ইতিহাসের যত নারী ডিটেকটিভ

গোয়েন্দা বা ডিটেকটিভ শব্দটা শুনলেই মাথায় আসে ছয় ফুট তিন ইঞ্চি উচ্চতার চৌকো মুখের পুরুষের ছবি। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণশক্তি সম্পন্ন, ছদ্মবেশ নিতে যার জুড়ি নেই, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে আর্থার কোনান ডয়েলের হাত ধরে ছাপার অক্ষরে উপস্থিত হয় শার্লক হোমস।

শার্লক হোমস কিংবা আগাথা ক্রিস্টির হারকিউল পয়রো অথবা আমাদের বাংলা সাহিত্যে ফেলুদা, ব্যোমকেশ চরিত্রগুলো গোয়েন্দা বলতে আমাদের মানসপটে পুরুষ অবয়ব তৈরি করে দিয়েছে।

অথচ বিশ্বে যখন কাল্পনিক এই পুরুষ গোয়েন্দা চরিত্রদের দাপট চলছিল, ঠিক একই সময়ে অ্যান্তোনিয়া মোসার, কেট ইস্টন, মড ওয়েস্ট, মে স্টোরি, ও অ্যানেট কার্নারের মতো নারীরা ব্রিটেনে তাদের নিজস্ব গোয়েন্দা এজেন্সি চালাতেন। দেশে-বিদেশে সেলিব্রিটিও হয়েছিলেন তারা।

জেনা স্কট-আর্চারের মতো নারী প্রায় ৫০ বছর ধরে সফলভাবে গোয়েন্দাগিরি চালিয়েছেন। বিশ্ব মঞ্চে শীর্ষস্থানীয় নারী প্রাইভেট ডিটেকটিভ ছিলেন তিনি।

একটা সময় পর্যন্ত ভাবা হতো গোয়েন্দগিরি নারীদের জন্য নয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় নারীদের অন্তদৃষ্টি, কল্পনা ও সহানুভূতিশীল মনোভাব গোয়েন্দাগিরির জন্য অনেক বেশি উপযোগী।

গবেষণায় দেখা গেছে, অপরিচিতদের কাছ থেকে সহজে তথ্য সংগ্রহ, সন্দেহ ও হুমকির ঝুঁকি এড়াতে নারীরা বেশ সফল। পর্যবেক্ষক হিসেবেও নারীরা তুলনামূলক বেশি দক্ষ।

ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ ক্যাটলিন ডেভিসের এক গবেষণায় এমন সব বিষয় এসেছে। তার মতে, কর্মক্ষেত্রে যোগ্যতায় খ্যাতি অর্জন করলেও সামাজিক প্রতিকূলতার কারণে সংখ্যায় পিছিয়ে ছিলেন নারী গোয়েন্দারা। একুশ শতকের শুরুতে ব্রিটেনে প্রাইভেট ডিটেকটিভদের মধ্যে মাত্র আট শতাংশ ছিল নারী। 

১৮৫০ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ব্রিটেনের ইতিহাসে যতো নারী গোয়েন্দাদের পাওয়া গেছে, তাদের ব্যক্তিজীবন ও কর্মজীবন সম্পর্কে অনুসন্ধান চালিয়ে ক্যাটলিন একত্রিত করেছেন—'দ্য সিক্রেট হিস্ট্রি অব ফিমেল স্লিউথ' বইয়ে। ৩২০ পৃষ্ঠার বইটি প্রকাশিত হয় গত বছরের অক্টোবরে, প্রকাশক হিস্ট্রি প্রেস।

মিসেস জেনকিন্স: প্রথম নারী গোয়েন্দা

১৮৪০ সালের শেষ দিকে ব্রিটিশ মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান চার্লস ফ্রেডেরিক ফিল্ড প্রথম নারী গোয়েন্দা হিসেবে মিসেস জেনকিন্সকে নিয়োগ দেন।

এলিজাবেথ জয়েস

লন্ডন সিটি পুলিশের নিযুক্ত প্রথম নারী অনুসন্ধানকারী তিনি। অপরাধীদের ধরতে ১৮৫০ সালে রেলওয়ের ওয়েটিং রুমে ছদ্মবেশে কাজ করতেন।

সারাহ ডুনাওয়ে

১৮৬০ সালে আলোচিত লন্ডনের ওয়েস্ট ইন্ডিয়া ডক থেকে চিনি চুরি মামলার তদন্ত করে খ্যাতি অর্জন করেন সারাহ।

মার্গারেট সান্ডার্স-ক্লাবনোজ

১৮৭০ সালে লন্ডনে ছেলের ছদ্মবেশে চোরের ঘাঁটিতে ঢুকে অপরাধীদের ধরিয়ে দেন। ওই সময় ব্রিটিশ পুলিশ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের জন্য কাজ করেন তিনি।

আন্তোনিয়া মোসার

অ্যান্তোনিয়া মোসার

১৮৮৮ সালে আলোচিত 'ওয়াইট চ্যাপেল মার্ডারের' সময় গোয়েন্দার কাজ শুরু করেন। ১৯০৫ সালে প্রথম নারী গোয়েন্দা হিসেবে নিজের এজেন্সি খোলেন। 

মড ওয়েস্ট

মড ওয়েস্ট

বলা হয়, বিখ্যাত গোয়েন্দা গল্প লেখক আগাথা ক্রিস্টিকেও মুগ্ধ করেছিলেন মড ওয়েস্ট।। ১৯০০ সালে গোয়েন্দা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ওই সময় ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বিখ্যাত নারী গোয়েন্দা ছিলেন তিনি।

