৬ মাসে দলীয় কোন্দলে নিহত ৩৫, আওয়ামী লীগ যা ভাবছে

আওয়ামী লীগ

চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে আওয়ামী লীগে প্রতিদিন গড়ে অন্তত দুটি করে অন্তর্দ্বন্দ্বের ঘটনা ঘটেছে। যা একই সময়ে রাজনৈতিক সহিংসতার মোট ৪৪০টি ঘটনার ৯৪ শতাংশ।

এর মধ্যে মাত্র দুটি ঘটনায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি এবং প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েছে বলে উঠে এসেছে আইন ও মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যানে।

গত ছয় মাসে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ৩৫ জন নিহত হয়েছেন, যা রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত ৪১ জনের ৮৫ শতাংশ।

আসকের তথ্যে জাতীয়, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতার ঘটনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

আসকের নির্বাহী পরিচালক ফারুক ফয়সাল বলেন, প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচন বর্জনের মধ্যে নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক দেখানোর জন্য আওয়ামী লীগ নিজ দলের নেতাকর্মীদের প্রার্থী হওয়ার অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বেশিরভাগ নির্বাচনী সহিংসতার ঘটনাই ঘটেছে ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন অংশের মধ্যে।

আসকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত গত ছয় বছরে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে সংঘর্ষে আওয়ামী লীগের ২০২ জন নেতাকর্মী ও সমর্থক নিহত হয়েছেন।

এই তথ্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের অনুপস্থিতিতে ক্ষমতাসীন দল কীভাবে ভেতর থেকে বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছে।

ফারুক ফয়সাল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রধান বিরোধীদলগুলো নির্বাচন ও রাজপথ থেকে দূরে থাকার কারণে আওয়ামী লীগ তার নিজের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে। আধিপত্য প্রতিষ্ঠা এবং আর্থিক সুবিধা লাভের জন্যই মূলত দলে অন্তর্দ্বন্দ্ব হচ্ছে।'

তিনি বলেন, ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়ার সিদ্ধান্তের পর আওয়ামী লীগের তৃণমূলে কোন্দল তীব্র আকার ধারণ করে। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের পর পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়।

ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, প্রায় সব উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে দলের বেশ কয়েকজন নেতা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতারা আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। এতে বলা হয়, পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।

দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা নির্বাচনে জয়লাভ, আধিপত্য প্রতিষ্ঠা, দলীয় পদ রক্ষা এবং দলীয় সংসদ সদস্য, স্থানীয় নেতা, স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য এবং নবনির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যানদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য দলীয় নেতাদের হতাশাকে দায়ী করেন।

তারা বলেন, অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে সংগঠনটি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে কিছু নেতা তাদের দলীয় সহকর্মীদেরও সহ্য করতে পারছেন না।

সিনিয়র নেতারা বলেছেন, আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয়রা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন, তবে এটি কঠিন হতে পারে।

ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এতটাই প্রকট হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে সংঘাত ও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার নিশ্চিত করতে বলেছেন।

গত ৮ জুলাই এক বৈঠকে আওয়ামী লীগ নেতা ও একাধিক মন্ত্রী বলেছেন, দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল দলের প্রধান উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সূত্র জানায়, ক্ষমতাসীন দল কঠোর ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকদের দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডকে রিপোর্ট করতে বলা হয়েছে।

সূত্র আরও জানায়, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা বিভিন্ন জেলা সফর করবেন, যেখানে কোন্দল রয়েছে সেসব ইউনিটের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন এবং প্রয়োজনে বিরোধ মেটানোর জন্য নেতাদের ঢাকায় ডেকে পাঠাবেন। প্রয়োজনে তৃণমূলের বিপথগামী নেতাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে দলটি।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, আওয়ামী লীগের মতো বড় দলে অভ্যন্তরীণ কোন্দল 'খুবই স্বাভাবিক'।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তবে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ হলে আমরা কাউকে রেহাই দেব না। দলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে যা যা করা দরকার আমরা তা করব।'

রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, অবৈধ বালুর ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, বাস ও অটোরিকশা স্ট্যান্ড, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, জমি ও পার্টি অফিস নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে কোন্দল একটি সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার সরাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রবিউল ইসলামকে (৪২) গত ৬ জুলাই গুলি করে হত্যা করা হয়।

রবিউলের স্ত্রী শায়লা এরিন বাদী হয়ে ডুমুরিয়া থানায় একটি মামলা করেন। যেখানে উল্লেখ করা হয়, রাজনৈতিক শত্রুতার জের ধরে তার স্বামীকে হত্যা করা হতে পারে।

এ ঘটনায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আসগর বিশ্বাসকে আটক করেছে পুলিশ। আসগর ডুমুরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন এবং রবিউল আসগরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন বলে জানা গেছে।

গত ৭ জুলাই মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ী উপজেলার পাঁচগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এইচ এম সুমন হালদারকে একটি স্কুল ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধের জেরে গুলি করে হত্যা করা হয়।

এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে তিনজনকে আটক করেছে পুলিশ। তারা তিনজনই আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত।

গত ২২ জুন রাজশাহীর বাঘা উপজেলায় আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে অন্তত ৩০ জন আহত হয়। আহতদের মধ্যে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম বাবুল গত ২৬ জুন মারা যান।

হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বাঘা পৌরসভার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগ নেতা আক্কাস আলীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

দৈনিক প্রথম আলোর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১৫ বছরে বগুড়ায় আওয়ামী লীগ বা আওয়ামী লীগ সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে ৫১ জন নিহত হয়েছেন।

বগুড়া আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ নেতা বলেন, 'দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল অবসানে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।'

তিনি বলেন, তৃণমূল নেতাকর্মীরা তাদের নিজ নিজ ইউনিট নেতাদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখতেন এবং তাদের নির্দেশনাও অনুসরণ করতেন কারণ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় টিকিটের জন্য তাদের সুপারিশ তাদের দরকার ছিল।

কিন্তু আওয়ামী লীগ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা দলীয় নেতারা নিজস্ব সমর্থক দল তৈরি করেন। এর ফলে শেষ পর্যন্ত চেইন অব কমান্ড দুর্বল হয়ে পড়ে বলে মনে করেন তিনি।

Comments