দুর্বৃত্তদের নিয়ন্ত্রণে আনতে হিমশিম খাচ্ছে বিএনপি, শুদ্ধি অভিযান শুরু

বিএনপির শুদ্ধি অভিযান ২০২৫

দলের শীর্ষ নেতারা বারবার সতর্কতা করছে, সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিচ্ছে—তারপরও নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যর্থ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। সারা দেশে দলটির নেতাকর্মীরা চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, হত্যা থেকে শুরু করে নানা অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত।

এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দুর্বৃত্তদের বাদ দিতে দলে শুদ্ধি অভিযান শুরু করছে বিএনপি। একই সময়ে, বিএনপি নেতারা দাবি করছেন যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দলটিকে অন্যায়ভাবে দোষারোপ করা হচ্ছে।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, গত ১১ মাসে দেশব্যাপী ৩৪৯টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, যেখানে ৮৭ জন নিহত ও তিন হাজার ৯২৯ জন আহত হয়েছেন। এসব ঘটনার মধ্যে ৩২৩টির সঙ্গে বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনগুলো জড়িত ছিল এবং এই নিহতদের মধ্যে অন্তত ৭৭ জন এবং আহতদের মধ্যে তিন হাজার ৬৫৩ জন বিএনপি কর্মী।

বিএনপির অঙ্গসংগঠন যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদল সম্প্রতি তাদের পাঁচ সদস্যকে বহিষ্কার করেছে। বহিষ্কৃত এই সদস্যদের বিরুদ্ধে ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে নির্মমভাবে হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। প্রকাশ্য দিবালোকে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে সোহাগকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

ভাঙারি ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদাবাজি নিয়ে বিরোধের জেরে এই হত্যাকাণ্ড হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সারা দেশের মানুষের মধ্যে এই হত্যাকাণ্ড ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত সন্দেহভাজন পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এ ছাড়া, সাম্প্রতিক আলোচিত ঘটনার মধ্যে রয়েছে লালমনিরহাটে একটি থানায় হামলা, ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলায় এক নারীকে ধর্ষণ, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে লাঞ্ছিত করা এবং ঢাকার একটি রেস্তোরাঁ ও বারে দুই নারীকে লাঞ্ছিত করা। এসব ঘটনা গণমাধ্যমের শিরোনাম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উঠে আসায় ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়।

লালমনিরহাটে বিএনপি কর্মীরা পাটগ্রাম থানায় হামলা চালিয়ে মোবাইল কোর্টে দণ্ডপ্রাপ্ত দুইজনকে জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিয়ে যায়। পরে পাটগ্রাম পৌর যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ও একজন সাবেক উপজেলা বিএনপি সদস্যকে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বহিষ্কার করা হয়।

এ বিষয়ে আলাপকালে পাটগ্রাম উপজেলা বিএনপির সভাপতি শফিকার রহমান দ্য ডেইলি স্টারের কাছে স্বীকার করেন, এত বড় সংগঠন নিয়ন্ত্রণ করা চ্যালেঞ্জের। তিনি বলেন, 'বিএনপি বড় দল। আমরা বলতে পারি না যে এখানে সবাই নির্দোষ, সবাই ভালো। আমরা জেলা পর্যায়ে নেতাকর্মীদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত না হওয়ার নির্দেশ বারংবার দিচ্ছি। তারপরও অনেকে সেসব নির্দেশ লঙ্ঘন করে।'

ভোলায় ধর্ষণের ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধেও দলটি সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে বিএনপির ভোলা জেলা শাখার সদস্য সচিব রইসুল আলম বলেন, দল কোনো ব্যক্তির অপরাধের দায় নিতে পারে না। তিনি বলেন, 'আমরা এসব ঘটনা ঘটাতে কোনোভাবেই উৎসাহ দিচ্ছি না। একটি বড় দলে কিছু খারাপ মানুষ থাকবেই। তাদের অপরাধের জন্য পুরো দলকে দায়ী করা যায় না।'

সাংগঠনিক ব্যবস্থা ব্যর্থ?

