আন্দালুস থেকে বাংলা: মাতৃভাষার জন্য যত সংগ্রাম

ছবি: সংগৃহীত

মানুষের সভ্যতা ও অস্ত্বিত্বের পরিচয় তৈরি হয় ভাষার মাধ্যমে। যে ভাষা বলে, কয়ে মানুষ বড় হয়, পার করে তার শৈশব, যৌবন ও বৃদ্ধকাল সেই ভাষা যে কেবল কয়েকটি বর্ণ, শব্দ, বাক্যে আবদ্ধ নয় এই বিষয়টি মানুষের জানা।

তাই সদূর স্পেন, দক্ষিণ আফ্রিকা কিংবা যুক্তরাষ্ট্র অথবা পাশের রাষ্ট্র ভারত ও আমাদের দেশ বাংলাদেশ; ভাষার অধিকার নিয়ে আন্দোলন হয়েছে যুগে যুগে।

ভাষাকে কেন্দ্র করে পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন দেশে ঘটে যাওয়া আন্দোলন নিয়ে এই লেখা।

স্পেন

খুব বেশিদিন আগে নয়, ২০২১ সালে স্পেনের সেনেট দেশটির আন্দালুসিয়ান ভাষাকে 'প্রাকৃতিক ভাষা' হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। শুধু তাই নয়, ওই ঘোষণায় বলা হয় যে আন্দালুসিয়ান ভাষা স্পেনের অন্যান্য ভাষার তুলনায় কোনো অংশে ছোট নয় বরং দেশটির অন্যতম একটি ভাষা। একুশ শতকে ভাষাকে কেন্দ্র করে হওয়া এই আন্দোলনটি রাজপথে হয়নি, হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স (টুইটার) ও ফেসবুকে।

তবে এই আন্দোলনের শুরু লেখক ও গবেষকদের হাত ধরে। 'সোসাইটি ফর দ্য স্টাডি অব আন্দালুসিয়ান' নামের একটি সংগঠনের সদস্যরা প্রথম দাবি করে যে তাদের সদস্যদের বেশিরভাগই আন্দালুসিয়ান ভাষায় কথা বলে। আর আন্দালুসিয়ান ভাষা আদতে কোনো উপভাষা নয় বরং এটি তাদের ঐতিহ্য-ইতিহাসেরই অংশ। 'সোসাইটি ফর দ্য স্টাডি অব আন্দালুসিয়ান' সংগঠনটি স্পেনের ইতিহাস ও সংস্কৃতি রক্ষার্থেই কাজ করতো। তাদের এই দাবি স্পেনের 'ডিজিটাল ফ্রিডম' পত্রিকাটি বামপন্থি দাবি হিসেবে আখ্যায়িত করে।

তবে ২০১৭ সালে আন্দালুসিয়ান ভাষায় 'দ্য লিটল প্রিন্স' নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। এই বইটি নিয়ে অনেকেই এক্স (টুইটারে) ট্রল করে। এই ট্রলের প্রতিউত্তর ও আন্দালুসিয়ান ভাষার স্বীকৃতির জন্য ফেইসবুকে একটি গ্রুপ খোলা হয়। এই গ্রুপটির মাধ্যমে বহু লেখক, সাহিত্যিক, গবেষকরা এগিয়ে আসে। ফলে গঠিত হয় আরও দুটি সংগঠন 'এর প্রিন্সিপিতো আন্দালু' ও 'আন্দালুগিকস'।

আন্দালুসিয়ান ভাষায় ট্রান্সক্রিপ্ট, বানান ও ভাষান্তরের জন্য কাজ করে এসব সংগঠন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলা এই প্রয়াস গন্তব্যে পৌঁছায় ২০২১ সালে স্পেনের সেনেটে গিয়ে।

দক্ষিণ আফ্রিকা

স্কুল শিক্ষার্থীদের হাত ধরে শুরু হয় দক্ষিণ আফ্রিকার ভাষা আন্দোলন। গাউটাংয়ের (তৎকালীন ট্রান্সভাল প্রদেশ) জোহানেসবার্গ শহর, যে শহরে জন্মেছিলেন গ্র্যাম স্মিথ ও কাগিসো রাবাদার মতো ক্রিকেটাররা। সেখানে ১৯৭৬ সালের জুনের ১৬ তারিখে শুরু হয় এই আন্দোলন।

