আধুনিকায়নের নামে সবুজ ধ্বংস: প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হারাচ্ছে বিপ্লব উদ্যান

বিপ্লব উদ্যানের ‘উন্নয়ন’ চলছে। ছবি: স্টার

এক সময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ বিপ্লব উদ্যান বন্দর নগরবাসীর কাছে অবসর বিনোদনের অন্যতম পছন্দের জায়গা ছিল।

নগরীর ষোলশহর ২ নম্বর গেট মোড়ে প্রায় দুই একর জায়গাজুড়ে ১৯৭৯ সালে এই পার্কটি নির্মিত হয়। এটি এক সময় সবুজে ভরপুর ছিল। নগরবাসী পার্কে আসতেন ইট-কংক্রিটের জঞ্জাল থেকে মুক্ত হয়ে  উন্মুক্ত আকাশের নীচে সবুজের সমারোহে সতেজ নিঃশ্বাস নিতে।

একটি সাজানো বাগান, ছোট ছোট মাছে ভরপুর উন্মুক্ত চৌবাচ্চা,  বসার ব্যবস্থা এবং চারপাশে প্রশস্ত হাঁটার পথ পার্কটিকে সবার কাছে অন্যতম পছন্দের জায়গায় পরিণত করেছিল।

গাছ কেটে নানা ধরনের অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে উদ্যানে। ছবি: স্টার

কিন্তু সে সবই এখন বিলুপ্ত। বিপ্লব উদ্যানে সবুজ নেই, বাগান নেই, গাছপালা নেই। আধুনিকায়ন প্রকল্পের নামে পার্কের সিংহভাগ সবুজ গ্রাস করে নেওয়া হয়েছে।

সূত্র মতে, পার্কটির 'ধ্বংস' শুরু হয় ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর থেকে। যখন পার্কটির তত্ত্বাবধানকারী কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) এর 'উন্নয়নে'র জন্য দুটি বেসরকারি কোম্পানির সঙ্গে একটি চুক্তি সই করে।

চসিক সূত্রে জানা গেছে, কোম্পানিগুলো মোটা অংকের অগ্রিমের বিনিময়ে ভাড়া দেওয়ার জন্য খুব দ্রুত পার্কে দোকান তৈরি করে। কিন্তু পার্কের সামগ্রিক উন্নয়ন এক প্রকার অধরা রয়ে গেছে বলে জানান তারা।

গত বছরের ২২ আগস্ট বিপ্লব উদ্যানের সবুজ পুনরুদ্ধারের নামে পার্কটি পুনর্গঠনের জন্য পুরনো চুক্তি সংশোধন করে নতুন চুক্তি করে চসিক।

চসিক সূত্র জানায়, নতুন চুক্তি অনুযায়ী বিপ্লব উদ্যানের পূর্ব পাশে ২০০ ফুট দীর্ঘ কাঠামো নির্মাণ করা হবে। একটি অংশে থাকবে কফিশপ। দ্বিতীয় তলায় চট্টগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্বলিত জাদুঘরসহ একটি প্রদর্শনী কেন্দ্র থাকবে।

পার্কের পূর্ব পাশে জাতীয় পতাকার আদলে স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের কাঠামো তৈরি করা হবে। সেখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এবং চট্টগ্রাম ও দেশের বরেণ্য ব্যক্তিবর্গের প্রতিকৃতি থাকবে। পার্কে একটি গেম জোন থাকবে। এতে ২৫টি ডিজিটাল স্ক্রিন, বিলবোর্ড বা মেগা-সাইন, এটিএম বুথ, কিয়স্ক এবং প্রদর্শনী কেন্দ্র স্থাপনের সুযোগ থাকবে।

কোম্পানিটি পার্কে এসব অবকাঠামো নির্মাণ ও পরিচালনা করবে এবং বিনিময়ে চসিক কর্তৃপক্ষকে মাসিক ভাড়া প্রদান করবে। সূত্র জানায়, চুক্তিটি ২০ বছর মেয়াদের জন্য সই হয়েছে।

