মানবতার বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন ফারাজ

জীবনটা যদি এত নির্মমভাবে কেড়ে না নেওয়া হতো, তাহলে ফারাজ আইয়াজ হোসেন হতেন ত্রিশ ছুঁই ছুঁই এক তরুণ। কেমন হতো তার জীবন? ফারাজ কি তার ভাই জারাইফের মতোই মা সিমিন রহমানের (ট্রান্সকম গ্রুপের বর্তমান সিইও) পাশে থেকে নানা লতিফুর রহমানের প্রতিষ্ঠানে যোগ দিতেন?—যে মা গত নয় বছর ধরে সন্তান হারানোর অসহনীয় কষ্ট বুকে নিয়ে বেঁচে আছেন।
ফারাজ কি তার প্রিয় খেলা অ্যাথলেটিক্স আর ভলিবলে নিজেকে আরও উন্নত করতেন? কিংবা এখনো কি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ঘোর সমর্থকই থাকতেন? মেতে থাকতেন বন্ধুদের সঙ্গে দুষ্টুমিতে? অথবা বিয়ে করে জীবনের নতুন এক অধ্যায় শুরু করতেন?
এসব প্রশ্ন নিঃসন্দেহে তার প্রিয়জনদের মনে অসহ্য যন্ত্রণা দেয়। কারণ, তারা এমন এক বাস্তবতা সঙ্গে নিয়ে বেঁচে আছেন, যেখানে এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর আর কখনো মিলবে না।
তরুণদের যেসব সাধারণ স্বপ্ন থাকে, ফারাজের ছিল তারচেয়ে অনেক বেশি। তিনি চাইতেন পৃথিবীতে পরিবর্তন আনতে, মানুষের জন্য কাজ করতে—বিশেষ করে তাদের জন্য, যারা দুর্বল ও অসহায়। মাত্র ২০ বছরের ছোট্ট জীবনে তিনি সত্যিকার অর্থেই নিজের নামের অর্থকে সার্থক করে তুলেছিলেন।
এক ওয়েবসাইট অনুসারে, 'ফারাজ' অর্থ এমন কেউ, যার হৃদয় ভালোবাসায় পূর্ণ এবং যিনি তার বন্ধুদের জীবনে সম্প্রীতি আর শান্তি নিয়ে আসেন। ফারসি ভাষায় 'ফারাজ' শব্দের অর্থ 'মহিমান্বিত' এবং 'উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন'।
ফারাজের মা-বাবা কি কখনো ভাবতে পেরেছিলেন, ছেলের নামই একদিন তার জীবনের গল্প আর ভাগ্যের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠবে?
ছোট্ট কিন্তু অমূল্য জীবনে ফারাজ সবসময় বন্ধুদের পাশে দাঁড়াতে একধাপ এগিয়ে থাকতেন। সহপাঠীদের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন স্বভাব নেতা এবং সবার প্রিয়। কারণ তিনি ছিলেন দয়ালু ও নম্র। পারিবারিকভাবে সুবিধাসম্পন্ন জীবনে বড় হলেও তিনি ছিলেন বিনয়ী। হাইস্কুলে তিনি ক্লাসের সেরা শিক্ষার্থী—পড়াশোনায় বরাবরই ভালো। অন্যদিকে খেলা—বিশেষ করে অ্যাথলেটিকস ও ভলিবলে দারুণ পারদর্শী। ছিলেন একজন সম্পূর্ণ মানবিক মানুষ, সব দিকেই যার দক্ষতা ছিল।
এমনকি আটলান্টার এমরি ইউনিভার্সিটিতেও নিজের মেধার সাক্ষর রেখেছেন, ছিলেন তুখোড় ছাত্র। তার ভাই জারাইফ ছিলেন তার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। তিনি তার নানাভাই লতিফুর রহমানের মতো হতে চেয়েছিলেন। কাকতালীয়ভাবে, ফারাজের চলে যাওয়ার ঠিক চার বছর পর একই তারিখে—১ জুলাই—তিনিও পৃথিবী ছেড়ে চলে যান, তার প্রিয় নাতি 'ছোটু'কে হারানোর তীব্র কষ্ট নিয়েই। ফারাজ ছিল তার নানি শাহনাজ রহমান (ট্রান্সকম গ্রুপ এর বর্তমান চেয়ারপারসন) এর চোখের মণি।
ফারাজের আদর্শ ছিলেন তার মা। ছেলের মৃত্যুর কিছুদিন পর ফারাজের মা আমাকে বলেছিলেন, ওর মধ্যে ভুল খুঁজে পাওয়া কঠিন।
নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও দুই বন্ধুকে ফেলে যেতে রাজি হননি ফারাজ। তাকে যারা চিনতেন, এই ঘটনায় তারা মোটেও আশ্চর্য হননি।
