া না আমাদের বিবেক

চারপাশে এত এত ঘটনা। সেগুলো লেখায় পরিণত করার জন্যে যে মানসিক স্বস্তি দরকার, তা নেই। ফলে অগোছালোভাবে কিছু কথা বলার চেষ্টা করছি।

১. তারা মিয়ার যে রঙিন ছবিটি ডেইলি স্টারের প্রথম পাতায় বড় করে ছাপা হয়েছে, তা আপনারা দেখেছেন। জন্মগতভাবে শারীরিক প্রতিবন্ধী তারা মিয়া। ডান হাত সম্পূর্ণ অচল, ছবি দেখে বুঝতে কারো কষ্ট হয় না। বাম হাতও অস্বাভাবিক রকমের বাঁকানো, স্বাভাবিক আকৃতির চেয়ে বড়। খাওয়া থেকে শুরু করে, টুকটাক কাজ তাকে বাম হাত দিয়েই করতে হয়। তাতেও খুব কষ্ট হয়। হতদরিদ্র, ভিক্ষা করে জীবনযাপন করেন। সেই মানুষটি চাপাতি, হকিস্টিক, লোহার রড তার এই হাত দুটি দিয়ে ধরেছেন। তা দিয়ে পুলিশের উপর আক্রমণ করেছেন। আপনার বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও, পুলিশের কিছু যায় আসে না। পুলিশ তার অচল হাতে কলম দিয়ে লিখে চাপাতি, হকিস্টিক, লোহার রড ধরিয়েছেন।

২. বলা হয়, পুলিশের সমালোচনা যতটা করা হয়, ভালো কাজের ততটা প্রশংসা করা হয় না। আসলে কি তাই? কয়েক দিন আগের ঘটনা। শাহনাজের চুরি যাওয়া মোটরসাইকেলটি উদ্ধার করে দিল পুলিশ। প্রশংসা কি করা হয়নি? কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না যে, অনেক বেশি প্রশংসিত হয়েছেন পুলিশ বাহিনী। যদিও এটাই পুলিশ বাহিনীর স্বাভাবিক কাজ। কিন্তু প্রশংসা সর্বস্তর থেকেই করা হয়েছে।

চ্যানেল ২৪’র একজন নারী কর্মী বনানীতে নিপীড়নেই শিকার হতে যাচ্ছিলেন। তাকে রক্ষা করেছেন যিনি, তিনি একজন পুলিশ অফিসার। পুলিশের এই এসি তখন ডিউটিতে ছিলেন না। কিন্তু মানবিক দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রশংসিত হয়েছে পুরো পুলিশ বাহিনী।

প্রশংসার সঙ্গে একটি বিষয় আলোচনা হয়েছে, সব সময়ই হয়। পুলিশ ‘ইচ্ছে’ করলেই সব পারে। তা বহুবার প্রমাণও হয়েছে।

এই ‘ইচ্ছে’ কখন বা কোন ক্ষেত্রে করে, কোন ক্ষেত্রে করে না, সেটাই সমালোচনার বিষয়। পুলিশ ‘ইচ্ছে’ করেছে পল্টনের হেলমেটধারীদের সনাক্ত করে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে। পুলিশ ‘ইচ্ছে’ করেনি, জিগাতলার হেলমেটধারীদের গ্রেপ্তার করেনি। গণমাধ্যম এই হেলমেটধারী কারও কারও নাম-পরিচয় নিশ্চিত করে দেওয়ার পরও পুলিশ ‘ইচ্ছে’ করেনি। ‘ইচ্ছে’ করা বা না করার পেছনের যে রাজনীতি, সমালোচনা সেকারণেই।

৩. সুবর্ণচরের চার সন্তানের জননী ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর পুলিশের ভূমিকা কী ছিল? একটু নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করে দেখবেন পুলিশের বড় কর্তারা? জানি না দেখবেন কি না! তবে বলবেন, পুলিশ সব অভিযুক্ত আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে। হ্যাঁ, গ্রেপ্তার করেছে। বিভিন্ন অঞ্চলে লুকিয়ে থাকা অভিযুক্তদের খুঁজে খুঁজে গ্রেপ্তার করেছে। অবশ্যই এটা প্রশংসার। কিন্তু ধর্ষণের পর একজন নিপীড়িত নারীর পাশে কি দাঁড়িয়েছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী?