দেশটির প্রাদেশিক শাসনে কর্তৃপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকার স্কুলে বাধ্যতামূলকভাবে শ্বেতাঙ্গ ডাচদের জার্মান-ডাচ ভাষার মিশ্রণ চালু করে। সরকারের এই সিদ্ধান্ত স্কুল শিক্ষার্থীরা মেনে নেয়নি। প্রতিবাদে তারা রাস্তায় নেমে আসে। মাতৃভাষা হিসেবে 'জুলু' আর লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা হিসেবে ইংরেজিই ছিল আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবি। এর পরিপ্রেক্ষিতে অনুষ্ঠিত হয় প্রতিবাদ সভা। এসব সভার এক পর্যায়ে প্রতিবাদকারী শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি ছোড়ে সরকার। শিশু-কিশোরসহ প্রায় ১০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয় তখন। ভাষার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার এই আন্দোলনকে বলা হয় 'সুয়েটো অভ্যুত্থান'। আর ট্র্যাজেডির দিনটিকে বলা হয় 'ডে অব চাইল্ড'। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের কার্যক্রম আরও বেড়ে যায়। দক্ষিন আফ্রিকায় দিনটি বিশেষ স্মৃতির মধ্য দিয়ে পালন করা হয়।

কানাডা

কানাডার পূর্ব অংশের অঙ্গরাজ্য কুইবেকের রাজনীতিতে ভাষা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। ১৯৮০ সালের ২০ মে প্রথমবার এবং ১৯৯৫ সালের ৩০ অক্টোবর দ্বিতীয়বারের মতো ভাষার জন্য আন্দোলন করে তারা। ফলে কুইবেক রাজ্যের ফ্রেঞ্চবাসীরাও এক সময় ভাষার প্রশ্নে স্বাধীনতা চেয়েছিল।

লাটভিয়া

আমাদের মতো ভাষার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের পরিচয় দিয়েছে লাটভিয়ানরা। লাটভিয়ান-রাশান ভাষার সংঘাতের কারণে, রাশান ভাষাকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য ২০১২ সালে গণভোটের আয়োজন করা হয়। এই গণভোটে লাটভিয়ানরা প্রধান ভাষা হিসেবে রুশ ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে প্রত্যাখ্যান করে।

যুক্তরাষ্ট্র

বলা হয়ে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস, পৃথিবীর সবচেয়ে বর্বর ইতিহাস কেননা সেখানে জুড়ে আছে আদিবাসীদের ওপর সংঘটিত ঔপোনিবেশিক দমন-পীড়ন ও নিপীড়ন। ফলে তাদের ভাষাও মারা গেছে এই ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসকদের হাতে।

২০ শতকের ষাট-সত্তুরের দশকে নাগরিক অধিকার আন্দোলনের সময় এই নেটিভ আমেরিকানদের ভাষা রক্ষার দাবিও ওঠে আসে। সংঘবদ্ধ সেই আন্দোলনের প্রচেষ্টা ও প্রয়াসের ফলস্বরূপ দীর্ঘ ২০ বছর পর ১৯৯০ সালের ৩০ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রে আইন পাশ হয়। এই আইনের অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের আদিবাসী ভাষা রক্ষা এবং সংরক্ষণ নিশ্চিত করা হয়। ফলে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক অঙ্গরাজ্যে ইংরেজির আধিপত্য কমেছে।

ভারত

দক্ষিণ ভারতে ভাষার জন্য প্রথম রাজনৈতিক প্রতিবাদ হয় ১৯৩৭ সালে। তৎকালীন ব্রিটিশ রাজের মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির স্থানীয় ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস সরকার স্কুলে হিন্দি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করলে এ আন্দোলন শুরু হয়।

তিন বছরব্যাপী এই আন্দোলন অনশন থেকে শুরু করে সমাবেশ, এমনকি সহিংস প্রতিবাদ পর্যন্ত গড়ায়। কঠোরভাবেই এই আন্দোলনটি দমন করে সরকার। আন্দোলনে মারা যায় দুজন আর সরকার কর্তৃক আটক করা হয় নারী-শিশুসহ প্রায় ১ হাজার ১৯৮ জন।

