জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমানের সম্পূর্ণ সাক্ষাৎকার
দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমানের সম্পূর্ণ সাক্ষাৎকার—
দ্য ডেইলি স্টার: আপনি এমন একটি সময়ে জামায়াতে আমির, যখন রাজনৈতিক অঙ্গন বেশ অস্থির এবং ভবিষ্যৎ বেশ অনিশ্চিত। আপনি পরিস্থিতি কেমন দেখছেন? কোথাও শঙ্কা আছে কি?
শফিকুর রহমান: আমাদের সমাজ কখনোই স্থিতিশীল ছিল না—পাকিস্তান আমলেও ছিল না, বাংলাদেশ আমলেও কখনো পুরোপুরি ছিল না। পাকিস্তান আমলে অনেক শাসককে হত্যা করা হয়েছে, অনেক রদবদল হয়েছে। গণতন্ত্র তার স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরে আসেনি এবং শেষ পর্যন্ত লাখ লাখ মানুষের জীবনের বিনিময়ে আমরা বাংলাদেশ পেলাম। এই অস্থিরতাটা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরও ছিল।
এরপর শেখ মুজিব হত্যা, তার দুই মেয়ে ছাড়া পরিবারের সবাইকে হত্যা। সেটাও অস্থির সময়। জিয়াউর রহমানের আগে কিন্তু আরও পালাবদল হয়েছে। সেগুলোও অস্থির সময় ছিল। জিয়াউর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতি খুলে দেওয়ার পর কিন্তু বেশিদিন জীবিত ছিলেন না। এটাও অস্থিরতার ঘোষণা।
এরপর তিনি বিদায় নিলেন, আসলেন সাত্তার। তাকেও বিদায় করা হলো। এটাও অস্থিরতার মধ্য দিয়ে। আসলেন এরশাদ। এসে আস্তে আস্তে দল গঠন করা শুরু করলেন। সেখানে দস্তুরমতো আন্দোলনের পর আন্দোলন হলো। এরপর ৯০-এ তিনি বিদায় নিলেন এবং সেটাও অনেকটা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তাকে বিদায় নিতে হয়েছিল। এটাও অস্থিরতা।
তারপর ৯১-এ যে সরকার হলো, তাতে বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। বিএনপি ছিল সরকারি দল। সেখানে নির্বাচনের ফল এমনভাবে হলো, কোনো দল এককভাবে সরকার গঠন করতে পারল না। সেটাও একটা অস্থিরতা। জামায়াত ছিল তখন ব্যালেন্স অব পাওয়ার। এই জায়গায় আওয়ামী লীগও আমাদের সমর্থন চেয়েছে, বিএনপিও চেয়েছে। দুইপক্ষই আমাদের সমর্থন চেয়েছে। আমরা সবদিক বিবেচনায় বিএনপিকে বিনা শর্তে সমর্থন দিয়ে বলেছি, সরকার আপনারা গঠন করেন, কিন্তু আমরা সরকারের অংশ হবো না। আমরা বিরোধী দলেই থাকব। সরকার গঠনের জন্য আমাদের এই সমর্থন, এর বেশি কিছু না।
তখনকার নির্বাচন হয়েছিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাধ্যমে, কেয়ারটেকার সরকার তখনো হয়নি। কেয়ারটেকারের ফর্মুলাটা ১৯৮৪ সালের। অধ্যাপক গোলাম আজম তখন জামায়াতের আমির। তার পক্ষ থেকে আব্বাস আলী খান এটা ঘোষণা করেছিলেন বাইতুল মোকাররমে একটি পাবলিক মিটিংয়ে। আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যে ফর্মুলা ফলো করলাম, এই ফর্মুলাটাই ছিল গোলাম আজমের দেওয়া। এতে কোনো পরিবর্তন হয়নি। তিনি যেভাবে বলেছিলেন, সেভাবেই হয়েছে। কিন্তু নামটা কেয়ারটেকার ছিল। তার ফর্মুলাটা ছিল কেয়ারটেকার সরকারের নামে।
এই নির্বাচনে সবাই অংশগ্রহণ করে। জাতীয় পার্টিও অংশগ্রহণ করে। তারা ৩৬টি আসন পেয়েছিল সেই নির্বাচনে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়ার কারণে এত বড় রাজনৈতিক বিপর্যয়ের পরও তারা এতগুলো আসন পেয়েছিল। এটা কম কথা না। এটা একটি বিশাল এচিভমেন্ট তাদের জন্য—আমি মনে করি। জামায়াত সেবার কোনো জোটের সঙ্গে নির্বাচন করেনি, কোনো দলের সঙ্গেও করেনি। নিজস্ব অবস্থান থেকে নির্বাচন করে ১৮টি আসন পেয়েছে। সরকার গঠন যখন অনিশ্চয়তার মধ্যে চলে গেল, জামায়াত সেই অনিশ্চয়তাটা শুধু পার করে দিল।
এরপর তখনকার প্রধানমন্ত্রীর কাছে গোলাম আজমের পক্ষ থেকে ছয় সদস্যের একটি ডেলিগেশন গেল আব্বাস আলীর নেতৃত্বে। দেখা করে বললেন, দেখেন এই সিস্টেমটি হওয়ার কারণে স্বাধীন বাংলাদেশ এই প্রথম একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করল এবং এখানে ব্যাপক সংখ্যক লোক অংশগ্রহণ করেছে। আমরা চাই, এটাকেই কেয়ারটেকার ফর্মুলায় এনে, ট্রেজারি বেঞ্চ থেকে, সরকারি দল থেকে প্রস্তাবনা এনে স্থায়ী রূপ দেন। আমরা তখন বোঝাতে পারিনি। আমাদের এই প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়নি। গ্রহণ না হওয়ায় আমরা বাধ্য হলাম দাবি তুলতে। এই দাবি নিয়ে আমরাই প্রথম রাস্তায় নামি, কথা বলি। তখন কিন্তু আওয়ামী লীগসহ কেউ আসেনি আমাদের সঙ্গে এই দাবি তুলতে। ৯৬-এ আওয়ামী লীগ একই দাবি তোলে। তারা নামটা বলে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আমরা কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট বলেছি, আর তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলেছে। এই এতটুকুই। নামের পরিবর্তন। দাবি কিন্তু সমান। নামটা বাংলায় হলো। আমাদেরটা ছিল ইংরেজি।
আন্দোলন শুরু হলো। জাতীয় পার্টিও শরিক হয়ে গেল সেই আন্দোলনে। সবাই মিলেই আন্দোলন করলাম। অন্যান্য দলও সেই আন্দোলনে শরিক হলো, বিভিন্ন মতাদর্শের দল। প্রায় সব দলই অংশগ্রহণ করল, বিএনপি বাদে। বিএনপি এই দাবি তুললও না, মানলও না। কিন্তু দাবিটা এমন জোরালো মোমেনটাম পেল যে শেষপর্যন্ত এই দাবি তারা মানল। কিন্তু ওই সংসদের মেয়াদ শেষ করে আরেকটা—খণ্ডকালীন ছোট্ট সময়ের জন্য, যেটাকে ৯৬-এর সংসদ বলা হয়—সেই সংসদের মাধ্যমে তারা একমাত্র বিল পাস করল, কেয়ারটেকার বিল। এরপরই সংসদ ভেঙে দিলো। কেয়ারটেকার যেহেতু তখন সংবিধানের অংশ হয়ে গেছে, সেই ফর্মুলা অনুযায়ী কেয়ারটেকার গঠন হলো, ৯৬ সালের নির্বাচন হলো। এই নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ করল। কেউ বাদ গেলো না। একটা ফেয়ার ইলেকশন হলো।
সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সামান্য বেশি মেজরিটি নিয়ে সরকার গঠন করল। তারা পাঁচ বছর শাসন করল—২০০১ সাল পর্যন্ত। এই সময়টায় বাংলাদেশে অনেক ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটেছে। তখন খালে-বিলে, নদী-নালায় খাড়ি খাড়ি লাশ, ছোপ ছোপ রক্ত। বিভিন্ন জায়গা অস্থিরতা। চরম একটা অস্থিরতার মধ্য দিয়ে গেছে।
এরপর চার দলীয় জোট গঠন হলো ২০০০ সালে। সেই জোটে বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি ও ইসলামী ঐক্যজোট ছিল। কিন্তু একটা পর্যায়ে এরশাদ আবার বের হয়ে গেলেন। তখন তারই দলের একটা অংশ—নাজিউর রহমান মঞ্জু—চার দলে থাকলেন। চারদল কন্টিনিউ হলো। ইলেকশন হলো। ইলেকশনে একটা ভূমিধ্বস বিজয় পেল চারদলীয় জোট। আন্দোলনের সময় এই জোটের একটা ডিক্লারেশন ছিল, লিখিত ডিক্লারেশন। আন্দোলন একসঙ্গে, নির্বাচন একসঙ্গে, আর যদি নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া যায় তাহলে সবাই মিলে সরকার গঠন। এই জায়গা থেকে সরকারে আমরা অংশগ্রহণ করলাম।
আমাদের তৎকালীন আমীরে জামায়াত ও সেক্রেটারি জেনারেল, দুজন হলেন মন্ত্রীপরিষদের সদস্য। আমীরে জামায়াতের প্রথম মন্ত্রণালয়টি ছিল কৃষি মন্ত্রণালয়। পৌনে দুই বছর পর এটি পরিবর্তন করে দেওয়া হয় শিল্প মন্ত্রণালয়। ফলে তিনি একই টার্মে দুটি মন্ত্রণালয় সার্ভ করলেন, আলাদা আলাদা। আর মোজাহিদের আগাগোড়াই ছিল সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। সেই সময়টাতেও অস্থিরতা ছিল। দুই দিক থেকে। আওয়ামী লীগ প্রথম দিনই বলে দিয়েছে, একটি দিনের জন্যও শান্তিতে থাকতে দেবো না। এটা শেখ হাসিনার বক্তব্য ছিল। সরকার গঠনের সঙ্গে সঙ্গেই।
২০০৪ সালের ৩০ এপ্রিল একটা ট্রাম্প কার্ডের কথা বলেছিলেন তখনকার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল। সেখানে তাদের পরিকল্পনা ছিল, সারা বাংলাদেশ থেকে এনজিওকর্মীদের কনভিন্স করে সচিবালয় ঘেরাও করে বড় ধরনের একটা পরিবর্তন ঘটাবে। এটা ফয়েল হয়ে যায়। এরপর কিছু রিলিজিয়াস আউটফিট মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। তারাও দেশকে অস্থির করে। প্রায় সবগুলো আদালতে তারা বোমা ফাটায়। গাজীপুরে মনে হয় একজন আইনজীবী মারাও যান। এরকম একটা ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। তখনকার সরকার এটাকে কঠোরভাবে দমনের উদ্যোগ হাতে নেয়। এদের গ্রেপ্তার করে, কেউ কেউ মারা যায় গ্রেপ্তারের সময়, পরবর্তী পর্যায়ে মারা যায় এবং কারও কারও ট্রায়াল শুরু হয়। তাদের কনভিকশন দেওয়া হয়।
