সত্যিই কি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে ইউক্রেন
ইউক্রেনে রাশিয়ার রণকৌশল নিয়ে 'ধোঁয়াশা' যেন কাটছেই না। চলমান যুদ্ধ নিয়ে বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর দেশটিকে ঘিরে পশ্চিমের গণমাধ্যম যতটা সরব, ঠিক ততটাই নীরব ক্রেমলিন নিয়ন্ত্রিত রুশ সংবাদমাধ্যম। যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার 'জয়-পরাজয়ের' খবর পড়ে ঠিক বোঝা যায় না কোন দিকে মোড় নিচ্ছে এই সংকট।
আক্রান্ত দেশটির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বিস্তৃত এলাকা যখন রাশিয়ার দখলে অথবা ক্রমাগত ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় একের পর এক ধ্বংস হচ্ছে ইউক্রেনের শহরগুলো, তখন গত ৩ দিনে 'ইউক্রেনীয় সেনাদের জোরালো হামলায় পূর্বাঞ্চলের খারকিভ প্রদেশের কয়েকটি শহর থেকে রুশ সেনাদের সরে যাওয়া'কে রাশিয়ার কৌশলগত সিদ্ধান্ত বলা যাবে? না কি সত্যিই ঘুরে দাঁড়াচ্ছে ইউক্রেন?
ইউক্রেনে যুদ্ধ চলছে প্রায় সাড়ে ৬ মাস ধরে। এর বেশিরভাগ সময় বিশ্ববাসী মূলত পরাশক্তি রাশিয়ার বিজয়বার্তা পেয়েছে। দেশটির পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলে শুধু যে রুশ সেনাদের বিজয় কেতন উড়েছে তাই নয়, রাজধানী কিয়েভসহ এর পশ্চিমাঞ্চলের শহরগুলোও বিধ্বস্ত হয়েছে ভয়াবহভাবে।
এমন পরিস্থিতিতে গতকাল শনিবার রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা আরটি জানায়, 'ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণের মুখে রুশ সেনারা সীমান্তবর্তী খারকিভ প্রদেশের কয়েকটি এলাকা থেকে সরে গেছে।'
এতে আরও বলা হয়, গত বৃহস্পতিবার ইউক্রেনীয় সেনাদের জোরদার হামলার মুখে রুশ সেনাদের সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত এসেছে। তবে এই সিদ্ধান্ত এসেছে মূলত বিদ্রোহীদের দখলকৃত দোনেৎস্ক অঞ্চলে রুশ সেনাদের 'একত্রিত' করার জন্য।
গতকাল রুশ সেনাবাহিনীর বার্তায় বলা হয়, 'বিশেষ সামরিক অভিযানের লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে সেনাদের (খারকিভ প্রদেশের) বালাকলিয়া ও ইজিউম শহর থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। দোনেৎস্কের দিকে সেনা শক্তি বাড়ানোই এর উদ্দেশ্য।'
প্রশ্ন ওঠে, প্রকাশ্যে এমন বার্তা দিয়ে মস্কো গোপনে কোনো 'বড় হামলা'র প্রস্তুতি নিচ্ছে না তো?
একই দিনে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বার্তায় বলা হয়েছে, ইউক্রেনীয়দের 'শক্তিশালী' কামান, ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান হামলা থেকে রুশ সেনাদের রক্ষায় তাদের সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত এসেছে।
সেই বার্তায় দাবি করা হয়, রুশ সেনারা গত ৩ দিনে ১০০'র বেশি ইউক্রেনীয় সামরিকযান, কামান ধ্বংসের পাশাপাশি ২ হাজারের বেশি ইউক্রেনীয় ও বিদেশি যোদ্ধাকে হত্যা করেছে।
খারকিভ প্রদেশ থেকে সরিয়ে রুশ সেনাদের দোনেৎস্ক অঞ্চলে 'মোতায়েন' করা হয়েছে বলেও রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে সংবাদমাধ্যমকে জানানো হয়।
রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন দোনেৎস্ক গণপ্রজাতন্ত্রের প্রধান ডেনিস পুলিলিন রুশ সংবাদ সংস্থা তাসকে বলেছেন, 'যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতি উত্তেজনাকর হলেও তা আমাদের নিয়ন্ত্রণে।'
'ইউক্রেনীয়দের প্রবল বাধা সত্ত্বেও দোনেৎস্ক বাহিনী এগিয়ে যাচ্ছে' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'দোনেৎস্ক প্রদেশের উগলেগোরস্ক শহরের কাছে শত্রু বাহিনী ন্যাটোর সরবরাহ করা ও পোল্যান্ডের তৈরি একটি ১৫৫ মিলিমিটার কামান ধ্বংস করা হয়েছে।'
তার মতে, ইউক্রেনের কমান্ডাররা যুদ্ধক্ষেত্রে অপ্রশিক্ষিত যোদ্ধা পাঠাচ্ছে। যে কারণে ইউক্রেনীয় বাহিনীর অনেক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে।
সেটা সত্য হলে প্রশ্ন জাগে, রাশিয়া ও বিদ্রোহী দোনেৎস্ক গণপ্রজাতন্ত্রের এমন বক্তব্যে তাদের দুর্বলতাই ফুটে উঠছে না তো? না কি এটাও মস্কোর কোনো কৌশল?