১৯৩৯ সালে কংগ্রেস সরকার পদত্যাগের পর ১৯৪০ সালে সেসময়ের মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির ব্রিটিশ গভর্নরের হস্তক্ষেপে বাধ্যতামূলক হিন্দি শিক্ষার আইন প্রত্যাহার করা হয়।

ভারতের মাদ্রাজে হিন্দিবিরোধী বিক্ষোভ

ব্রিটিশ আমলের চেয়ে বড় আকারে আন্দোলন হয় ১৯৬৫ সালে। তখন হিন্দিকে একমাত্র সরকারি ভাষা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তখনও ক্ষমতায় ভারতীয় কংগ্রেস। সে বছর, ২৬ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় সরকারের এমন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন শুরু করে সাধারণ মানুষ, দখল করে নেয় রাজপথ। প্রায় দুই মাস ধরে মাদ্রাজজুড়ে চলা এই আন্দোলনে প্রাণ হারায় শতাধিক সাধারণ মানুষ।

গোটা দক্ষিণ ভারত বিশেষভাবে তামিলনাড়ু উত্তপ্ত হয়ে ওঠে তখন। প্রতিবাদে আত্মাহুতির ঘটনাও ঘটে যা তামিলনাড়ুর বিধানসভা নির্বাচনেও প্রভাব রাখে।

আন্দোলনের পক্ষ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলো ১৯৬৭ সালের এই বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করে। ফলে কংগ্রেসের পরিণতি সেখানেই নিশ্চিত হয় ক্ষমতায় আসে তামিলনাড়ুর দল 'দ্রাবিড়া, মুন্নেত্রা কাজাঘম' বা ডিএমকে।

এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে মাদ্রাজ এবং আন্নামালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা। এর রেশ ধরে ১৯৬৭ সালে হিন্দির সঙ্গে ইংরেজিকেও সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। বর্তমানে ভারতে ২২টি ভাষা সরকারের তালিকাভুক্ত যেখানে ভারতে মোট ভাষার সংখ্যা ৪৫৬টি।

দক্ষিণ ভারত ছাড়াও আসামে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল ১৯৬১ সালে। সেসময়ের প্রাদেশিক সরকার অহমীয় ভাষাকে আসামের একমাত্র সরকারি ভাষা করার সিদ্ধান্ত নিলে আন্দোলনটি হয়। ভাষাভিত্তিক শক্তিশালী সাংস্কৃতিক ঐহিত্যের গর্ব ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও কম দেখা যায়নি। এর মধ্যে কর্নাটক, পশ্চিমবঙ্গ, পাঞ্জাব এবং মহারাষ্ট্র অন্যতম।

কেন্দ্রীয় সরকারের হিন্দি চাপানোর স্পষ্ট প্রতিবাদ হিসেবে মহারাষ্ট্র সরকার স্থানীয় বিভিন্ন ভাষাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলক করেছে।

প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও নানা অধিকার আদায়ের আন্দোলনের মূল শক্তি হিসেবে কাজ করেছে ভাষা। বেলজিয়ামের ফ্রেঞ্চ-জার্মান-ডাচ, উনিশ শতকে গোটা মধ্যপ্রাচ্যের আরবি-ফারসি-তুর্কি থেকে শুরু করে মেক্সিকোর স্প্যানিশ-ইংরেজি; ১৭-১৮ শতকের ম্যান্ডারিন-মাঞ্চুরিয়ান বিরোধ সবগুলোই প্রতিটি জাতির অস্তিত্বের লড়াই। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার করার দাবিতে হওয়া ৫২'র সংগ্রাম শুধু বাঙালির অস্তিত্ব ও জাতীয়তাবাদেরই বহিঃপ্রকাশ করেনি বরং পৃথিবী বুকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সৃষ্টির সূচনাই করে দিয়েছে।

Comments

The Daily Star  | English

Govt to prepare declaration of July uprising: CA’s press wing

The government hopes this declaration will be prepared unanimously consulting with political parties and students within a few days and presented before the nation

1h ago