তবে এদের বিরুদ্ধে মেইনস্ট্রিম ধর্মীয় নেতারা কথা বলেন। ফলে এরা সমাজে তখন আর নিজেদের পরিসরটা বড় করতে পারেনি।
তারপর ১৪ দল নিয়ে শেখ হাসিনা আন্দোলন শুরু করেন। ট্রানজিশনাল পিরিয়ডটা ছিল ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর। ২৯ তারিখ ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা। অর্থাৎ সবার পদত্যাগ করার কথা। কেয়ারটেকারের হাতে দায়িত্ব তুলে দেওয়ার কথা। ২৮ অক্টোবর পল্টন মোড়ে লগি-বৈঠার তাণ্ডব হলো এবং ছয় জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। তারা সবাই আমাদের দলের ছিলেন। দুজন ছাত্র, বাকিরা সাধারণ সমর্থক। এর মধ্যে দুটি মরদেহ আওয়ামী লীগ নিয়ে গেল এবং তাদের বলে দাবি করল। পরে এটা মিথ্যা প্রমাণ হলো। প্রকাশ্য দিবালোকের এই নৃশংস ঘটনা গোটা দুনিয়ার মানুষকে খুবই আহত করল। কারণ, সব স্যাটেলাইট চ্যানেল এটা কাভার করেছে। বহু জায়গায় শিশুরা রাতে ঘুমাতে পারত না এই দৃশ্য দেখার পর। অনেক বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান বলেছেন, এটা কী দেখলাম? আমরা আতঙ্ক অনুভব করছি।
এই ঘটনা অস্থিরতার মধ্য দিয়ে নতুন একটা পরিবেশ সৃষ্টি হলো। একটা কেয়ারটেকার গঠন হলো, প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিনের অধীনে। এটা অস্বাভাবিক। প্রেসিডেন্ট নিজেই কেয়ারটেকারের প্রধান। যদিও সংবিধানে প্রভিশন আছে, কিন্তু এর আগে এমন হয়নি। এটা ফেইল করল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অস্থিরতা তৈরির কারণে। দায় সবার আছে। এখানে শুধু আওয়ামী লীগের দায়, এটা আমি মনে করি না। একটা সরকারেরও দায় থাকে। এটা ফেইল করার পর আরেকটা কেয়ারটেকার ফর্ম হলো।
আমাদের গঠনতন্ত্রের প্রভিশন অনুযায়ী কেয়ারটেকারের মেয়াদ হচ্ছে তিন মাস। কিন্তু তারা এটাকে টেনে লম্বা করল দুই বছর। তারা চাইলেন শেষ পর্যন্ত নিজেরাই দল গঠন করবেন। সোনারগাঁও বলরুমে একটা সেমিনার আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে কী-নোট পেপার উপস্থাপন করেছিলেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ। এটা ছিল বাংলাদেশি গণতন্ত্রের রূপচিত্র। তিনি এটা দিয়ে জনগণের সমর্থনে একটা দল করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ব্যর্থ হন। যখন তিনি রেসপন্স পেলেন না তখন বুঝতে পারলেন, জনগণ এটা গ্রহণ করেনি। এরপরই চিন্তা করলেন, তাহলে তো আমাদের চলে যেতে হবে।
এই সরকারকে বলা হতো, সেনা সমর্থিত সরকার—যেটার প্রধান ছিলেন ফখরুদ্দিন সাহেব। সেই সরকারের অধীনে নির্বাচন হলো দুই বছরের মাথায়। তখন তারা অনেকগুলো ভুলভাল কাজ করে ফেলেছেন এবং অনেক কিছু গুলিয়ে ফেলেছেন। অনেক দুর্নীতিও হয়ে গেছে তাদের হাতে। অথচ তারা এসেই বলেছিলেন, দুর্নীতিকে একদম মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবো। আমাদের জিহাদ দুর্নীতির বিরুদ্ধে—এই শব্দও ব্যবহার করেছেন। শেষ পর্যন্ত নিজেরাই দুর্নীতিতে জড়িয়ে গেলেন। ফখরুদ্দিন জড়িয়েছেন কি না, জানি না। তবে তিনি রাষ্ট্রের আমানত ক্ষুণ্ণ করেছেন। তিন মাসের জন্য এসে দুই বছর থেকেছেন—এটা অন্যায় করেছেন। তারপরও জাতি নির্বাচন মেনে নিলো।
তখন তাদের সেফ এক্সিট দরকার ছিল। তারা দুই নেত্রীর কাছে গেছেন। একজন বলেছেন, পার্লামেন্ট সিদ্ধান্ত দেবে। আরেকজন বলেছেন, সবকিছু দেখব না, আমি মেনে নিলাম। তিনি মেনে নিয়েছেন, সম্ভবত তাকেই তারা ফেভার করেছে এবং তিনি ক্ষমতায় আসলেন। তিনি এত বেশি আসন পেয়ে অবাক হয়ে গিয়ে বললেন, 'আমি কল্পনাও করিনি এত আসনে আমরা বিজয়ী হব'। পরে অবশ্য এরশাদ বলে দিয়েছেন এত আসন কীভাবে এসেছে। এরশাদ কিন্তু তখন বিরোধী দলেও ছিলেন, আবার এরশাদের দল মন্ত্রীপরিষদেও ছিল। এটা একটা আজগুবি কাণ্ড। তিনি একপর্যায়ে বক্তব্য দিতে গিয়ে বললেন, আমাদের ভুলে গেলে চলবে না এই সরকার কীভাবে এসেছে। তারা জনগণের ভোটেই শুধু আসেনি, কারা এনেছে সেটা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। মানে তিনি সামরিক শক্তির দিকে ইঙ্গিত করেছেন। আমি এটা বলতে চাচ্ছি না। তিনি বলেছেন, তার কথাটাই আমি কোট করলাম এখানে।
অস্থিরতার ভেতর দিয়েই বাংলাদেশ যাচ্ছে। এরপর স্থির হলো কখন? ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে তারা ক্ষমতা হাতে নিলেন। তারপর থেকে কি বাংলাদেশ স্থির হয়েছে? অস্থিরতা তো শুরু হয়ে গেল, পিলখানায়। এতগুলো সামরিক অফিসারের হত্যাকাণ্ড। ৫৭ জন অফিসার। বিশাল ব্যাপার। একটা দেশে কখনো কোনো কালে এটা ঘটেনি। তাদের পরিবারের সদস্যরা মারা গেলেন। মহিলাদের ইজ্জত কেড়ে নেওয়া হলো। লাশগুলো ড্রেনে ভাসিয়ে দেওয়া হলো। তারপর পুরোটা সময় তারা বিরোধী দলের বিরুদ্ধে কার্যত জিহাদ ঘোষণা করেছে। কোনো বিরোধী দলের অস্তিত্ব রাখবে না—এটাই আমাদের কাছে মনে হয়েছে।
আর্মির ওপর আঘাতের পরই জামায়াতে ওপর আঘাত করা হয়েছে। জামায়াতকে বলা হলো, তারা যুদ্ধাপরাধ করেছেন। সুতরাং এই অপরাধে তাদের বিচার হবে। যদিও তাদেরকে এই অপরাধে গ্রেপ্তার করা হয়নি। গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ধর্মীয় অবমাননার জন্য। তরিকত ফেডারেশনকে দিয়ে মামলা করানো হয়েছিল। এই তরিকত ফেডারেশন আগাগোড়া আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছিল।
এখানে অস্থিরতা। একে একে অনেককে ফাঁসি দেওয়া হলো, জেলের ভেতর অনেকে মারা গেলেন, বাইরে মারা গেলেন। অনেকে গুমের শিকার হলেন, অনেকে পঙ্গু হলেন। এই সংখ্যাটা অনেক। এখনো অনেকের ব্যাপারে আমরা জানি না যে তারা বেঁচে আছেন কি না। আল্লাহ ভালো জানেন। আমাদের সব অফিস-আদালত অলিখিতভাবে সিলগালা করে দেওয়া হলো। কোথাও আমাদের বসার পরিবেশ রইলো না।
গোটা সময়ের ভেতর দুইবার ছাড়া আমাদের কোনো ধরনের সমাবেশ করতে দেওয়া হলো না—২০২৩ সালের ৩০ জুন ও ২৮ অক্টোবর। এ ছাড়া, সাড়ে ১৫ বছরে কখনো আমাদের রাস্তায় নামতে দেওয়া হয়নি। তারপরও আমরা নেমেছি ঝুঁকি নিয়ে। আমরা ধরেই নিতাম, আজকে আমাদের বিরুদ্ধে কয়েকটা মামলা হবে। যতই শান্তিপূর্ণ থাকি, আমাদের ধরে আজেবাজে মামলা দেওয়া হবে এবং তাই হয়েছে সারা দেশে। হাজার হাজার মামলা, লাখ লাখ আসামি, দফায় দফায় জেলের ভেতর যাওয়া-আসা—এগুলো আমাদের চলেছে। অনেকের চাকরি কেড়ে নেওয়া হয়েছে। অনেককে বিভিন্নভাবে নিগৃহীত করা হয়েছে। বহু মায়ের বুক খালি করা হয়েছে। বহু যুবতী বোনকে বিধবা করা হয়েছে। অনেক সন্তানকে এতিম বানানো হয়েছে। এসব কষ্ট আমাদের বুকে আছে। এটা অস্থিরতা। স্থিরতার ভেতর দিয়ে রাষ্ট্র কখনো যায়নি।
এরপর ৫ আগস্ট পট পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু দেশ এখনো স্থিতিশীল হয়নি। দেশটা স্থিতিশীল হতে হবে। আমরা কি এভাবেই অনাগত কাল চলতে থাকব? একটা জায়গায় থামতে হবে আমাদের। এই থামার জায়গা থেকে দেখেন, এত বড় মজলুম সংগঠন হওয়া সত্ত্বেও আমরা পুরো সময় ধরে আমাদের সহকর্মীদের এই মোটিভেশন দিয়েছি যে, অবশ্যই এর পরিবর্তন হবে। এই রেজিম চলবে না। একটা সময় আল্লাহ পরিবর্তন করে দেবেন। সব মানুষ যখন মজলুম হয়ে যাবে, তখন সবাই রুখে দাঁড়াবে। আমাদের কর্মীদের মোটিভেশন দিয়েছি, আমরা আইন হাতে তুলে নেবো না এবং ব্যক্তিগতভাবে কারও ওপর সামান্য প্রতিশোধও নেবো না। সারা বাংলাদেশে এত বড় পরিবর্তনের পরও আমাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। যা হওয়ার তার সিংহভাগই হয়ে গেছে পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে। দখল, চাঁদাবাজি, মানুষকে ভয়-ভীতি প্রদর্শন, এমনকি দু-চারটা মব জাস্টিসের ঘটনা। কিন্তু এরকম কিছুর অভিযোগ আমাদের বিরুদ্ধে নেই।