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, বিএনপি শৃঙ্খলা ভঙ্গের বিষয়ে শূন্য সহনশীলতার নীতি গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, 'আমরা দল হিসেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যেকোনো সদস্য শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সম্ভব হলে আমরা তাদের আইনের হাতে তুলে দিচ্ছি। পাশাপাশি এসব বিষয়ে সরকারকেও কঠোর হতে আহ্বান জানাচ্ছি।'

গত বছর আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা একের পর এক সহিংস ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

এর প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি দাবি করছে, তারা কেন্দ্রীয় নেতাদের থেকে শুরু করে তৃণমূল কর্মী পর্যন্ত পাঁচ হাজার জনের বেশি সদস্যকে বহিষ্কারের মতো শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে।

তবে এই ব্যবস্থা যথেষ্ট নয় বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।

গত সপ্তাহে প্রকাশিত হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত দেশে অন্তত ৫২৯টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, যেখানে ৭৯ জন নিহত ও চার হাজার ১২৪ জনের বেশি আহত হয়েছেন।

এর মধ্যে ৩০২টি ঘটনা বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে ঘটেছে, যেখানে দুই হাজার ৮৩৪ জন আহত ও ৫৪ জন নিহত হয়েছেন। বাকি ১৪০টির বেশি ঘটনায় বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে অন্যান্য দলের সদস্যদের সংঘর্ষ হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সহিংসতার বেশিরভাগ ঘটনাই স্থানীয় আধিপত্য বিস্তার, প্রতিশোধ, দলীয় কমিটি নিয়ে বিরোধ, চাঁদাবাজি ও জমি বা সম্পত্তি দখল সংক্রান্ত।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, 'এসব ঘটনার জন্য কেবলমাত্র বিএনপিই দায়ী নয়।' দেশের ভঙ্গুর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকেও এর জন্য উল্লেখযোগ্য কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।

তিনি বলেন, দল কঠোর অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু, এসব ঘটনায় যারা সরাসরি জড়িত শুধুমাত্র তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কিন্তু, এই ধরনের কর্মকাণ্ড যেসব স্থানীয় নেতাদের উপস্থিতিতে হচ্ছে, তাদের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

অধ্যাপক দিলারার এই মন্তব্যের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, 'এটা কেবল বিএনপির সমস্যা না। সব বড় রাজনৈতিক দলের অবস্থা কমবেশি একই রকম।'

তিনি বলেন, 'যে দলই ক্ষমতায় থাকে বা ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা থাকে, সেই দলের আশপাশে একদল দুর্বৃত্ত ভিড় জমায়। এটা সবাই জানে। এটা এখন আর কোনো গোপন বিষয় না। আর তাদের ছাড়া দল চলেও না।'

দলীয় শৃঙ্খলা নেই?

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বারবার বলেছেন, তার দল যেকোনো অন্যায়ে জড়িত সদস্যদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে।

গত ২২ ফেব্রুয়ারি লন্ডন থেকে এক ভার্চুয়াল ভাষণে তিনি বলেন, 'বিএনপি একমাত্র দল যারা কোনো ভুল অস্বীকারে থাকে না। আমাদের দলের কেউ যদি অন্যায়ে জড়িত হয়, আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেই।'

এর কয়েকদিন পর—২৭ ফেব্রুয়ারি—একটি দলীয় বৈঠকে তারেক রহমান নেতাকর্মীদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন। সেই সভায় অন্তত ১০৫ জন নেতা সংগঠনের অভ্যন্তরে চাঁদাবাজি, জমি দখল ও টেন্ডার কারচুপির মতো চলমান সমস্যা নিয়ে কথা বলেন।

কিন্তু এসব সতর্কবার্তা দলটির নেতাকর্মীদের ওপর তেমন কোনো প্রভাব ফেলছে না।

মানবাধিকার সংস্থা আসকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ থেকে জুনের মধ্যে বিএনপির অভ্যন্তরীণ অন্তত ৪০৯টি সংঘর্ষের ঘটনায় ৩৫ জন নিহত ও এক হাজার ১০৫ জন আহত হয়েছেন।