গত ৩ দিনে ইউক্রেনের 'অপ্রশিক্ষিত যোদ্ধাদের' আক্রমণে বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর রাশিয়ার সুপ্রশিক্ষিত সেনাদের পিছু হটার ঘটনা চলমান যুদ্ধ নিয়ে নতুন হিসাব-নিকাশের জন্ম দিচ্ছে না তো?
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় স্পষ্টতই স্বীকার করেছে যে রুশ সেনাদের ওপর ইউক্রেনীয়দের হামলা জোরদার হচ্ছে। এমনকি, একটি 'ইউক্রেনীয় কামান' ধ্বংসের দাবি যেন 'পর্বতের মূষিক প্রসবে'র মতোই শোনায়।
গতকাল রুশ সেনাদের খারকিভ প্রদেশের কয়েকটি শহর থেকে পিছু হটা নিয়ে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার প্রতিবেদনে যুদ্ধক্ষেত্রে 'উল্টো স্রোতের' প্রসঙ্গ তোলা হয়েছে।
এতে বলা হয়, পূর্ব ইউক্রেনে রাশিয়াপন্থি সাবেক কমান্ডার ইগোর গিরকিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রামে ইউক্রেনের শহরগুলো থেকে রুশ সেনাদের সরিয়ে নেওয়াকে 'বড় পরাজয়' হিসেবে মন্তব্য করেছেন।
প্রতিবেদন অনুসারে, ইউক্রেনের পূর্ব সীমান্তে রুশ সেনারা যেমন সমস্যায় পড়ছেন, তেমনিভাবে রুশপন্থি বিদ্রোহীরাও রণাঙ্গনের বিভিন্নস্থানে নানান ঝামেলায় পড়ছেন।
এতে আরও বলা হয়, ইউরোপে রপ্তানির জন্য জ্বালানি তেলের দাম নিয়ে ব্রাসেলসের সঙ্গে মস্কোর চলমান দর কষাকষির পরিপ্রেক্ষিতে কিয়েভের ওপর চাপ এসেছে যে আসন্ন শীতের আগেই রুশ বাহিনীকে শক্তিশালী জবাব দেওয়া হোক।
সম্প্রতি, কিয়েভে ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রো কুলেবা বলেছেন, তার দেশের সেনারা তাদের হাতে যে অস্ত্র আছে তা দিয়েই রুশ বাহিনীকে পরাজিত করতে সক্ষম।
'আবারও বলছি, আমাদের যত বেশি অস্ত্র দেওয়া হবে আমরা তত দ্রুত জয় লাভ করবো। তত দ্রুত এই যুদ্ধ শেষ হবে', যোগ করেন কুলেবা।
গতকাল কিয়েভে এসে জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্নালেনা বায়েরবক জানান, তার দেশ রুশ সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়া অব্যাহত রাখবে।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে আগ্রাসনের প্রায় সপ্তাহখানেক পর রাশিয়ার ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ সামরিক বহর রাজধানী কিয়েভের উপকণ্ঠে পৌঁছে গিয়েছিল। তখন অনেকে মন্তব্য করেছিলেন, কিয়েভ দখল মস্কোর জন্য সময়ের ব্যাপার মাত্র।
কিন্তু, 'রসদ সরবরাহে বাধা পড়ায়' অথবা কৌশলগত কারণে রুশ বাহিনীকে কিয়েভ অঞ্চল থেকে সরে যেতে হয়েছিল। সেসময় ক্রেমলিন বলেছিল, পূর্ব ইউক্রেনে রুশ অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় মনোযোগ বাড়াতে সেনাদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
সেই ঘটনার ৬ মাস পর এখন দেখা যাচ্ছে, রুশ সেনারা ইউক্রেনে তাদের নিয়ন্ত্রিত দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলেও 'বেশ চাপে' পড়েছে। মস্কো এখন রাষ্ট্রীয়ভাবে ইউক্রেনের জোরালো হামলার কথা স্বীকার করে নিচ্ছে।
এমনকি, ইউক্রেনীয়দের হামলা থেকে বাঁচতে বিধ্বংসী অস্ত্রধারী রুশ সেনাদের 'পিছু হটার' বিষয়টিকে 'রি-গ্রুপিং' শব্দ দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করছে।
তবে, যুদ্ধে সত্যিই ইউক্রেন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে কি না, তা সময়ই বলতে পারবে।
Comments