দেশটাকে স্থিতিশীল করার জন্য একটি দায়িত্বশীল সংগঠন হিসেবে আমরা পারফর্ম করতে চাই। এ জন্যই এত ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছি। প্রতিশোধ যদি নিতে হয়, সব দলের আগে অধিকার আমাদের। সংখ্যাতাত্ত্বিক দিক থেকে অনেকের ক্ষতি আমাদের চেয়ে বেশি আছে, এটা জানি। কিন্তু গুরুত্বের দিক থেকে আমাদের সমপরিমাণ ক্ষতি কারোই হয়নি। দুজন আমির থেকে শুরু করে পার্টির সব জ্যেষ্ঠ নেতাকে শেষ করে দেওয়া হয়েছে। আমি সেই পর্যায়ের কেউ ছিলাম না। তাদের শেষ করে দেওয়ার কারণে আমাদের ওপর এই দায়িত্বের চাপটা এসেছে। আমরা এই স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্যই এত স্যাক্রিফাইস করেছি। এটাকে স্যাক্রিফাইসও বলতে পারেন, আবার এটাকে নাগরিক দায়িত্বও বলতে পারেন। আমি চাইছি সেটাই হোক, দেশ একটা স্থিতিশীলতার মধ্যে যাক।
এখন যে সরকার এসেছে, তাদের মধ্যে সবার দৃষ্টিভঙ্গি, ক্যাপাসিটি নিশ্চয়ই সমান হবে না। একই মায়ের সন্তান, পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে দুই ভাইয়ের দৃষ্টিভঙ্গি কখনো হুবহু সমান হয় না। তাদেরও সমান হবে না। তারা যদি আন্তরিকতার জায়গা থেকে এই দায়িত্বকে জাতির আমানত মনে করে কাজ করেন, দেশের জন্য তারা ভালো কিছু রেখে যেতে পারবেন।
কিন্তু, তাদেরও যদি অতীতের (সরকারগুলোর) মতো লোভ-লালসা এসে যায়, তাহলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তারচেয়ে বড় কথা, তারা জাতির সব প্রত্যাশাকে গুড়িয়ে দেবেন। সুতরাং তাদের ওপর গুরুদায়িত্ব, এটা তাদের এসিড টেস্ট।
এখানে সরকারের মধ্য থেকেও মাঝে মাঝে কেউ কেউ রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে ফেলেন। জাতি এটা তাদের কাছ থেকে আপাতত শুনতে চাইছে না। কারণ এই সরকারটা নির্দলীয় সরকার। নির্দলীয়র মুখ থেকে দলীয় কথা না আসাই ভালো। কেউ যদি বলে থাকেন, তাহলে সেটা জাতির জন্য, তার জন্য, কারো জন্যই কল্যাণকর হবে না। আশা করি, তারা অধিকতর সচেতনভাবে আন্তরিকতার সঙ্গে এই কাজগুলো করবেন। দেশে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।
আপনার প্রশ্ন ছিল, কোনো আশঙ্কা দেখি কি না। আশঙ্কা কখনো উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। কারণ, এই ঘটনার (গণঅভ্যুত্থান) পর একটা জুডিশিয়াল ক্যুয়ের কথা আসল। যার পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টে বড় পরিবর্তন আসতে বাধ্য হলো। এরপর আমরা আনসারদের একটা ব্যাপার দেখলাম। সেখানে আনসারের মহাপরিচালক বললেন, যারা গিয়েছিল তারা সবাই আনসার নয়। তাহলে আনসারের পোশাক পরে যারা আসল, তারা কারা? এভাবে অনেক জিনিস দেখতে পাচ্ছি বিভিন্ন পর্যায়ে। বিভিন্ন দিক থেকে উস্কানি দেওয়া হচ্ছে।
আপনারা লক্ষ্য করেছেন, ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের ধর্মীয় জায়গাগুলো দায়িত্বশীলতার সঙ্গে অনেকে পাহারা দিয়েছেন। সেখানে আমরাও ছিলাম। এটা এর আগে কখনো ঘটেনি। আমি এটাতেও রাজি না। আমরা মনে করি, সব নাগরিকের অধিকার সমান। মসজিদ পাহারা দিতে না হলে মন্দির পাহারা দিতে হবে কেন? তার মানে, দেয়ার ইজ সাম সিকিউরিটি কনসার্ন। এটার কারণেই পাহারা দেওয়া হচ্ছে। আমাদের সমাজ সেটা নিশ্চিত করতে পারেনি, এটা দুঃখজনক। ধর্ম ও দল যার যার, কিন্তু রাষ্ট্র সবার। নিরাপত্তার অধিকার সবার সমান। এর ব্যতিক্রম কোনো দেশের জন্য, সমাজের জন্য কল্যাণকর হবে না।
ডেইলি স্টার: দীর্ঘমেয়াদি ও সুদূরপ্রসারী চিন্তার জন্য জামায়াত প্রশংসিত বলে আমরা জানি। রাজনৈতিক বোদ্ধারা বলেন, আপনার দল অনেকদূর পর্যন্ত চিন্তা করে পা ফেলে। অথচ উপমহাদেশের দুটি সন্ধিক্ষণেই গণজোয়ারের (১৯৪৭ এর দেশভাগ ও ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ) বিপরীতে জামায়াতের অবস্থান ছিল। আপনি এটা কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
শফিকুর রহমান: গণজোয়ারের বিপক্ষে ছিল, এটা ঠিক। কিন্তু কখনো জামায়াতের কোনো নেতা বলেননি, আমরা পাকিস্তান চাই না, এক ভারত চাই (১৯৪৭ সালে)। তাদের বক্তব্য ছিল, পাকিস্তান আন্দোলনের নেতারা বলেছিলেন–পাকিস্তানের মূলমন্ত্র লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আর পাকিস্তানের সংবিধান আল কুরআন। মওদূদী রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর সঙ্গে এই ব্যক্তিগুলোর চরিত্রের মিল থাকতে হবে, কুরআনের চরিত্র তাদের মধ্যে থাকতে হবে। তিনি আফসোস করে বলেছিলেন, 'দুঃখজনকভাবে আমি তাদের মধ্যে এই চরিত্র দেখছি না। আমি আশঙ্কা করছি, তারা ইসলামের নামে, কুরআনের নামে যে রাষ্ট্রটা গড়তে চাইছেন, শেষ পর্যন্ত তাদের কাছে এই কুরআন ও কালিমা অমর্যাদার কারণে পরিণত হবে।' তিনি আহ্বান জানান, আসুন নিজেকে পরিবর্তন করি। আগে আপনারা কুরআনের চরিত্র ধারণ করুন। এটা কি তার অন্যায়? এটাকে এখন লোকে বলে, তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের বিরুদ্ধে ছিলেন। তিনি পাকিস্তানের বিরোধিতা করলে ভারত থেকে পাকিস্তানে মাইগ্রেট করলেন কেন? এক ভারতের পক্ষে থাকলে তিনি ভারতেই থাকতেন।
আমার একটি সাম্প্রতিক বক্তব্য গেল না?—আমি নাকি আওয়ামী লীগকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছি। বিষয়টা ওইরকম আরকি। আমি আওয়ামী লীগের নামও নেইনি। কিন্তু মিডিয়া সেটা নিয়ে আসলো। এটা দুর্ভাগ্যজনক। আমি বলেছিলাম, যারা আমাদের ওপর জুলুম করেছে, আমরা তাদের সবাইকে ক্ষমা করে দিলাম। আমরা কোনো প্রতিশোধ নেবো না। এটাকে কি সাধারণ ক্ষমা বুঝায়, নাকি আওয়ামী লীগকে ক্ষমা করা বুঝায়?
অনেকে প্রশ্ন করেছেন, আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কে? আমি বললাম, অনেকেই আমাদের ওপর দফায় দফায় বিভিন্ন পর্যায়ে জুলুম করেছে। আমরা কারো নাম যেহেতু নেইনি, নিতে চাইছি না। আওয়ামী লীগ বেশি করেছে, অন্যরা একটু কম হলেও করেছে। আমরা সবার ব্যাপারেই একটা কমন নীতি গ্রহণ করেছি। সেটি হচ্ছে—প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার রাজনীতির কবর রচনা করা উচিত। এটা এক জায়গায় থামা উচিত। বিড়ালের গলায় কাউকে না কাউকে ঘণ্টা বাঁধতে তো হবে। সেটা আমি বাঁধি! আবার এটাও বলেছি, যারা বিভিন্ন অপরাধ করেছে, তাদের বিচার না হলে অপরাধের সংস্কৃতি আরও বাড়বে। ক্ষতিগ্রস্তরা মামলা করলে আমাদের সহায়তা পাবে। আমরা এটাও বলেছি, মামলায় কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে যেন জড়ানো না হয়।
এবার আসেন ৭০-র নির্বাচন ও ১৯৭১। এটাকে আপনি বলতে পারেন, গণজোয়ারের বিপক্ষে ও এক পাকিস্তানের পক্ষে। শেখ মুজিবও এক পাকিস্তান চেয়েছেন। তিনি শেষদিন পর্যন্ত আলোচনা চালিয়েছেন যে সারা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া তার ন্যায্য অধিকার। আমাদের আর তার দৃষ্টিভঙ্গির কোনো তফাৎ ছিল না। এখন বলবেন, এরপর যখন মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ল, জাতি যখন মুক্তিযুদ্ধে ঝুঁকে পড়ল, আপনারা তখন ঝুঁকেননি কেন?
মুক্তিযুদ্ধটা বাংলাদেশের ভেতর থেকে কমই হয়েছে। বেশিরভাগই হয়েছে ভারত থেকে। বিদ্রোহ করে হোক বা আশ্রয়ের সন্ধানে দুই ধরনের মানুষই ভারতে গিয়েছেন। কিছু মানুষ জীবন-ইজ্জত বাঁচানোর জন্য গিয়েছেন, কিছু মানুষ যুদ্ধের জন্য গিয়েছেন। যারা গিয়েছেন, তাদের সংখ্যা ছিল এক কোটি। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা এত ছিলেন না। এক-দুই লাখ ছিলেন, তাই না? তাতে বোঝাই যাচ্ছে, এর (শরণার্থীদের) এক-দুই শতাংশ ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। সেই মুক্তিযুদ্ধে ভাসানীও গিয়েছিলেন শরিক হতে। তাকে ভারত থাকতে দিল না কেন? তিনি তো কোনো ইসলামী দল করতেন না। তার নামের আগে 'মাওলানা' লেখা আছে, এ জন্য তিনি ভারতে থাকতে পারেননি। তিনি ভারত থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। এখন বলুন, জামায়াতে ইসলামী বা অন্যান্য ইসলামী দলের কি তখন ভারতে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল? যদি না-ই থাকে, তাহলে তারা মুক্তিযুদ্ধটা কীভাবে করতেন?