বিশ্লেষকদের মতে, এই চলমান অস্থিরতা গভীর সাংগঠনিক সমস্যার দিকেই ইঙ্গিত করে। অর্থাৎ, তাদের কার্যকর দলীয় শৃঙ্খলা নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলেন, 'তারেক রহমান দায়িত্ব নিয়েছেন এবং দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু দূরত্ব একটি বড় বিষয়। তিনি দূর থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।'

তিনি বলেন, 'তারেক রহমান তার ভাষণে কঠোর হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন। কিন্তু, যদি তিনি দেশে থাকতেন এবং সরাসরি দলীয় শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন, তাহলে এই ধরনের ঘটনা কম হতো।'

তিনি আরও বলেন, 'সরাসরি যোগাযোগ দলের শৃঙ্খলা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নেতাকর্মীদের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ গুরুত্বপূর্ণ। এটা সঠিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সহায়তা করে। আমি বলব না যে তাদের দলীয় শৃঙ্খলা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নেই, কিন্তু এত বড় একটি সংগঠন পরিচালনা করা মোটেই সহজ কাজ না।'

মজিবুর সতর্ক করেন, যদি এই অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে আনা না যায়, তাহলে তা জনআস্থার হানি হবে এবং আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে এর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

শুদ্ধি অভিযান

বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন বলেন, তারা দলের মধ্যে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছেন। এর মাধ্যমে জেলা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত দলের ভেতরে থাকা দুর্বৃত্তদের বাদ দেওয়া হবে।

দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সালাহউদ্দিন ব্যাখ্যা করেন, কীভাবে আওয়ামী লীগের শাসনামলে সামাজিক বন্ধন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

আওয়ামী লীগ আমলে ভয়ের সংস্কৃতির মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা টিকিয়ে রাখা হতো উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'এই বিষাক্ত সংস্কৃতি সমাজের প্রতিটি স্তরে ঢুকে পড়েছে। সেটা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলেও অনুপ্রবেশ করেছে, কেউ না কেউ সেটা ব্যবহার করছে। রাতারাতি সেটা বদলে ফেলা যাবে না।'

তিনি বলেন, এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় দলীয় পর্যায়ে কড়া নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যাতে দলের প্রতিটি সদস্যের বিষয়ে ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করা হয় এবং যারা অসদাচরণে জড়িত, তাদের চিহ্নিত করা যায়। এজন্য তারা তৃণমূল পর্যায় থেকে জরিপ পরিচালনা করছে।

তিনি রাজনৈতিক দোষারোপের অপব্যবহার নিয়েও অভিযোগ করে বলেন, 'যখনই কিছু হয়, তখনই বিএনপির নাম টেনে আনা হয়। এমন অনেক অভিযোগ পরে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।'

দ্বিচারিতার দিকে ইঙ্গিত করে সালাহউদ্দিন বলেন, 'খুলনায় যুবদল কর্মী খুন হলেন, মসজিদের ভেতর একজন ইমামের ওপর এমন ন্যাক্কারজনক হামলা হলো। সেগুলো নিয়ে তো কাউকে এমনভাবে কথা বলতে দেখা যায় না।'

তদন্ত ছাড়াই বিএনপির বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার প্রসঙ্গে তিনি মুরাদনগরের ঘটনার উদাহরণ দিয়ে বলেন, 'প্রথম দিন বলা হয়েছিল এই ঘটনায় বিএনপি জড়িত। পরে তদন্তে দেখা যায়, সেটা ছিল দুই ভাইয়ের পারিবারিক বিরোধ এবং তাদের একজন ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।'

Comments

The Daily Star  | English

Container handling rises at New Mooring terminal after Navy takeover

Container handling at the New Mooring Container Terminal (NCT) of Chattogram Port increased in the first week of operational management by Chittagong Dry Dock Limited (CDDL), Bangladesh's sole dry dock currently operating under the Bangladesh Navy..The CDDL started running the NCT at the c

1h ago