মে স্টোরি

কয়লা খনির শ্রমিকের মেয়ে ছিলেন মে। ইন্টারন্যাশনাল ডিটেকটিভ এজেন্সি চালাতেন তিনি। তার সব নারী কর্মীরা মার্টশাল আর্টে পারদর্শী ছিল এবং নিজেরাই মোটরসাইকেল চালিয়ে তদন্তে বের হতেন।

জেনা স্কট-আর্চার

জেনা স্টক আর্চার ও তার টিম

তার প্রজন্মের সেরা গোয়েন্দাদের একজন ছিলেন। বিশ্ব গোয়েন্দা সংস্থার প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট তিনি।

জেন জারভি

জেন জারভি

তাকে বলা হয় 'ডেথ ইনভেস্টিগেটর'। হত্যা মামলার তদন্ত করেন তিনি। ২০২২ সালে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্রিটিশ ইনভেস্টিগেটর- এবিআই'র সেরা গোয়েন্দা খেতাব পান জারভি।

এই নারী গোয়েন্দাদের অনেকেই পুরুষ ডিটেকটিভদের প্রতিদ্বন্দ্বী ও ঈর্ষার কারণ ছিলেন। ক্যাটলিনের গবেষণায় দেখা যায়, এক সময় যাদের 'মিসেস শার্লক হোমস' হিসেবে উপহাস করা হতো, তারাই ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে চুরি, জালিয়াতি থেকে শুরু করে রোম্যান্স স্ক্যাম, খুন—সব ধরনের অপরাধের তদন্ত করেছে। বাস্তব জীবনে, নারীরা পুরুষদের মতোই দীর্ঘ সময় ধরে গোয়েন্দগিরিতে আছেন।

১৮৫০ এর দশকে ব্রিটেনে নবগঠিত গোয়েন্দা পুলিশ গুপ্তচরবৃত্তির জন্য অনানুষ্ঠানিকভাবে কয়েকজন নারীকে নিয়োগ দেয়। এর প্রায় ৩০ বছর পর নারী গোয়েন্দাদের কার্যক্রম পত্র-পত্রিকায় চলে আসা শুরু হয়।

১৯ শতকের প্রথম দশকে নারী গোয়েন্দারা নিজস্ব এজেন্সি চালু করেন এবং সেখানে পুরুষ এজেন্ট নিয়োগ দেন। পরবর্তী দশকে লন্ডনের বেকার স্ট্রিটে নারী গোয়েন্দাদের জন্য একটি ট্রেনিং স্কুল খোলা হয়।

১৯৩০ এর দশকে শুধু পশ্চিম লন্ডনেই ১১টি প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সির প্রধান ছিলেন নারী।

পরবর্তীতে নারী গোয়েন্দাদের কার্যক্রম কিছুটা কমে এলেও, গত শতাব্দীর শেষ দিকে দেখা গেছে, ব্রিটেনের প্রতি দশ গোয়েন্দার একজন নারী এবং বর্তমানে নারী গোয়েন্দার সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশের কাছাকাছি।   

নারীদের বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রমের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতে গিয়েই নারী গোয়েন্দাদের বিষয়টি মাথায় আসে ক্যাটলিনের। ১৭ শতকের 'কুইন্স অব দ্য আন্ডারওয়ার্ল্ডে'র নারী দস্যু কিংবা ১৯ শতকের নারী গ্যাং 'দ্য ফর্টি এলিফ্যান্টস'দের ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে মালামাল চুরির রহস্য ভেদ করতে কাজ করেন নারী গোয়েন্দারা। এই ডিটেকটিভদের কর্মকাণ্ড ছিল মুগ্ধ করার মতো। কোনো বাহিনীর সদস্য না হয়েও, তারা যেভাবে দোকানের চুরির ঘটনা উন্মোচন করেছেন, অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে আদালতে সাক্ষ্য পর্যন্ত দিয়েছেন, তারা অবশ্যই ছিলেন বজ্রকঠিন দৃঢ় প্রত্যয়ের নারী।

ক্যাটলিন ডেভিস ও নারী গোয়েন্দাদের ইতিহাস নিয়ে তার লেখা বই

তখন তিনি খোঁজা শুরু করলেন, কারা ছিলেন এই নারী গোয়েন্দা কিংবা তাদের জীবনটাই বা কেমন ছিল। মিস মার্পল, কর্ডেলিয়া গ্রে, চার্লিস অ্যাঞ্জেলসের মতো কাল্পনিক ডিটেকটিভদের নাম জানলেও, বাস্তবের কোনো নারী ডিটেকটিভের নাম তখনো তিনি জানতেন না, তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতেন না।

এই কৌতূহল তাকে পরিচালিত করে নারী গোয়েন্দাদের নিয়ে গবেষণায়, যে গবেষণা করতে গিয়ে তিনি নিজেই একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ হয়ে ওঠেন, আর লিপিবদ্ধ করে ফেলেছেন ইতিহাসের আড়ালে থাকা নারী ডিটেকটিভদের।

তথ্যসূত্র: দ্যা গার্ডিয়ান, দ্যা হিস্ট্রি প্রেস, ক্যাটলিন ডেভিস ডট কম

 

Comments

The Daily Star  | English

Unveil roadmap or it’ll be hard to cooperate

The BNP yesterday expressed disappointment over the absence of a clear roadmap for the upcoming national election, despite the demand for one made during its recent meeting with Chief Adviser Prof Muhammad Yunus.

6h ago