প্রশ্ন আসবে, মুক্তিযুদ্ধে গেলেন না, চুপ থাকতে পারতেন। হ্যাঁ, আমরা চেয়েছিলাম এক পাকিস্তান থাকুক। আওয়ামী লীগ তাদের যে অধিকার জনগণের ভোটের মাধ্যমে পেয়েছে, সেটা ফিরে পাক। কিন্তু ভুট্টোর গোঁয়ার্তুমির কারণে তা হয়নি। এর জন্য শেখ মুজিব দায়ী না, অন্য কেউ দায়ী না। এককভাবে দায়ী জুলফিকার আলী ভুট্টো। এক দেশ দুই প্রধানমন্ত্রী ক্লেইম করার কারণেই এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে। তিনি পাকিস্তানের শাসন এখতিয়ার শেখ মুজিবকে দেবেন না। তিনি পশ্চিম পাকিস্তান শাসন করবেন, আর শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের শাসন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবেন। এটা ছিল তার অন্যায়, অসাংবিধানিক আবদার। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠী এটাকেই প্রশ্রয় দেয়। এর মাধ্যমেই নিপীড়ন শুরু হলো। জামায়াতে ইসলামী তখনো এক পাকিস্তানের পক্ষেই ছিল। এই চাওয়া তাদের দোষ না গুণ, আমি সেই বিবেচনায় যাচ্ছি না।
কেন চেয়েছে? তখনকার নেতাদের ধারণা ছিল, ভারতের আনুকূল্যে, সহযোগিতায় ও প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে যদি বাংলাদেশ স্বাধীন হয়, তাহলে বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতার সুফল পুরোপুরি ভোগ করতে পারবেন না। তাদের বৈধ-অবৈধ প্রভাব বাংলাদেশের ওপর চলবেই। এতে করে একটি স্বাধীন, মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে এই জাতি আত্মপ্রকাশ করতে পারবে না। স্বাধীনতার ৫৩ বছরে কী হয়েছে, তার সাক্ষী জনগণ। মিডিয়া জাতির দর্পণ, এই বিচার আপনাদের ওপর ছেড়ে দিলাম। জামায়াত নেতাদের এই অ্যাপ্রিহেনশন যদি ভুল হয়, তাহলে কেউ বলুক, না এটা হয় নাই, তারা মিথ্যে আশঙ্কা করেছে। আর যদি দূরদর্শিতার জায়গা থেকে তারা এটা উপলব্ধি করে থাকেন, আর এটাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে জনগণ সেটাও বিবেচনায় আনুক।
যেই স্রোতে কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণের সম্ভাবনা বেশি, আমি কি সেই স্রোতে ঝাঁপ দেবো? নাকি আমি একা হলেও বিবেক যেটা বলে, সেখানে দাঁড়ানোর চেষ্টা করব? জামায়াত সেটাই করেছে। এর বেশি কিছু করেনি।
এখন আসেন অপরাধের প্রসঙ্গে। যেগুলো বলে আমাদের নেতাদের বিচার করা হয়েছে, সেগুলো তারা করেছেন কি না। এখানে আলবদর, আল শামস, রাজাকার গঠনের ব্যাপারে আপনাদের প্রশ্ন আছে যে, এগুলো কতটুকু সঠিক এবং অপরাধের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কতটুকু। এগুলো ছিল, এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। পাকিস্তান সরকার সবগুলো (সংগঠনকে) নিয়ন্ত্রণ করেছে। তারা এসবের জন্ম দিয়েছে। আমি ছোটবেলায় দেখেছি, বাজারের হাটে ঢোল বাজিয়ে রাজাকারে লোক ভর্তি করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হতো। এখন সেই বাহিনীগুলো যত অপকর্ম করেছে, তার দায় জামায়াত নেবে কেন? যদি পাকিস্তান সরকারই এগুলো নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, এর দায় জামায়াতের ওপর আসে কীভাবে?
৭০-র নির্বাচনে জামায়াত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছিল। তবে সেটা খুব বেশি ছিল না। চার থেকে সাড়ে চার শতাংশ, এর বেশি না। বাকিটা পুরোই আওয়ামী লীগের পাওনা ছিল, পেয়েছে। জামায়াত এত পাওয়ারফুল হয়ে গেল? পাকিস্তানি মিলিটারির চেয়েও পাওয়ারফুল? রাজাকারের চেয়েও পাওয়ারফুল? আমি জানি না। আমার এলাকায় এটা দেখিনি। সারা দেশের খবর বলতে পারব না। আমি ছোট্ট একটা এলাকায় থাকতাম, সেখানে জামায়াতের কেউ আছে এটা আমরা চিন্তাও করিনি। জামায়াত ওই পর্যায়ে খুবই ছোট পর্যায়ের একটি সংগঠন ছিল। একটা বাক্স ছিল জামায়াতের ৭০-এর নির্বাচনে, ভোট পেয়েছে ১৮টি। সেটাই ছিল জামায়াতের অবস্থা।
হ্যাঁ, আমি একমত যে, কেউ অপরাধ করলে, সেটা আমি নিজে হলেও বিচার হওয়া উচিত এবং যথাযথ শাস্তি পাওয়া উচিত। তখনকার জামায়াতের কোনো নেতাকর্মী বা ছাত্র সংঘের কেউ যদি অপরাধ করে থাকেন তারও বিচার হওয়া উচিত।
তখনকার (যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের) শাসনটা কার ছিল? এটা কি জামায়াতে ইসলামীর শাসন ছিল নাকি শেখ মুজিবের শাসন ছিল? তারা যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা তৈরি করলেন। ২৪ হাজার লোকের বিরুদ্ধে মামলা দিলেন। অনেকে জেল খাটলেন। বিনা মামলায় জেলের ভেতরে ছিলেন, নিরাপত্তার স্বার্থে। তখন হাজার হাজার মামলা দেওয়া হলো, ৪২ বছর পর যে লোকগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হলো, তাদের বিরুদ্ধে তখন একটা অভিযোগ দিতে পারল না কেন? কোনো একটা থানায় তাদের বিরুদ্ধে সামান্য একটা অভিযোগের ছোঁয়াও থাকল না কেন? থাকলে তো আমরা পরবর্তী প্রজন্ম বুঝতাম, ওই সময় তারা কিছু করেছেন বলেই অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। সেটা নেই কেন? ৪২ বছর পর এসে এটা হঠাৎ করে তৈরি হলো কীভাবে?
তৈরি কীভাবে হয়েছে সেটা (সুরেন্দ্র কুমার) সিনহা তার লেখা বইয়ে বলেছেন। তার ভূমিকা এবং এই সব বিষয়ে তিনি কিছু কথা লিখেছেন। তার সব কথা সঠিক না বেঠিক, এটাও আমি বলতে যাচ্ছি না। কারণ তিনিও হয়তো জুলুমের শিকার হয়ে বেশিও লিখতে পারেন, কমও লিখতে পারেন ভয়ের জায়গা থেকে। কিন্তু তিনি লিখেছেন। আরও অনেকে লিখেছেন। সবগুলো মিলিয়ে এটা একটা বড় প্রশ্ন যে, আসল অপরাধী কারা ছিল? মানুষ মারা গেছে, এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। মানুষের ইজ্জত লুণ্ঠন হয়েছে, এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। গরিবের বাড়িঘর লুট হয়েছে, এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। কিন্তু আসল অপরাধী কারা? এটা ওই ২৪ হাজার মামলা থেকেই খুঁজে বের করা দরকার ছিল। সেটার সমাধান হলো না কেন? ঠিক আছে, পৌনে চার বছরে সব পারা যায় না। সেটার কন্টিনিউয়েশন হলো না কেন?
শেখ মুজিব সবাইকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন। চারটা অপরাধ ছাড়া—খুন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ। যাদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযোগ আছে, তাদের ক্ষমা করা হলো না। বাকি সবাইকে ক্ষমা করা হলো। কিন্তু এগুলো থেকে গেল। এগুলোর লিগ্যাসি থেকে গেল। এগুলোর সল্যুশন হলো না কেন? ৪২ বছর পর এসে সবকিছু জামায়াতের ঘাড়ে ফেলে দেওয়া হলো। এটা কতটুকু ন্যায়বিচার?
যে ট্রায়ালটা হলো, সেটাও একটা ক্যাঙ্গারু ট্রায়াল। সারা দুনিয়া এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা একবার বলেছে এটা যুদ্ধাপরাধ। আবার বলেছে, না এটা যুদ্ধাপরাধ না, মানবতাবিরোধী অপরাধ। একবার বলেছে, এটা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল। আরেকবার বলেছে, না এটা ডোমেস্টিক ট্রাইব্যুনাল। সবকিছুর মাঝেই একটা গোঁজামিল ছিল। আপনি পাপ করেন না আর না করেন, আপনাকে পাপে সাব্যস্ত করতে হবে—সেখানেই তারা ফোকাস করেছেন।
এখন আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, ওই সময়ের আমি সাক্ষী থাকি আর না থাকি, যদি সন্দেহাতীতভাবে এ ধরনের কোনো ভুল বা অপরাধ প্রমাণিত হয়, আমি দায়িত্ব নিয়ে ক্ষমা চাইব জাতির কাছে। আমার কোনো রিজার্ভেশন নেই এ ব্যাপারে। কিন্তু কোনো গোঁজামিল বা মিথ্যা চাপিয়ে দেওয়া হবে, আমি মিথ্যাকে সত্য বলব, এটা আমার পক্ষে সম্ভব না।
এই বিচারের প্রক্রিয়া যখন চলে, তখন সারা বাংলাদেশে আমাদের কী হালতে রাখা হয়েছিল, তা আপনারা জানেন। আমাদের পক্ষের সাক্ষীদের আদালত প্রাঙ্গণ থেকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল, এটারও সাক্ষী আপনারা। আমরা সম্পূর্ণ নিরাপত্তাহীনতায় ছিলাম। আমাদের এ দেশের মানুষ হিসেবেই স্বীকার করা হয়নি। এমন আচরণ আমাদের সঙ্গে করা হয়েছে। আমরা বিচার পাব কোথায়। এটা তো সিম্পল মিসক্যারেজ অব জাস্টিস। এরচেয়ে বেশি কিছু না। সেটাই আমাদের ওপর করা হয়েছে।
ডেইলি স্টার: এখানে আপনি বলছেন, সন্দেহাতীতভাবে যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে ক্ষমা চাইতে আপনার দ্বিধা থাকবে না।
শফিকুর রহমান: হ্যাঁ, কোনো দ্বিধা থাকবে না।
ডেইলি স্টার: আপনি বলছেন, রাজাকার, আল বদর, আল শামসের মতো সংগঠনগুলো তো পাকিস্তানি সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং পরবর্তীতে শেখ মুজিব দেশ শাসন করেছেন। তাহলে এগুলোর দায় কেন জামায়াতের ওপর বর্তাবে।
শফিকুর রহমান: হ্যাঁ, সবকিছু তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
ডেইলি স্টার: কিন্তু একটি বিষয় পরিষ্কারভাবে দেখা যায় বিভিন্ন ঐতিহাসিক নথিতে, এমনকি হামুদুর রহমান কমিশনের নথিতেও, এসব বাহিনী যেখানে তৈরি হয়েছিল, সব জায়গায় নেতৃত্ব দিয়েছিল জামায়াতে ইসলামী, ছাত্রসংঘ এবং তাদের সমমনা ইসলামী দলগুলো। তাহলে এখানে একটা পরিষ্কার দায় পড়ে না জামায়াতে ইসলামীর ওপর?
