ছাত্রনেতাদের সঙ্গে বিরোধ: সরকারের নিরপেক্ষতায় চাপ অব্যাহত রাখবে বিএনপি
দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের জন্য চাপ অব্যাহত রাখলেও ছাত্রনেতা ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে কোনো ধরনের সংঘাতে জড়ায়নি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)।
তবে, গত সপ্তাহে বিএনপি সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলায় তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম পাল্টা জবাব দেন। তখন থেকেই শুরু হয় জল্পনা-কল্পনা—এরপর কী হবে।
দলের নেতারা বলছেন, তারা সরকারের নিরপেক্ষতা এবং নির্বাচনের দাবিতে কথা বলা বন্ধ করবেন না।
সেইসঙ্গে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা খতিয়ে দেখছেন, কেন নাহিদ ইসলাম এমন প্রতিক্রিয়া জানালেন।
অনেক নেতা মনে করছেন, নাহিদ ইসলামের এই মন্তব্যের পেছনে আরও কয়েকজন উপদেষ্টার ইন্ধন থাকতে পারে এবং তাদের শনাক্ত করার চেষ্টা করছেন বিএনপি নেতারা।
দলীয় সূত্র জানায়, তারা জানতে চাইছেন যে সরকারের মুখপাত্র না হয়েও কেন নাহিদ ইসলাম বিএনপি মহাসচিবের মন্তব্যে এমন প্রতিক্রিয়া জানালেন।
দ্য ডেইলি স্টারকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, 'আমাদের মহাসচিবের বক্তব্য তার (নাহিদ ইসলাম) কাছে উসকানিমূলক কেন মনে হলো?'
নাহিদের মতোই উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সাজিব ভূঁইয়া এবং ছাত্রনেতা হাসনাত আবদুল্লাহ ও সারজিস আলমও ফেসবুকে এ বিষয়ে লিখেছেন। তাদের এসব মন্তব্য বিষয়ে বিএনপির ওই স্থায়ী কমিটির সদস্য বলেন, 'পরিকল্পিতভাবে এই বিষয়টিকে বড় বানানোর জন্য এগুলো করা হচ্ছে।'
আরেকজন সিনিয়র বিএনপি নেতা বলেছেন, ছাত্র-জনতার সফল আন্দোলনের পর গঠিত সরকারকে অবশ্যই নিরপেক্ষ হতে হবে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলের মন্তব্য ছিল নিরপেক্ষতা নিয়ে। কিন্তু, এই মন্তব্যের যে প্রতিক্রিয়া দেওয়া হয়েছে সেটা ছিল আক্রমণাত্মক।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, 'ছাত্র আন্দোলনের নেতারা—যারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হয়েছেন—কোনো রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে মন্তব্য করতে পারেন না। এতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ণ হয়।'
তিনি বলেন, 'আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নিরপেক্ষ মনে করি। কিন্তু সরকারের কেউ যদি পক্ষপাতমূলক অবস্থান গ্রহণ করেন, তাহলে তো সরকারকে আর নিরপেক্ষ বলে মনে হবে না।'
তিনি আরও বলেন, 'যদি উপদেষ্টারা রাজনীতিতে অংশ নিতে চান, তাহলে আগে তাদের পদত্যাগ করতে হবে। তারপর তারা অন্যান্য দলের সমালোচনা করতে পারেন। কিন্তু সরকারে থেকে সেটা পারেন না।'
বিএনপির মিত্র দলগুলোও নাহিদের মন্তব্যকে ইতিবাচকভাবে নেয়নি। মিত্র দলগুলোর নেতারা বিশ্বাস করেন, তার বক্তব্য ছিল আক্রমণাত্মক। এ বিষয়ে বিএনপি ও তাদের মিত্র রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে শিগগির বক্তব্য আসবে।
বিএনপির এক নেতা জানান, ছাত্ররা আন্দোলনের চেতনা থেকে কিছুটা বিচ্যুত হয়েছে। তারা এখন দল গঠন, নির্বাচন করা এবং ক্ষমতায় ফেরার 'স্বপ্ন' দেখছে, যা গণঅভ্যুত্থানের মূল চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
তিনি বলেন, 'বৃহত্তর রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশ বা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে হলে কয়েকটি পর্যায় অতিক্রম করতে হয়। যেহেতু তারা এই পর্যায়গুলোর মধ্য দিয়ে যায়নি, তাই তাদের চিন্তাধারা অপরিণত হওয়া স্বাভাবিক।'
তিনি আরও বলেন, 'এই কারণেই বিএনপি সবসময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে বিরোধ এড়িয়ে গেছে। তার বদলে বিএনপি এসব বিষয় সমাধানের চেষ্টা করেছে সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে।'
এই বিএনপি নেতা জানান, বিষয়টি নিয়ে বিএনপি কোনো ফোরামে আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা হয়নি। তবে, নেতাদের অভ্যন্তরীণ আলোচনায় জানা গেছে, নাহিদের এই বক্তব্য সরকারকে প্রতিনিধিত্ব করে না। যদি সরকার প্রতিক্রিয়া জানায়, বিএনপি সেটা নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করবে।
তিনি মনে করেন, সব ছাত্র বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে সমর্থন করে না। এটি ছাত্রদের একটি ছোট গোষ্ঠী এবং তাদের মধ্যেও সাম্প্রতিক দ্বন্দ্বে প্রমাণ হয়েছে, সেখানেও অভ্যন্তরীণ বিভাজন রয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বিশ্বাস করেন যে বিএনপি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে দ্বন্দ্ব গভীর হয়েছে মূলত আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে।
এই বিএনপি নেতা বলেন, বিএনপি যেখানে অবিলম্বে নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে, সেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা আরও সময় চাইছে। তারা এই সরকারের ছায়াতলে একটি দল গঠন করছে বলে বিএনপি যে অভিযোগ তুলছে, সেটা ভিত্তিহীন নয়।
তারপরও রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ, সংবিধান বিলোপ এবং জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের মতো বিষয়ে তাদের দীর্ঘদিনের মতপার্থক্য রয়েছে। ফলে উভয়পক্ষের মধ্যে বিভক্তি ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
মঙ্গলবার বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে মির্জা ফখরুল বলেছেন, 'যদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পূর্ণ নিরপেক্ষতা বজায় রাখে, তাহলে তারা নির্বাচনের আগ পর্যন্ত থাকবে। তা না হলে একটি নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজন হবে।'
বিএনপির অন্তত তিনজন সিনিয়র নেতা বলেছেন, তাদের দল বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হলেও এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
কিন্তু, ছাত্ররা যখন জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের মতো বিষয়, রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ ও সংবিধান বিলোপের মতো ইস্যু উত্থাপন করেছে, তখন বিএনপি আলোচনা করে সরকারের কাছে নিজেদের মতামত জানিয়েছে।
বিএনপি ভবিষ্যতের সংকটগুলোও একইভাবে সমাধান করতে চায়।
অনেক বিএনপি নেতা বিশ্বাস করেন, একটি রাজনৈতিক দল বিএনপি ও ছাত্রদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে। এই বিরোধ তাদের লাভবান করবে। গত কয়েক মাসের ঘটনায় এমনটাই স্পষ্ট হচ্ছে। তবে, বিএনপি এই বিষয়গুলো নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করেছে।
Comments