বিলিভ ইট অর নট

অস্কার ওয়াইল্ড: একঘরে হওয়া প্রথম সেলিব্রেটি

অস্কার ওয়াইল্ড: একঘরে হওয়া প্রথম সেলিব্রেটি
অস্কার ওয়াইল্ড: একঘরে হওয়া প্রথম সেলিব্রেটি। ছবি: সংগৃহীত

বরেণ্য ও কালজয়ী সাহিত্যিক অস্কার ওয়াইল্ডকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পকারদের একজন ধরা হয়। 'সেলফিস জায়ান্ট'-এর মতো কালজয়ী গল্প কিংবা 'পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে'র মতো উপন্যাসের জন্য আজও তিনি স্মরণীয়। তবে এই অস্কার ওয়াইল্ডকেই একসময় হতে হয়েছিল একঘরে! 

আর সেটাই ছিল কোনো সেলিব্রেটির ক্ষেত্রে প্রথমবারের মতো একঘরে করা বা 'ক্যান্সেল কালচার'র শুরু! অস্কার ওয়াইল্ড কীভাবে এর শিকার হলেন, চলুন সেটিই জেনে নেওয়া যাক। 

ওয়াইল্ডের নন্দন ভুবন 

লেখাপড়া শেষ করে ডাবলিনে ফিরে ওয়াইল্ড বিয়ে করতে চেয়েছিলেন শৈশবের প্রিয় বন্ধু ফ্লোরেন্স বেলকম্বকে। তবে ড্রাকুলা খ্যাত ব্রাম স্টোকারকে বিয়ে করেন ফ্লোরেন্স। ভগ্নহৃদয় অস্কার ফিরে যান লন্ডনে।
 

অস্কার ওয়াইল্ড: একঘরে হওয়া প্রথম সেলিব্রেটি
অস্কার ওয়াইল্ড। ছবি: সংগৃহিত

বিখ্যাত চিকিৎসক বাবা ও সমাজসেবক মায়ের সন্তান ওয়াইল্ড অক্সফোর্ডের শিক্ষার্থী ছিলেন। লন্ডনে তিনি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৮৮১ সালে গিলবার্ট ও সুলিভানের অপেরা 'পেশেন্স' (ধৈর্য)-এ কলাকৈবল্যবাদের (নিজের আত্মার সন্তুষ্টির জন্য শিল্প সৃষ্টি করেন। এখানে কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই শিল্পীর। এটিই কলাকৈবল্যবাদ) সমালোচনাকারীদের সমালোচনা করা হয়। অস্কার এই মতবাদের প্রচারকদের পথিকৃৎতুল্য ছিলেন। তার অনুসরণে নাটকে একটি চরিত্র রাখা হয়। 

এ সময় ২০০টির মতো পার্টিতে তিনি সম্মানিত অতিথি হয়ে গিয়েছিলেন। ওয়াল্ট হোয়াইটম্যান, লুইসা মে অ্যালকট, হেনরি জেমস, জেফারসন ডেভিস, এমনকি ইউলিসিস এস গ্রান্টের মতো ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় তার। ২৭ বছরের কাছাকাছি বয়সেই তিনি সেলিব্রিটি হয়ে যান অস্কার। 

প্রেম, বিয়ে এবং প্রেম

এ সময় অস্কারের সঙ্গে পরিচয় হয় কনস্ট্যান্স লয়েডের। শিশুদের জন্য লিখতেন তিনি। ২ বছরের সম্পর্কের পর তারা বিয়ে করেন ১৮৮৪ সালে। পরের ২ বছরে ২ পুত্র সিরিল ও ভিভিয়ানের জন্ম হয়। 

ভিভিয়ানের জন্মের সময়টায় ১৭ বছর বয়সী কানাডীয় কিশোর সাংবাদিক রবি রসের সঙ্গে ওয়াইল্ডের পরিচয় হয়। তার সঙ্গে ওয়াইল্ডের সম্পর্ক নিয়ে কানাঘুষাও ছিল, তবে সম্পর্কটি দৈহিক ছিল কি না তা স্পষ্ট নয়। এ সময়ে ওয়াইল্ড পল মল গেজেটে সমালোচক হিসেবে কাজ করতেন। পরে 'উইমেন'স ওয়ার্ল্ড'র সম্পাদক হন। এ সময়ে তিনি 'হ্যাপি প্রিন্স অ্যান্ড আদার টেলস' লেখেন। শিশুসাহিত্যে পদার্পণ করে তার আগের নন্দনভাবনা থেকে সরে আসতে থাকেন।