শফিকুর রহমান: একটা কথা আছে, ইতিহাস বিজয়ীর পক্ষে। যে ইতিহাস আজকে বলছে এরকম, দুদিন পর এসে বলছে, না এটা ইতিহাসের বিকৃতি। এটা কিন্তু প্রতিষ্ঠিত সত্য একটা কথা। আমি সেই বিতর্কে যাচ্ছি না। আসেন এই সরকারের (আওয়ামী লীগ) আমলেই আমি প্রমাণ দেই।
এই সরকার রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করেছে একটি কিস্তিতে। সেখানে জামায়াতে ইসলামীর ১০ হাজার আর আওয়ামী লীগের ১৩৪ জন ছিল, নাকি আওয়ামী লীগের ছিল ১০ হাজার, আর জামায়াতের ১৩৪ জন? তাহলে রাজাকারের দল কোনটা? এরপর যখন (এই তালিকা) তাদের পছন্দ হলো না, সঙ্গে সঙ্গে বলল—এটা বাতিল।
তাহলে বলতে হবে, আ ক ম মোজাম্মেল জামায়াতের আমির বা রোকন। এ জন্য তিনি সরকারকে বিভ্রান্ত করেছেন। তিনি যদি জামায়াতের আমির বা রোকন হন, জামায়াতকে যদি ফেভার করেন, তাহলে তাকে এতদিন আওয়ামী লীগে রাখছে কেন? ওই (মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক) মন্ত্রণালয়েই বা তাকে রাখা হয়েছে কেন? প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে—যেভাবে আমার কথা সাধারণ ক্ষমা নিয়ে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগকে ক্ষমা করে দিয়েছি—এরকম ইতিহাস বানানো খুবই সহজ।
আমি পরিষ্কার বলতে চাই, তখন (মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের দলে) জামায়াত ছিল, ছাত্র সংঘ ছিল, মুসলিম লীগ ছিল, এনএসএফ ছিল। বহু দল ছিল। আওয়ামী লীগের লোকেরাও কিন্তু রাজাকারে ছিল। এটা আমার চোখে দেখা। তারা কেন গিয়েছে, কোন দর্শন থেকে গিয়েছে, এক পাকিস্তানের জন্য গিয়েছে না নিজের পরিবার রক্ষার জন্য গিয়েছে, তা তারা ভালো জানে। এক ভাই মুক্তিযোদ্ধা, আরেক ভাই রাজাকার। এটা আওয়ামী লীগ সরকারও বলেছে—সব রাজাকার খারাপ নয়, কিছু ভালো রাজাকারও ছিল। শেখ হাসিনা নিজে বলেছেন।
কোন রাজাকারগুলো ভালো ছিল? সম্ভবত আমার দলেরগুলো ভালো ছিল। আর অন্য দলগুলো খারাপ ছিল—আমি ওই বিতর্কে যাচ্ছি না। সেখানে সব দলের মানুষ ছিল। বাংলাদেশে, পূর্ব পাকিস্তানে তখন যারা ছিল, যারা ভালো মনে করেছে, সরকারের ডাকে সাড়া দিয়েছে। এটাকে দলের দায়বদ্ধতা বলা যাবে না। এটা ব্যক্তির দায়বদ্ধতা। হ্যাঁ, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বা পূর্ব পাকিস্তান জামায়াত ইসলামীর কোনো রেজ্যুলুশনের মাধ্যমে যদি এ রকম (মুক্তিযুদ্ধবিরোধী) কোনো দল গঠন হয়ে থাকে, আর সেই রেজ্যুলুশনের ডকুমেন্ট যদি আওয়ামী লীগের কাছে যায়, সেটা অবশ্যই জাতি গ্রহণ করবে। আমিও গ্রহণ করব। কিন্তু আপনি বলে দিলেন আর আমি হয়ে গেলাম, বিষয়টা এমন না।
ডেইলি স্টার: তাহলে আপনি এটা মানছেন যে, কোনো কোনো ব্যক্তি আল বদর, আল শামস বা রাজাকারের সদস্য হতে পারেন। এসব সংগঠনের নেতা হতে পারে। কিন্তু সেটা জামায়াতে ইসলামীর দলগত সিদ্ধান্ত ছিল না। তাই জামায়াতে ইসলামী দল হিসেবে এর দায় নেবে না?
শফিকুর রহমান: হ্যাঁ, শুধু জামায়াতে ইসলামী না, সব দলের। আমি সাক্ষী, আমার এলাকায় আওয়ামী লীগের লোকেরা গিয়েছে রাজাকারে এবং এই তালিকায় তা প্রমাণ হয়েছে। যে তালিকা আ ক ম মোজাম্মেল মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশ করলেন, সেই তালিকায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক কর্মী ছিল আওয়ামী লীগের। তার ধারে কাছেও কোনো দল নেই।
ডেইলি স্টার: একইভাবে, সাম্প্রতিক গণহত্যার অভিযোগ এসেছে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। তাদের কি দলগত গণহত্যার রেজ্যুলুশন ছিল?
শফিকুর রহমান: দলের নেত্রীই ঘোষণা দিয়েছে।
ডেইলি স্টার: এটাকে ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা হিসেবে দেখবেন না?
শফিকুর রহমান: না, নেত্রী কোনো ইন্ডিভিজ্যুয়াল না। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে (ঘোষণা দিয়েছেন)। আমি বললে কি পুলিশ আমার কথা শুনবে? তিনি তার ক্ষমতার জায়গা থেকে, তার রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের জায়গা থেকে হত্যা করেছেন। তিনি কিন্তু ইন্ডিভিজ্যুয়াল না। তিনি কর্তৃপক্ষ।
ডেইলি স্টার: সে হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচার দল হিসেবেই হতে হবে?
শফিকুর রহমান: হ্যাঁ, তিনি দলেরও নেতা। তিনি সরকারেরও নেতা।
ডেইলি স্টার: একইভাবে, ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে জামায়াতে ইসলামীর আমির ছিলেন অধ্যাপক গোলাম আজম। তার নামে চাঁদা তোলা হয়েছে, তিনি বিভিন্ন জায়গায় ভাষণ দিয়ে বলেছেন যে, পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিতে। রাজাকার সম্মেলন বা বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তানের পক্ষে সক্রিয় অবস্থান নেওয়াকে তিনি উৎসাহিত করেছেন। সেটা দলের সিদ্ধান্ত না?
শফিকুর রহমান: আমি এটা বলেছি আগেই। তারা এক পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন। আমি তো বলিনি, তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে চলে গিয়েছিলেন। তারা যেহেতু এক পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন, সুতরাং দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য, স্থিতিশীলতার জন্য যেটা দরকার সেটা বলেছেন। তারা অস্বীকার করেননি যে, তারা এক পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন না।
ডেইলি স্টার: আপনি বলছেন, কোনোভাবেই সেটা সহিংসতার সঙ্গে যোগ করা যাবে না।
শফিকুর রহমান: সহিংসতা যদি কেউ করে থাকে, স্বয়ং গোলাম আজম করে থাকলেও তার বিচার হোক। আমার কোনো আপত্তি নেই। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, তারা যদি অপরাধী হয়ে থাকেন, তাহলে সেই সময় তাদের বিরুদ্ধে কিছুই থাকল না কেন? তখন ঘটনাও তাজা, সাক্ষীও জীবিত, আলামত স্পষ্ট। পরে এই ঘটনা কীভাবে তৈরি করল? সাক্ষী কোথা থেকে আসলো? আপনারা জানেন, সেই বিচারের সময় সেফ হাউজ নামে একটি হাউজ তৈরি করা হয়েছিল। সেখানে লোকদের এনে সাক্ষ্য শিখিয়ে দেওয়া হতো। যারা কথা শুনত না, তাদের মারপিট করা হতো। আর যারা শুনত, তাদের পুরস্কার দেওয়া হতো। এগুলো পত্রিকায় এসেছে। মেইনস্ট্রিম গণমাধ্যমে এসেছে। সরকার এর প্রতিবাদও করেনি। প্রতিবাদ না করার মানে, তারা এটা মেনে নিয়েছে।
ডেইলি স্টার: একদিকে বলছেন, যারা যুদ্ধে জয়ী হয় তারা ইতিহাস লেখে। অন্যদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানে যে বিভিন্ন নথি আছে, সেখানেও পাওয়া যায় যে, পূর্ব পাকিস্তানে জামায়াতে ইসলামীর মতো ইসলামী দলগুলো সশস্ত্র বাহিনীকে সহায়তা করেছে। এগুলোর জন্য কি জামায়াতের ওপর দোষ বর্তায় না?
শফিকুর রহমান: ব্যক্তিগতভাবে যদি কেউ সহিংসতার সঙ্গে জড়িত থাকে, সেটা ব্যক্তির ওপর বর্তাবে না কেন? সে করে থাকলে বর্তাবে। কিন্তু একটা প্রশ্ন দেখেন, যে দলগুলো তখন এক পাকিস্তানের পক্ষে ছিল, তাদের প্রায় সবার অস্তিত্ব এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে আছে। তাদের কারো বিরুদ্ধে প্রশ্ন উঠে না কেন? সবাই অংশগ্রহণ করেছে তখন। শুধু জামায়াতের বিরুদ্ধে কেন অভিযোগ?