২০১৬ সালের ১ জুলাই হোলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলায় ফারাজসহ আরও ২২ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সেই ঘাতক দল নাকি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল—যারা প্রমাণ করতে পারবে যে তারা মুসলমান, তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখা হবে। সেদিন নিহত বিদেশিদের মধ্যে ছিলেন সাতজন জাপানি, নয়জন ইতালীয় ও একজন ভারতীয়। তাদের সবাই বাংলাদেশের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন।
কিন্তু তারা ফারাজকে রেহাই দেয়নি। ফারাজ একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম ছিলেন এবং পবিত্র কোরআন সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞান ছিল। তাকে হত্যা করা হয়েছিল কারণ, তিনি তার দুই স্কুলবন্ধু অবিন্তা কবির ও তারিশি জৈনকে ছেড়ে আসেননি। এই দুই তরুণীও স্বপ্ন দেখতেন পৃথিবীতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার।
ফারাজের মা যখন খবর পান যে 'সন্ত্রাসীরা বাংলাদেশিদের ছেড়ে দিচ্ছে', তার বুক হিম হয়ে যায়। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, ফারাজ আর তার কাছে ফিরে আসবে না। কারণ তিনি তার ছেলেকে চিনতেন। যাই ঘটুক না কেন, সে কখনোই তার বন্ধুদের ফেলে আসবে না, কোনো পরিস্থিতিতেই না।
ফারাজ সেদিন পুরো বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন—ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসের মুখেও বন্ধুত্ব, আনুগত্য ও নৈতিকতা কেমন হয়। সেদিন জঙ্গিদের প্রতিরোধ করায় ইশরাত আখন্দ নামে একজন বাংলাদেশি তরুণীকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
ফারাজ ছিলেন ইসলাম ধর্মে গভীরভাবে বিশ্বাসী, যিনি নামাজ পড়তেন, রোজা রাখতেন এবং বহুবার ওমরাহ পালন করেছেন। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে সম্মান এবং জাতি, ধর্ম, বর্ণ—নির্বিশেষে সাম্যে বিশ্বাস করতেন। খোলা মনে গ্রহণ করেছিলেন মানবতাকে। ইসলামের যে সহিংস, অনমনীয় ও পশ্চাৎপদ চিত্র মূলধারার পশ্চিমা বিবরণে প্রায়শই তুলে ধরা হয়, ফারাজকে তার সঙ্গে মেলানো যাবে না। বরং তিনি ইসলাম ধর্মের শান্তিপূর্ণ, প্রগতিশীল ও সহনশীল রূপকে সামনে এনেছিলেন। ফারাজের সাহসিকতার খবর যখন ছড়িয়ে পড়ে, তখন সারা বিশ্বের মানুষ তাকে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় সম্মান জানায়। ভূষিত হয়েছেন মাদার তেরেসা আন্তর্জাতিক পুরস্কারে (২০১৬), গার্ডেন অব দ্য রাইটিয়াস ওয়ার্ল্ডওয়াইড থেকে পেয়েছেন স্বীকৃতি। তরুণ বাংলাদেশিদের মধ্যে সাহত, সহানুভূতি ও মানবিকতার চেতনাকে উৎসাহিত করতে এবং অসাধারণ সাহসিকতার স্বীকৃতি জানাতে প্রবর্তিত হয় ফারাজ কারেজ অ্যাওয়ার্ড ২০১৬।
আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করছি যা নারীবিদ্বেষ, ধর্মান্ধতা এবং 'অন্যকে' ভিন্ন ভাবার উন্মত্ততায় মারাত্মকভাবে ক্ষতবিক্ষত। এটি এমন এক পৃথিবী যেখানে সহানুভূতি দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে আর বিভেদ দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করছে। এই নিষ্ঠুর ও অস্থির সময়েও ফারাজের মানবতাবোধ, যা তিনি অন্য সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছিলেন তা আশা, সম্প্রীতি ও সুস্থ চিন্তার এক গভীর বার্তা দেয়।
আশা মেহরীন আমিন, জয়েন্ট এডিটর, দ্য ডেইলি স্টার
Comments