ভিকটিম নাম ধরে বলেছেন, রুহুল আমীনের লোকজন তাকে  হুমকি দিয়েছিল, ধানের শীষে ভোট দেয়ায় হুমকি দিয়েছিল, নৌকায় ভোট দিতে বলেছিল। পুলিশ এজাহারে রুহুল আমীনের নামই লিখল না। ‘পূর্ব শত্রুতার জেরে ধর্ষণ’- লিখে ভিকটিমের নিরক্ষর স্বামীর সই নিয়েছে। ‘পূর্ব শত্রুতার জেরে ধর্ষণ’- এমন কথা ভিকটিম বলেনি। যা বললেন তা না লিখে, যা বললেন না তা কেন লেখা হলো? জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানও স্ববিরোধী রিপোর্ট দিয়েছে। চেয়ারম্যান স্ববিরোধী কথা বলে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। রুহুল আমীনের রাজনৈতিক পরিচয়, নির্বাচন-ভোটের সঙ্গে সম্পর্ক চাপা দেওয়ার একটা সম্মিলিত চেষ্টা দেখা গেল।

৪. নোয়াখালীর কবিরহাটে মা ও সন্তানকে জিম্মি করে এক গৃহবধূকে গণধর্ষণ করা হয়েছে। এখানেও আলোচনার বিষয় পুলিশের ভূমিকা এবং রাজনীতি। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মারামারির মামলায় ভিকটিমের স্বামীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। যে মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, সেদিন আওয়ামী লীগ কর্মীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন বিএনপি নেতা মওদুদ আহমেদ। গণমাধ্যম সংবাদ এভাবেই প্রকাশিত হয়েছিল।

স্থানীয় বিএনপি অভিযোগ করেছে, ভিকটিমের স্বামী বিএনপি করে বলেই তাকে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নির্বাচনের পর তারাই ৩ সন্তানের জননীকে ধর্ষণ করেছে, যারা মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করিয়েছে তার স্বামীকে। এই ধর্ষণকারীদেরও রাজনৈতিক পরিচয় আছে। পরিচয় চাপা দেওয়ার চেষ্টা আছে।

একবার ধর্ষণের শিকার হওয়া নারীর জীবনের যে পরবর্তী টানাহেঁচড়া, সেই নিপীড়ন সীমাহীন। ধর্ষিত হয়েছেন তা প্রমাণের দায়ও এই সমাজ তুলে দেয় ভিকটিমের উপর।ধর্ষক প্রভাবশালী হলে মেডিকেল পরীক্ষায় আলামত পাওয়া যায় না। প্রতিনিয়ত এমনটা ঘটছে। কিছু গণমাধ্যমে আসছে, অধিকাংশই হয়ত আসছে না।

মেডিকেল পরীক্ষায় ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি, কবিরহাটের এই গৃহবধু ধর্ষণের। তিনি নিজে বলছেন তিনজন দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। প্রধান আসামি জাকের হোসেনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।যে জাকের হোসেন তার স্বামীরকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। জাকের হোসেন ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছে। অথচ মেডিকেল পরীক্ষায় প্রমাণ মিলছে না!

৫. একজন তারা মিয়ার ছবি পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। তিনি ছয় মাসের জামিন পাচ্ছেন। ছয় মাস পর পঙ্গু এই মানুষটিকে আবার আদালতে আসতে হবে, না মামলা থেকে অব্যাহতি পাবেন, জানি না।

পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ায় চার সন্তানের জননী পারুল বেগমকে অটোরিকশা কেনার টাকার জন্যে তিন লাখ টাকা দিচ্ছেন সাদা মনের একজন সিঙ্গাপুর প্রবাসী। কবিরহাটের তিন সন্তানের জননী এখন কী করবেন? তাকে বারবার বলে প্রমাণ করতে হবে, তিনি ধর্ষিত হয়েছেন! এই আমাদের সমাজ, এটাই আমাদের বিবেক।

এই দেশে-সমাজে তারা মিয়া, পারুল বেগমদের সংখ্যা আসলে কত? শত, হাজার, লাখ না কোটি?

এরাই বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ জনমানুষ। কৃষক, কৃষকের সন্তান।

এরাই অস্ত্র হাতে সামনে থেকে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন।

তাদের অনেকেই হয়ত লেখাপড়ার সুযোগ বঞ্চিত হয়েছেন। কিন্তু তাদের বোধ আছে, বিবেক আছে। অথচ বিবেক থাকা এবং জাগ্রত থাকার কথা তো ছিল আমাদেরই। যারা লেখাপড়া জানা সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষ।

সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলতে পারি ‘আমরাই শ্রেষ্ঠ, আমরাই সুন্দর’। কারণ কলম আমাদের হাতে, কথা বলার অধিকারও আমাদেরই। সত্য নয়, তাতে কী যায় আসে। অসত্যকে সত্যে পরিণত করতে পারি। হ্যাঁ এই চেষ্টা গোয়েবলস করে গেছেন। নিপীড়িত মানুষ হিটলার-গোয়েবলসদের মূল্যায়ন করতে ভুল করেনি। আমরা যারা ক্ষমতার দাম্ভিকতায় তারা মিয়া, পারুল বেগমদের নিপীড়ন করছি, তারাও আমাদের মূল্যায়ন করতে ভুল করবেন না। ইতিহাস এই সময়কে আপনাকে আপনাদেরকে, আমাদেরকে ‘কালো’ চিহ্ন দিয়ে মনে রাখবে, মূল্যায়ন করবে।

Comments

The Daily Star  | English
Govt Guarantees To Loans of State Enterprises

Sovereign guarantee rules to be revised

The government plans to amend the existing sovereign guarantee guidelines to streamline the process and mitigate fiscal risks if public entities fail to make repayments on time, according to a finance ministry report.

11h ago