প্রথমত, ৪২ বছর কোনো অভিযোগ নেই। এরপর দাঁড় করালেন অভিযোগ। আবার অন্যান্য ইসলামী দল আছে, তাদের কারও বিরুদ্ধে কোনো কথা নেই। তখন এক পাকিস্তানের পক্ষে যাদের অবস্থান ছিল, তাদের অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে সরকারের বাহিনীতে যোগদান করেছে। কারও ব্যাপারে কোনো শব্দ নেই। একটা শব্দও শুনি না। তাহলে কি এটা এই কারণ যে, জামায়াতে ইসলামী এখন মানুষের অন্তরে একটু জায়গা করে নিয়েছে, সুতরাং জামায়াতকে বিভিন্ন দিক থেকে ধরতে হবে। ধরা ছাড়া কোনো উপায় নেই। সেটা ন্যায় হোক বা অন্যায় হোক। যত দোষ নন্দ ঘোষ!
ডেইলি স্টার: নারী স্বাধীনতা ও নারীর অংশগ্রহণের বিষয়ে সবসময় প্রশ্ন আসে। আপনি এর আগে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, জামায়াতে ইসলামীতে ৪২ শতাংশ নারী সদস্য। আপনাদের নারী রোকন কতজন বা কত শতাংশ? অথবা মজলিসে শূরায় নারী প্রতিনিধি কত শতাংশ?
শফিকুর রহমান: আমাদের রোকনের সংখ্যা এক লাখের কাছাকাছি। এর মধ্যে ৪০ থেকে ৪২ শতাংশ নারী। আমাদের সাংগঠনিক কয়েকটা বডি আছে, যার মধ্যে সবচেয়ে বড় বডি হচ্ছে মজলিসে শূরা। এখানে ৩৫ শতাংশের মতো নারী আছেন। এখানে নারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়বে। এরপর আছে কর্মপরিষদ। সেখানেও তাদের অংশগ্রহণ এই পরিমাণেই (৩৫ শতাংশ) আছে। এটাও দিন দিন বাড়ছে।
ডেইলি স্টার: ৯১'র পর আমরা শুধু নারী প্রধানমন্ত্রীই দেখেছি। জামায়াতে নারী প্রধান কবে দেখতে পারব? জামায়াতের নেতৃত্বে নারীরা আসে না কেন?
শফিকুর রহমান: তারা সবাই এসেছেন পারিবারিক সূত্রে। শেখ হাসিনা তার পিতাকে ইনহেরিট করেছেন। খালেদা জিয়া ইনহেরিট করেছেন তার স্বামীকে। রওশন এরশাদ ইনহেরিট করেছে যতদিন পারেন, তার স্বামীকে। রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তৃণমূল থেকে তারা কেউ উঠে আসেননি। তারা তাদের দলের প্রয়োজনে বিশেষ পরিস্থিতিতে এই দায়িত্বে এসেছেন।
এখন আমাদের ক্ষেত্রে আপনারা এরকম পর্যায়ে দেখবেন কি না। আমরা একটি আদর্শভিত্তিক দল। আমাদের আদর্শ মানুষকে মানুষ হতে শেখায় এবং সব মানুষকে শ্রদ্ধা করতে শেখায়। আল্লাহ নারী-পুরুষ সবাইকে নিজেই সৃষ্টি করেছেন। একটা পুরুষের মধ্যে আল্লাহ যেসব গুণাবলী দিয়েছেন, সেটা আমাদের চেয়ে আল্লাহ ভালো জানেন। আবার অনুরূপভাবে, একজন মা-বোন বা মেয়ের মধ্যে আল্লাহ যেটা দিয়েছেন, সেটা আল্লাহ সবচেয়ে ভালো জানেন। আল্লাহ নারী-পুরুষের কাজের কিছু ডিভিশন করে দিয়েছেন। যেমন: ১০ জন পুরুষ এক হয়েও একটা বাচ্চা গর্ভে ধারণ করতে পারবে না। এই সামর্থ্যটা আল্লাহ আমাদের মায়ের জাতিকে দিয়েছেন। একজন মা পেটে সন্তানও ধারণ করবেন, বুকের দুধ খাওয়াবেন, বাচ্চাকে লালন-পালন করবেন, আবার কর্মক্ষেত্রে পুরুষের সমান কাজ করবেন—এটা কি তার ওপর জাস্টিস?
এই কারণে আমাদের সমাজব্যবস্থায় বহু ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। আল্লাহ চান না তার সৃষ্টিতে বিশৃঙ্খলা দেখা দিক। আল্লাহ চান তার সৃষ্টি সুশৃঙ্খল, সুন্দর হয়ে চলুক। সেই দিক থেকে আল্লাহর দেওয়া প্রেসক্রিপশন আছে। সেই প্রেসক্রিপশনটা হচ্ছে, আল কুরআন। আর এটার বাস্তব শিক্ষক হলেন রসূলে করিম (সা.)। এই দুই সত্তার অনুসারী হলেন সাহেবায়ে কেরাম। আমি আপনাদের অনুরোধ করব, প্লিজ গো থ্রু কুরআন। অনেক প্রশ্নের জবাব ক্রিস্টাল ক্লিয়ার হয়ে যাবে। আমি একটা কিছু বলে দিলেই সেটা ইসলাম হবে না। আমি নাকচ করলেই সেটা নাকচ হবে না। এ জন্য ইসলাম যে মূলনীতি গাইড করেছে, এটা মানবতার কল্যাণেই করেছে। সেই কল্যাণের বিবেচনায় জামায়াতে ইসলামী তার নীতি ও কর্মসূচি নিয়ে থাকে। ইসলাম আমাদের যতটুকু ম্যাক্সিমাম এলাউ করবে, তার এক বিন্দুও আমরা কমানোর অধিকার রাখি না। আমরা এই সম্মানের জায়গায় মানবতাকে রাখতে চাই। মায়েদের ওপর অবিচার হবে, এটা আমরা চাই না।
মানব ইতিহাস যদি আমরা পর্যালোচনা করি, তাহলে ইসলামের আগে সমাজে মায়েদের কী মর্যাদা ছিল, তা আমরা সবাই জানি। ইসলাম তাদের মায়ের মর্যাদা, বোনের মর্যাদা, মেয়ের মর্যাদায় এনেছে। এটা ইসলামের সৌন্দর্য। এটা আল্লাহর দান। এত সুন্দর দানকে আমরা এড়িয়ে চলব কেন?
আমি আপনাদের সবাইকে অনুরোধ করব, যদি সময় থাকে, আপনারা কুরআনটা ভালোভাবে পড়বেন। শুধু তেলাওয়াত না, অনুবাদসহ পড়বেন। এর সঙ্গে বাইবেল পড়বেন, ত্রিপিটক পড়বেন। আরও যেটা পড়তে চান, পড়েন। আসল ধর্ম যেগুলো, সেগুলো সব জিনিসে একই কল্যাণের দিকে সবাইকে ডাকে। এই কারণে আমরা সব ধর্মের প্রতি সম্মানশীল। এ জন্যই আমরা সংখ্যাগুরু, সংখ্যালঘুর ভেদাভেদ মানতে রাজি না। এই দেশের সবাই মর্যাদাবান নাগরিক। সবার অধিকার সমান। কোন ধর্ম বা পার্টি সে গ্রহণ করবে, সেটা তার নিজস্ব ব্যাপার। আপনার যেটা ভালো লাগে সেটা আপনি আরেকজনের ওপর আরোপ করতে পারেন না। ইসলাম এটা এলাউ করে না। ইসলামের সোজা ঘোষণা—তোমার জীবন পদ্ধতি নিয়ে আরেকজনের সঙ্গে বাড়াবাড়ি করার কোনো এখতিয়ার তোমার নেই। এটা আল্লাহ বলে দিয়েছেন।
তারা (নারীরা) সর্বোচ্চ সম্মানে ইনশাল্লাহ থাকবেন। রসূলের (সা.) সঙ্গে তারা সমান তালে যুদ্ধ করেছেন। রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে তারা অংশগ্রহণ করেছেন। তারা উম্মতের শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তারা আমাদের গর্ব। এটাই আমাদের উদাহরণ। আমাদের নতুন কোনো উদাহরণ খোঁজার দরকার নেই। মায়েরা আমাদের কাছে চরম সম্মানের জাতি।
ডেইলি স্টার: শেষ প্রশ্নটা ছিল, জামায়াতের নারী আমির কবে নাগাদ আশা করতে পারি?
শফিকুর রহমান: জামায়াতের নারী আমির আশা করার আগে কুরআন শরীফটা পড়ে নেবেন।
ডেইলি স্টার: তাহলে এই প্রশ্নের উত্তর এখন দিচ্ছেন না?
শফিকুর রহমান: এটার উত্তর এখন দিচ্ছি না। আপনারা কুরআন পড়ার পর আবার কথা হবে ইনশাল্লাহ।
ডেইলি স্টার: আমাদের সংস্কৃতির একটা বড় অংশজুড়েই আছে গান, কবিতা, নাচ। প্রায় সময় দেখে থাকি, ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা নাচ ও গানের বিরোধিতা করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে আপনার কাছে প্রশ্ন, বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যে যে নাচ-গানের ঐতিহ্য, সেটি রক্ষা করতে জামায়াতে ইসলামী কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে?
শফিকুর রহমান: ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। পূর্ণাঙ্গের মধ্যে এর (নাচ-গানের) কোনো সমাধান থাকবে না? নিশ্চয়ই আছে। রসূলে করিম (সা.) যখন মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন, তখন কিন্তু মদিনার ছোট ছোট মেয়েরা নেচে-গেয়ে তাকে বরণ করেছে। আল্লাহ রসূল (সা.) বাঁধা দেননি। তার সময়ে বিয়ের অনুষ্ঠানে মেয়েরা গান গেয়েছেন। ছোট ছোট মেয়েরা গেয়েছে, বড় মেয়েরা না। আল্লাহর রসূল (সা.) তাদের নিরুৎসাহিত করেননি। একবার আবু বকর সিদ্দিক (রা.) এরকম একটি অনুষ্ঠানে বাঁধা দিয়েছিলেন। আল্লাহর রসূল খুব বিরক্ত হয়ে বললেন, তোমাকে বাঁধা দিতে কে বলছে?
যদি সেটা (নাচ-গান) সুস্থ সংস্কৃতির, মননের, নান্দনিক বিকাশের জন্য হয়ে থাকে, মোস্ট ওয়েলকাম। কিন্তু এই সংস্কৃতি যদি ঐশী বানায়, এই সংস্কৃতি যদি মায়ের সঙ্গে মেয়ের দ্বন্দ্ব বাঁধিয়ে দেয়, এই সংস্কৃতি যদি সিনিয়রকে অমর্যাদার জায়গা তৈরি করে দেয় এবং এমন ডেস্পারেট বানায় যে, সে তার নিজেকেও ভুলে যায়—সেই সংস্কৃতি কোনো সমাজের জন্য কাম্য না। অতএব সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশে ইসলাম সব ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে, নেবে। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। যে সংস্কৃতি সমাজের জন্য কল্যাণকর, ঘরে ঘরে শান্তি ও সৌন্দর্য এনে দেবে, এই সংস্কৃতির পক্ষে আমরা সবসময়।
ডেইলি স্টার: পহেলা বৈশাখ, মঙ্গল শোভাযাত্রা, একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরী—এগুলো নিয়ে অনেকের বিরোধিতা থাকে, আপত্তি থাকে। আপনি তাদের উদ্দেশে কী বলবেন? দলগতভাবে জামায়াত কখনো এসব উদযাপনে যোগ দেবে?