১৬ মার্চ পার্কে গিয়ে দেখা যায়, শ্রমিকরা একটি স্থাপনার পিলার ও বেসমেন্ট নির্মাণে ব্যস্ত সময় পার করছেন। পার্কের মাঝখানে বালি ও নির্মাণ সামগ্রীর স্তূপ করা হয়েছে।

পার্কের চারপাশে কোনো সীমানা প্রাচীর নেই। ফুটপাত সংলগ্ন বেঞ্চে মাত্র কয়েকজন দর্শনার্থী বসে রয়েছেন। পার্কের করুণ দশা দেখে তারাও অসন্তুষ্ট।

গাছ কেটে নানা ধরনের অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে উদ্যানে। ছবি: স্টার

পার্কে আসা নাসিরাবাদ এলাকার বাসিন্দা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, 'চট্টগ্রামে মাত্র কয়েকটি পার্ক রয়েছে যেখানে মানুষ বিনামূল্যে প্রবেশ করতে পারে। বিপ্লব উদ্যান তার মধ্যে একটি।'

'আধুনিকীকরণের নামে কর্তৃপক্ষ পার্কটিকে কী করছে, বুঝতে পারছি না। এটা এখন তো আর পার্ক থাকছে না,' যোগ করেন তিনি।

পার্কে দর্শনার্থী কম থাকলেও ২০১৮ সালে পার্কে তৈরি করা কফি শপ এবং খাবারের দোকানগুলোতে বেশ গ্রাহক সমাগম দেখা যায়।

বেসরকারি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সইয়ের জন্য চসিক কর্তৃপক্ষের সমালোচনা করে জনস্বাস্থ্য অধিকার সংরক্ষণ কমিটি চট্টগ্রামের আহ্বায়ক ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, 'একটি পাবলিক পার্ক প্রাইভেট কোম্পানির কাছে হস্তান্তর করা উচিত নয়। যেহেতু পার্কটিকে ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, তারা জনসেবার চেয়ে ব্যবসাকেই প্রাধান্য দেবে।'

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) চট্টগ্রামের নেটওয়ার্কিং সদস্য অলিউর রহমান বলেন, 'বিপ্লব উদ্যানে কংক্রিট কাঠামো নির্মাণে চসিকের উদ্যোগের প্রতিবাদে আমরা আন্দোলন ও মানববন্ধন করেছি। কিন্তু চসিক কর্তৃপক্ষ সেগুলোতে কোনো কর্ণপাত করেনি।'

তিনি বলেন, 'পার্কে সবুজ নষ্ট করে কংক্রিটের কাঠামো নির্মাণ করছে। কোনো সভ্য দেশে এটা সম্ভব নয়।'

'এমনকি পার্কে স্থাপনা নির্মাণের জন্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) অনুমতিও নেয়নি চসিক,' তিনি বলেন।

সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী হাসান বিন শামস বলেন, 'আইন অনুযায়ী সিডিএর অনুমতি ছাড়া নগরে কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। বিপ্লব উদ্যানে অবকাঠামো নির্মাণের জন্য চসিক কর্তৃপক্ষ কোনো অনুমতি চায়নি। এটা বিদ্যমান আইনের লঙ্ঘন।'

চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, 'বিপ্লব উদ্যানকে ধ্বংস করা হচ্ছে না, বরং দর্শনার্থীদের জন্য সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে নতুনভাবে সাজানো হচ্ছে। আগে পার্কে সবুজ হারিয়ে গিয়েছিল, আমরা সবুজকে পুনরুদ্ধার করছি।'

সিডিএর অনুমতি না নেওয়ার বিষয়ে মেয়র বলেন, 'নগরীতে অবকাঠামো নির্মাণে চসিকের অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই।'

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh national election timeline

Preparing for election: EC targets Dec to get all its tasks done

There is no hard and fast decision on when the next election will be held, but the Election Commission is making preparations to hold it in December.

4h ago