বসি ডগলাসে সর্বনাশ

১৮৯১ সালের কথা। হ্যাপি প্রিন্সের সিকুয়েল, হাউস অব পমিগ্রানেটস ও বিশেষ করে 'পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে' লিখে সাড়া ফেলে দেন অস্কার। 

সে বছরই লর্ড আলফ্রেড 'বসি' ডগলাসের প্রেমে পড়েন তিনি। আলফ্রেড ছিলেন কুইন্সবেরির নবম মার্কাস জন ডগলাসের পুত্র। জন ডগলাস 'কুইন্সবেরি রুলস অব বক্সিং'র প্রবর্তক হিসেবে খ্যাতিমান হয়ে আছেন। ৪ বছর চলেছিল তাদের এই প্রণয়। তাতে ছিল বহু উত্থান-পতন। সমকামিতার সম্পর্ক তখনকার দিনে ইংল্যান্ডে ছিল শাস্তিযোগ্য অপরাধ। প্রচণ্ড স্বার্থপর ও বেপরোয়া আলফ্রেড নিজ স্বার্থে ব্যবহার করছিলেন অস্কারকে। কিন্তু তার প্রেমে অন্ধ হয়ে যাওয়া অস্কার তা খেয়ালও করেননি।

অস্কার ওয়াইল্ড: একঘরে হওয়া প্রথম সেলিব্রেটি
আলফ্রেড ডগলাস (ডানে) ও অস্কার ওয়াইল্ড, ছবি: সংগৃহিত

১৮৯৪ সালের দিকে কুইন্সবেরি তার ছেলের সঙ্গে অস্কারের সম্পর্ক নিয়ে সন্দেহ করতে থাকেন। অস্কারকে হুমকি দেন- 'আমার ছেলের সঙ্গে আবার যদি কোনো রেস্টুরেন্টে তোমাকে দেখি, তাহলে ছাতু করে ফেলব!' 

অস্কারও দিয়েছিলেন মোক্ষম জবাব- 'কুইন্সবেরিদের নিয়ম আমি জানি না, তবে অস্কার ওয়াইল্ডের নিয়মটা দেখামাত্র গুলি!' ১৮৯৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে অস্কারের নাটক বেরোলো- 'দ্য ইম্পর্টেন্স অব বিইং আর্নেস্ট।'

কুইন্সবেরি ভাবলেন মোক্ষম শিক্ষা দেবেন তিনি অস্কারকে। শো তে গিয়ে পচা সবজি ছুঁড়ে মারবেন তার দিকে। কিন্তু অস্কার আগেই জেনে গেলেন, টিকেট দিতেও অস্বীকৃতি জানালেন।

পাবলিক ট্রায়াল

অস্কারের বিরুদ্ধে পুরুষ বেশ্যা বা জিগোলোদের বাড়িতে নিয়ে আসার মতো গুরুতর অভিযোগ করেন কুইন্সবেরি। এর সপক্ষে প্রমাণও দেন। প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীও জোগাড় করেন তিনি।

কুইন্সবেরি জেতেন, ওয়াইল্ড মামলায় হেরে যান। রবি রস তাকে পরামর্শ দেন দেশ ছেড়ে প্যারিসে চলে যেতে; এদিকে তার মায়ের পরামর্শ ছিল- 'যদি নিজেকে অপরাধী মনে না করো, তবে দেশেই থাকো। যা ঘটতে চলেছে তার মুখোমুখি হও।' ওয়াইল্ড দ্বিতীয় পথটিই বেছে নেন।

১৮৯৫ সালের ৬ এপ্রিল অস্কার ওয়াইল্ডকে সমকামিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। ২০ দিন পর তার বিচার শুরু হয়। এতে তার অতীত সম্পর্কগুলোর খুঁটিনাটি, 'পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রের' ভেতর প্রচ্ছন্ন সমকামিতার অভিযোগ আনা ও আলফ্রেড ডগলাসের লেখা কবিতা- বহুকিছুর প্রসঙ্গই আনা হয়।

পরের মাসে বিচারে তাকে স্পষ্টভাবে দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি। পাশাপাশি, বিচারকদের কেউ কেউ চলমান মিডিয়া ট্রায়ালের সমালোচনাও করেন।