শফিকুর রহমান: খুবই জেনুইন কথা বলেছেন। দেখুন, ইসলামে স্বীকৃত দুটি অনুষ্ঠান আছে—দুটি ঈদ। সেখানে মানুষের আনন্দ, উচ্ছ্বাস, তাদের পারস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময়, ভালোবাসা বিনিময়ের দুয়ার খুলে দেওয়া হয়েছে। বাকিগুলোর ব্যাপারে এখন ব্যাপক গবেষণা চলছে—এই দুটোর আলোকে বাকিগুলোকে কীভাবে দেখা যায়। আশা করছি, এ ব্যাপারে ভালো কিছু বের হয়ে আসবে। ভালো যা কিছু বের হয়, আসবে। সেটা আমরা ও বাকিরা গ্রহণ করব।
একটা জায়গা শুধু চিন্তা করার মতো। মানুষ হচ্ছে আশরাফুল মখলুকাত, সৃষ্টির সেরা। একটা নিয়ামতের কারণে। সেটা হচ্ছে জ্ঞান বা বিবেক, যেটা অন্য কোনো প্রাণীকে আল্লাহ দেননি। যে মানুষের সত্তাকে আল্লাহ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ বানালেন, তার একটা বাঘের বা সিংহের মুখোশ পরার দরকার নেই। কারণ সে শ্রেষ্ঠ। তারচেয়ে নিচেরটায় নামবে কেন? এগুলো নিয়ে আলেম-ওলামার কনসার্ন আছে। এগুলো কনসিডারেশনে নেওয়ার বিষয় বলে আমরা মনে করি।
(মঙ্গল শোভা) যাত্রা করার সময় অনেকগুলো ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর ওর্স্ট উইটনেস আমরা, তাই না? মেয়েদের বিশেষ করে, ইজ্জতের ব্যাপারটা অনেক ক্ষেত্রে লঙ্ঘিত হয়েছে। দিবস পালন হোক। দুনিয়াতে আরও অনেক দিবস পালন হয়। এটা আমাদের ডোমেস্টিক ডে। কিন্তু আন্তর্জাতিক অনেক দিবস আছে না? সেগুলো যেই ডিসিপ্লিনে পালন হয়, এখানেও যেন সেই ডিসিপ্লিনটা মেইনটেইন হয়—আমি জানি না, আদৌ কেউ মেইনটেইন করতে পারবে কি না।
তবে, একটা শোভাযাত্রার মাধ্যমে মঙ্গল হাসিল করা যাবে, এটা আমরা বিশ্বাস করি না। মঙ্গল হাসিল করতে হবে নিজের চরিত্র ও কর্মের মধ্য দিয়ে। চরিত্র ও কর্ম ভালো হলেই মঙ্গল আসবে। চরিত্র ও কর্ম খারাপ, কোনো শোভাযাত্রা দিয়ে মঙ্গল আসবে না।
ওই ধরনের নামের ব্যাপারে অনেকের অনেক কথা থাকতে পারে, কিন্তু থিমটা হচ্ছে, আপনি বিশেষ কোনো দিবসকে যদি উদযাপন করতে চান, পহেলা বৈশাখ হচ্ছে বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন। অনেক জাতিই তাদের নববর্ষ উদযাপন করে। উদযাপন করেন, শৃঙ্খলার সঙ্গে করেন। কিন্তু সেই শৃঙ্খলা তো (এখানে) থাকে না। সমস্যা ওই জায়গায়। আবার কিছু জিনিস মানবতার মর্যাদার সঙ্গে মেলে না। সেটাও এসে যায়। এখন কেউ কেউ বলবে, এটা প্রতিক্রিয়াশীল কথা। কিন্তু বাস্তবতায় যদি আমরা যাই, তাহলে এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ আছে আদৌ?
ডেইলি স্টার: মানবতার মর্যাদা বলতে কী বুঝাচ্ছেন?
শফিকুর রহমান: ওই যে বললাম, শ্রেষ্ঠ জাতি মানুষ। এরপর আল্লাহ আর কোনো সৃষ্টিকে স্থান দেননি। ফেরেশতারাও আমাদের মর্যাদার না, তারাও আমাদের নিচে।
ডেইলি স্টার: তাহলে মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে যে ধরনের আপত্তি আছে, আপনার মতে সেগুলো অমূলক নয়? এটা কনসিডারেশনে নেওয়া উচিত?
শফিকুর রহমান: অবশ্যই (অমূলক) নয়। যে জায়গাগুলো সুন্দর নয়, সেই জায়গাগুলো অবশ্যই কারেকশন হওয়া উচিত।
ডেইলি স্টার: পহেলা বৈশাখ শুধু যে বছরের প্রথম দিন তা নয়। এটা আগের একটি স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীকও বটে। গান গেয়ে এবং আমাদের সংস্কৃতিকে ধরে রেখে প্রতিবাদ করার একটি রেওয়াজ চালু ছিল।
শফিকুর রহমান: এটা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে (প্রতিবাদের অংশ) ছিল। এটা আমি স্বীকার করি। কিন্তু এটা যদি স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক হয়, তাহলে যখন স্বৈরাচার নেই, তখন এটা চালু থাকার কথা না।
ডেইলি স্টার: একেক সময় একেক কারণে একটা একটা ট্র্যাডিশন দাঁড়িয়ে যায়। তারপর প্রতি বছর সেটা পালিত হয়। একইভাবে প্রভাতফেরীর ব্যাপারটা—বাংলা ভাষা নিয়ে এখন আর সংগ্রাম করার দরকার নেই, কিন্তু তাদেরকে (শহীদদের) স্মরণ করার জন্য করা হয়।
শফিকুর রহমান: না। কেন আমাদের গোলাম আজম ফাইটার ছিলেন না? তিনিই প্রথম মানপত্র পাঠ করেছেন বাংলা ভাষার দাবিতে।
ডেইলি স্টার: এই প্রশ্নের উত্তর আপনি কিছুটা দিয়ে ফেলেছেন। জামায়াত একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সেরকম একটি ইসলামী রাষ্ট্রের মধ্যে, বিশেষ করে বিচারব্যবস্থা কেমন হবে তা যদি পরিষ্কার করেন। ইসলামী বিচার ব্যবস্থায় কি একজন মুসলমানের বিরুদ্ধে একজন বৌদ্ধ বা হিন্দুর সাক্ষ্য, অভিযোগ গ্রহণ করা হবে?
শফিকুর রহমান: অবশ্যই গ্রহণ হবে। সে যদি মিথ্যাবাদী না হয়, অবশ্যই গ্রহণ হবে। আর মুসলমান মানুষটা যদি মিথ্যাবাদী হয়, তারটাও গ্রহণ হবে না।
ডেইলি স্টার: একজন পুরুষ ও নারীর সাক্ষ্য কি সমানভাবে গ্রহণ হবে?
শফিকুর রহমান: না। সমান না এই কারণে, আল্লাহ তার সৃষ্টি কাঠামোগত দিক থেকেই নারী ও পুরুষের জন্য নিয়ম তৈরি করেছেন। নারী দুজন কেন রাখা হয়েছে? মনে করেন সাক্ষ্যের দিন, একজন মা সন্তানসম্ভবা, তিনি আসতে পারবেন না। তার জায়গায় আরেকজন বোন এখানে প্রক্সি দেবেন। আল্লাহ এটা ব্যাখ্যাও করেছেন। একজন যদি শর্টেজ হয়ে যায়, ভুলে যায়, আরেকজন তাকে সাহায্য করবেন। এই ভুলে যাওয়ার মানে হচ্ছে অপারগ হয়ে যাওয়া। পুরুষের এই সমস্যা নেই, নারীদের আছে।
ডেইলি স্টার: একজন নারীর সাক্ষ্য বা কথা যদি পুরুষের সমান না হয়, কয়জন নারীর সাক্ষ্য একজন পুরুষের সমান হবে?
শফিকুর রহমান: দুজনের কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, দুজন পুরুষ সাক্ষী। যদি দুজন পুরুষের জায়গায় একজন পাওয়া যায়, তাহলে একজন হবে পুরুষ সাক্ষী, দুজন নারী সাক্ষী। আল্লাহ নিজেই ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, কারণ তারা একজনকে আরেকজন সহযোগিতা করবেন।
ডেইলি স্টার: অন্য ধর্মের ক্ষেত্রে কী হবে?
শফিকুর রহমান: ওই একই ফর্মুলা। সাক্ষ্যের ক্ষেত্রে কোনো ধর্মের বাধ্যবাধকতা নেই, জেন্ডারটা কনসিডারেশনে নেওয়া হবে। এই কথাটার লজিকাল পয়েন্ট দেখেন। মনে করেন, একটা বৌদ্ধ পরিবারে কেউ হার্ম করেছে, সেখানে কোনো মুসলমান নেই। সেই লোকটা বিচার চাইবে কীভাবে? তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করা না হলে সে বিচার চাইবে কীভাবে? ধর্ম কারও ওপর অবিচার করতে পারে না। সবাই আল্লাহর সৃষ্টি। আল্লাহ তার সৃষ্টির ওপর অবিচার করবেন না। আল্লাহর চেয়ে বড় সুবিচারক আর নেই।
ডেইলি স্টার: অন্যদিকে, (ইসলামী আইন অনুযায়ী) সম্পত্তির উত্তরাধিকারেও নারী-পুরুষ সমান হয় না। আপনিও সেটা সমর্থন করেন?
শফিকুর রহমান: অবশ্যই। ইসলাম এটা বলেছে কেন? কারণ পরিবারের পূর্ণ দায়-দায়িত্ব স্বামীর। স্ত্রীর না। স্বামীরও ব্যবসা আছে, স্ত্রীরও আছে। স্ত্রীর কাছ থেকে এক টাকা নিয়েও পুরুষ লোকটি দাবি করে খরচ করতে পারবে না সংসারের জন্য। পূর্ণ দায়-দায়িত্ব পুরুষ লোকটির, স্বামীর। অতএব, শতভাগ (দায়িত্ব) এসে যাচ্ছে তার কাঁধে। রিস্ক হোক, গেইন হোক, সবকিছু পুরুষের। দুই নম্বর হচ্ছে, একজন পুরুষ তার শ্বশুর বাড়িতে সম্পত্তিতে কোনো হকদার না। সে যা পাবে তার বাবার সম্পত্তি থেকে। কিন্তু একজন নারীর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর কিন্তু বাবার বাড়িতেও তিনি পান। আবার স্বামীর সম্পত্তিতেও বৈধ অধিকার আছে। এসব মিলিয়ে ওলামায়ে কেরাম এটা প্রমাণ করেছেন, গড়ে একজন নারী কোনো অংশেই পুরুষের চেয়ে কম পায় না। বরং কিছু অংশে বেশি পায়। এটাও প্রপার জাস্টিস। এখানে কোনো ডিসক্রিমিনেশন নেই।
আরেকটা জিনিস লক্ষ্য করেছেন, কোনো কোনো ধর্মে কিন্তু নারীদের কোনো অধিকারই নেই সম্পত্তিতে। এটা খুবই দুঃখজনক। একই মায়ের সন্তান, তার কোনো অধিকার থাকবে না, এটা কেমন কথা? তার একটা জাস্টিস পাওয়ার অধিকার আছে না? সে (নারী) ইনহেরিট করে তার মা-বাবাকে। সে কেন ডিপ্রাইভড হবে? সেটাও ভাবার বিষয়। ইসলাম এত ব্যালেন্সড, কোনো জায়গায় কোনো লুপহোল নেই।
ডেইলি স্টার: এর আগে যে একটা উইমেন্স ডেভেলপমেন্ট পলিসি ফ্লোট করা হয়েছিল, যেটা অনেক প্রতিবাদের মুখে সরিয়ে নেওয়া হয়, ২০১১ সালের দিকে সম্ভবত। আপনারা কী সেটার বিরোধিতা করেন? সেখানে সমান অধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল।
শফিকুর রহমান: আমরা কারও বিরোধিতা করছি না। আমরা ইন ফেভার অব ইসলাম অ্যাডভোকেসি বলছি। আমি আমার আদর্শের অ্যাডভোকেসি করব এবং আমি কনভিন্সড যে, এই আদর্শই সর্বশ্রেষ্ঠ। আমি কনভিন্সড এখানে সবার রাইটস খুব সুন্দরভাবে প্রিজারভড হচ্ছে।
ডেইলি স্টার: আপনাদের দাবি-দাওয়ার (সংস্কারের) বেশ লম্বা একটি প্রস্তাবনা দিয়েছেন। সেখানে শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একটি প্রস্তাবনা ছিল, দেশীয় প্রকৃতি নির্ভর ভাস্কর্য তৈরি করা দরকার, প্রাণী নির্ভর না। এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কি আপনারা অপরাজেয় বাংলা বা রাজু ভাস্কর্যের মতো প্রতিকৃতিগুলোর বিরোধিতা করবেন? এগুলো কি ভেঙে ফেলতে হবে? এগুলো কি আর বানাতে দেবেন না?
শফিকুর রহমান: আসলে আমাদের পজিশনটা ইনডিফারেন্ট। এখানে একটি প্রসিদ্ধ হাদিস অনেকের মুখ থেকে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহ ছাড়া কেউ জীবন দেওয়ার শক্তি রাখে না। একটি পিপড়ারও না। যারা দুনিয়ার এ রকম প্রাণীর প্রকৃতি দিয়ে কিছু বানাবেন, হাশরের দিন আল্লাহ ওই প্রকৃতিটাকেও আনবেন আর ওই লোকটাকেও হাজির করবেন। বলবেন, একটু জান দাও পারলে তার মাঝে। সে তো বলবে, এটা আমার সামর্থ্যের বাইরে। (আল্লাহ বলবেন) 'তাহলে এটা কেন করেছিলে? এটা তো তোমার করা ঠিক হয়নি'।
এবার যে পরিবর্তনটা আসলো, দেখবেন অনেক জায়গায় আমাদের ছেলে-মেয়েরা গ্রাফিতি এঁকেছে। এগুলোর মধ্যে প্রকৃতির যে সৌন্দর্য, সেটা তারা ফুটিয়ে তুলেছে। এটা সবাইকে চমৎকৃত করেছে। এমনকি তাদের কিছু স্লোগানকেও আপনি সংস্কৃতি ধরে নিতে পারেন। মিরপুর-১০ থেকে আসার পথে একটা পিলারে লেখা দেখলাম, 'রক্ত গরম, মাথা ঠাণ্ডা'। চিন্তা করেন, বিশাল ফিলসফি দিয়ে দিয়েছে এই একটা লাইনের মাধ্যমে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমার রক্ত নেচে উঠবে, কিন্তু আমি টেম্পার লুজ করে অন্যকে পয়েন্ট দেবো না। চমৎকার কথা। এগুলো শেখাল কে, এত সুন্দর সুন্দর কথা, আমি অবাক হয়ে যাই।
আপনি একজন মানুষের দিকে তাকালে প্লিজডও হতে পারেন, ডিসপ্লিজডও হতে পারেন। কিন্তু একটি ফুলবাগানের দিকে তাকালে কখনো ডিসপ্লিজড হবেন না। আপনার মনে একটা প্রশান্তি আসবে। উদ্ভিদ জগতের যে সৌন্দর্য তা কখনো মানুষকে কষ্ট দেয় না, সবসময় আরাম দেয়। কিন্তু এমন বীভৎস প্রাণী আছে যা আপনি দেখামাত্র ভয় পেয়ে যাবেন। আল্লাহ কোন হেকমতের জায়গা থেকে এটা করেছেন, তা আল্লাহ ভালো জানেন।
তবে ভেঙে ফেলা, টানাহেঁচড়া করা, অসম্মান করা, সেই বিষয়গুলো আরেক চ্যাপ্টার। আমরা নীতিগতভাবে কোনো কিছুকে অসম্মান করার পক্ষে নেই। আপনি যাই রিজলভ করেন, কনসেনশাসের ভিত্তিতে করেন, ডায়ালগের ভিত্তিতে করেন। একটা জায়গায় এসে করেন, নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে করেন। যেগুলো (ভাঙচুর, টানা-হেঁচড়া) হয়, এগুলো মানুষের সেন্টিমেন্টাল বা ইমোশনাল আউটবার্স্ট। ইমোশন ম্যাক্সিমাম সময়ই মানুষকে সঠিক পথে চালায় না। অনেক সময় মানুষ মিসগাইডেড হয়ে যায় ইমোশনের কারণে। যারা এসব করেছে, তারা তো আপনাকে-আমাকে জিজ্ঞেস করে করেনি। ইনটলারেন্ট সোসাইটি আমাদের। আমাদের টলারেন্স আরও বাড়াতে হবে।
ডেইলি স্টার: জামায়াত একটি কল্যাণ রাষ্ট্র করতে চায়। আল্লাহর আইন, ইসলামের আইন প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সেক্ষেত্রে আমাদের সংবিধান আপনারা কীভাবে পরিবর্তন করবেন?
শফিকুর রহমান: সংবিধান আল্লাহর আইন ছাড়াও পরিবর্তিত হচ্ছে। সংবিধানের অনেকগুলো সংশোধনী হয়ে গেছে। ১৬টি সংশোধনী হয়ে গেছে। সেটা কেন? মানুষের প্রয়োজনে, যুগের চাহিদা সামনে রেখে। সেই আলোকে একটি আদর্শিক সংগঠন যদি দেশের দায়িত্বে আসে, কীভাবে আসবে? জোর করে আসবে, নাকি জনগণই তাদের সমর্থন দিয়ে নিয়ে আসবে? জনগণ যখন এই আদর্শ চাইবে, তখন এই আদর্শের আলোকে কিছু রিফরমেশন করতে হবে।
ডেইলি স্টার: বিএনপির সঙ্গে কি আপনাদের এক ধরনের টানাপড়েন চলছে। বিএনপি বলছে, জামায়াতের সঙ্গে আমাদের আর জোট নেই, সম্পর্ক নেই।
শফিকুর রহমান: এটা সত্য। আমরাও বলছি, আমাদের এ রকম জোট নেই। টানাপড়েনও নেই। টানাপড়েন আমরা দেখতে পাই মিডিয়াতে। আমাদের প্রতি আন্তরিকতার কারণে মিডিয়া অনেক সুন্দর সুন্দর জিনিস বের করে আনে, যাতে আমরা (বিএনপি ও জামায়াত) সবসময় যুদ্ধের মধ্যে থাকি। আমরা কিন্তু কোনো যুদ্ধে নেই। মিডিয়া যুদ্ধে আছে।
ডেইলি স্টার: নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার কথা অনেকে বলছেন। আপনারা কী মনে করেন?
শফিকুর রহমান: আমি বলেছি না? আওয়ামী লীগ নিজেই নির্বাচনে বিশ্বাস করে না। ২০১৪ সালে দেখেন, ১৫৪ আসনে নির্বাচনই হয়নি। কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়া পাস। বাংলাদেশে এমন খরা দেখা দিয়েছে! ২০১৮ সালে দিন পর্যন্ত ধৈর্য ধরা গেল না, আগের রাতেই খালাস। আর ২০২৪ সালে যাতে কোনোভাবেই (নির্বাচন) না হয়, তার সব প্লট তৈরি করা হলো। আওয়ামী লীগ নির্বাচন চেয়েছে কোথায়? চায়নি তো। বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ আগে প্রমাণ করুক যে তারাও নির্বাচন চায় এবং জনগণের রায়ে বিশ্বাস করে।
ডেইলি স্টার: সাধারণত যারা ইসলামভিত্তিক রাজনীতি করে থাকেন, তারা প্রচুর উর্দু, ফার্সি অথবা আরবি শব্দ ব্যবহার করেন। যেমন: আপনি বলছেন, মজলুম, খালাস বা মজলিসে সূরা। এগুলোর বাংলা প্রতিশব্দও আছে। সেগুলো কেন ব্যবহার করেন না?
শফিকুর রহমান: হ্যাঁ, প্রতিশব্দ আছে। বাংলা এনরিচ হয়েছে সব ভাষার দ্বারা। বাংলা একটি উদার ভাষা। এখানে সংস্কৃতি এসেছে, আরবি এসেছে, ফারসি এসেছে, ইংরেজি এসেছে। আওয়ামী লীগের নামটাই দেখেন। 'আওয়ামী' উর্দু শব্দ, 'লীগ' ইংরেজি। এখানে বাংলা নেই একেবারে। আমাদের নামটা পুরোটা আরবি। বিএনপি কিন্তু পুরোটাই ইংরেজি। তাই না? আমরা এভাবে দেখি না। জাতি এভাবে দেখে না। জাতি যেটা সহজে বোঝে, সেটাকেই তার ভাষা হিসেবে কবুল করে নিয়েছে। এটা বাংলা ভাষার উদারতার সৌন্দর্য বলতে পারেন।
অনুলিখন: কিরো আদনান আহমেদ
Comments