পরবর্তীতে সলিসিটার জেনারেল ফ্রাঙ্ক লকউড সবদিক বিবেচনায় অস্কারকে পেন্টোভিল কারাগারে ২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন।

অস্কারের জেলজীবন

ওয়াইল্ডের কারাকক্ষ বেশ কয়েকবার পরিবর্তন হয়। পেন্টোভিল থেকে প্রথমে নেওয়া হয় ওয়ান্ডসওর্থে। এরপর ১৮৯৫ সালের নভেম্বরে রিডিং গাওলে। এর ভেতর একবার কারা স্থানান্তরের সময় ক্ল্যাফাম জংশনের প্লাটফর্মে এক ব্যক্তি তাকে হাতকড়া পরিহিত অবস্থায় দেখে বাজে মন্তব্য করেন। 

তার স্ত্রী জেলে তার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। অস্কারকে তিনি জানান মায়ের মৃত্যুর কথা। এ ছাড়া সামাজিকভাবে নিগ্রহ এড়াতে নিজের ও ২ সন্তানের নামের শেষ অংশ পরিবর্তন করতে বাধ্য হন তার স্ত্রী। 

কারাগারে এক ঘণ্টার দৈনিক শ্রম বাদে বাকি ২৩ ঘণ্টাই ছিল অস্কারের অখণ্ড অবসর। এ সময়টাই বিদেশে পালিয়ে যাওয়া প্রতারক প্রেমিক ডগলাসকে চিঠি লিখতেন। শেষদিকে ল্যাটিনে লিখতে শুরু করেছিলেন 'ডি প্রফানডিস' (অতল গভীর থেকে) নামে একটি চিঠি যাতে খ্রিষ্টত্ব নিয়ে তার চিন্তা সবিস্তারে লিখেছিলেন। 

জেলফেরত জীবন ও মৃত্যু

১৮৯৭ সালে জেল থেকে ছাড়া পান অস্কার। ততদিনে তিনি দেউলিয়া, স্বাস্থ্য ভগ্ন, জেল থেকে ভুগতে শুরু করেছেন মেনিনজাইটিসে। তিনি ফ্রান্সে ফিরে যান। দেখা হয় আলফ্রেড ডগলাসের সঙ্গে। এ সময় উত্তরাধিকারসূত্রে বিপুল অর্থের মালিক হয়েছিলেন ডগলাস। তবে ওয়াইল্ড তার কাছ থেকে আর্থিক কোনো সহায়তা পাননি।

জীবনের বাকি সময় ওয়াইল্ড প্যারিসেই কাটান- নির্বাসিত অবস্থায়। লন্ডনে থাকা তার জন্য অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। তবে প্যারিসেও নিজ নামে থাকা তার জন্য কঠিন হয়ে পড়েছিল। তিনি নাম নেন- সেবাস্তিয়ান মেলমথ। প্রথম অংশটি সাধু সেবাস্তিয়ানের নামে, দ্বিতীয়টি চার্লস ম্যাচুরিনের উপন্যাসের চরিত্র থেকে। তিনি তখন স্ত্রীর কাছ থেকে ভাতা হিসেবে টাকা পেতেন, এ ছাড়া আর কিছুই ছিল না।

তখন তিনি সম্পূর্ণ একাই থাকেন। প্যারিসেও দুয়েকবার কেউ চিনে ফেললে বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। স্বাস্থ্যের দিনদিন অবনতি ঘটে। অবশেষে ১৯০০ সালের ৩০ নভেম্বর তার মৃত্যু হয় প্যারিসের ডি'আলসেস হোটেলে। শেষ শয্যায় পাশে ছিলেন ঘনিষ্ট বন্ধু রবি রস ও এক যাজক। মৃত্যুর আগে যাজক তাকে 'ব্যাপটাইজড' করেন।

মৃত্যুতেও স্বভাবসুলভ হিউমার হারাননি অস্কার। বলেছিলেন- 'আমার দেয়ালের পর্দা আর আমি- দুজনই মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে। যে কোনো একজনকে যেতেই হবে।' 

২০১৭ সালে যুক্তরাজ্যের আদালত অস্কার ওয়াইল্ডসহ সমকামিতার অভিযোগে শাস্তিপ্রাপ্ত ৫০ জনকে নিরাপরাধ সাব্যস্ত করে ক্ষমা ঘোষণা করে। 

তথ্যসূত্র: রিপলি'স বিলিভ ইট অর নট

গ্রন্থনা: মাহমুদ নেওয়াজ জয় 

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

9h ago