বিএনপির তারুণ্যের সমাবেশে ‘গুম’ হওয়ার অভিজ্ঞতা বললেন সাংবাদিক কাজল

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তারুণ্যের সমাবেশে বক্তব্য দেন সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল। ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া

ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির ৩ সংগঠনের আয়োজিত তারুণ্যের সমাবেশে নিজের 'গুম' থাকার অভিজ্ঞতার কথা বললেন সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল।

২০২০ সালের ১০ মার্চ নিখোঁজ হন কাজল। ৩ মে বেনাপোলে তার খোঁজ মেলে। পরে তাকে সেখানেই গ্রেপ্তার দেখানো হয়। প্রায় ৮ মাস পর জামিনে মুক্তি পান তিনি।

আজ শনিবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তারুণ্যের সমাবেশের আয়োজন করেছে বিএনপির ৩ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল। এই সমাবেশে দেওয়া বক্তব্যে কাজল বলেন, ফ্যাসিবাদ এক ভয়ঙ্কর দানব। এই দানবকে পরাস্ত করতে হলে আমাদের যে কাজটি সবার জন্য করা দরকার, নিয়ত আমাদের পরিষ্কার করতে হবে।

তিনি বলেন, 'এই ফ্যাসিবাদ আমার মতো বহু মানুষকে গুম করে ফেলেছে। আমার ভাগ্য অনেক ভালো যে আমি গুম অবস্থা থেকে ফিরে আসার পর আপনাদের সামনে কথা বলতে পারছি।'

কাজল বলেন, 'আমি সাংবাদিকতা করতাম। ২০২০ সালে আমি যখন গুম হয়ে যাই, এরপর থেকে আজ অবধি আমি কাজে ফিরতে পারিনি। আমি এখানে মনোযোগ দিয়ে অনেকের অভিজ্ঞতার কথা শুনেছি। পিতা কাঁদছে, বোনের আহাজারি, ভাইয়ের চিৎকার, সন্তানের কষ্ট।'

গুম থাকার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কাজল বলেন, 'আমার চোখ বাঁধা, পেছনে হ্যান্ডকাফ। আমাকে বের করে নিয়ে আসা হলো "গুম সেন্টার" থেকে। সেখানে অনেক মানুষ ছিল। আমি জানি না তারা আছেন কি না। এই গুম সেন্টারকে কেউ বলছেন আয়নাঘর। কেউ আরও অনেক নাম বলছেন। গুম সেন্টার কি একটা আছে, না আরও অনেক আছে। সেটা দেখার ভাগ্য হয়নি। তবে আমার দুটি জায়গা দেখা হয়েছে।'

'আমাকে যখন গুম সেন্টার থেকে বের করে বেলা ১২টার দিকে, রোজার দিন, তার ২ দিন আগে, আমি হ্যান্ডকাফ পরে নামাজ পড়ছি। পেছনে আমার হাত মোড়া। চোখ বাঁধা। এমন এক অবস্থায় আমি নামাজ আদায় করতে সিজদায় গিয়েছি; আমার অনেক কষ্ট হয়; আমি শুধু বলি আল্লাহ আমাকে এ জায়গা থেকে বের কর, অথবা আমার মৃত্যুর ব্যবস্থা করে দাও। এমন সময় আমি সাংঘাতিকভাবে শ্বাস নিচ্ছি। অনেক চাপা শ্বাস। সেসময় আমার গলায় পাড়া দিয়ে ধরে, আমি তাদেরকে বলি ভাই আমি যদি কোনো অন্যায় করি আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করছি, হয় আমাকে হত্যা করুন, অথবা আমাকে মুক্তি দিন।'

'এর ২ দিন পরই আমাকে বের করে নেয়। আমি তখন ভাবি হয়তো আমি চিরদিনের জন্য দুনিয়া ছেড়ে চলে যাচ্ছি, অথবা আমার মুক্তি হবে। আমি তো কনফার্ম না।'

'আমাকে মাঝরাত একটি প্রাডো গাড়িতে করে নিয়ে যায় বেনাপোলে। হাতে হাতকড়া, চোখ বাঁধা অবস্থায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি। এরপর আমাকে একটি খাদের মধ্যে নামিয়ে দিল, তখন ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে। অনেক পোকা ডাকছে। আমি তখন ভেবে নিয়েছি আমাকে ক্রসফায়ার করবে, এমনিভাবে আমি আতঙ্কের মধ্য দিয়ে সময় পার করেছি। অবেশেষে আল্লাহ আমার ডাক শুনেছেন। আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছেন।'

সরকারের উদ্দেশে সাংবাদিক কাজল বলেন, 'যারা গুম হয়ে আছে তাদের মানুষের মাঝে ফেরত দিন, তাদের পরিবারের কাছে ফেরত দিন। নাহলে যে পতন সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই পতনে আপনারা ধ্বংস হয়ে যাবেন। আপনারা ধ্বংসের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন।'

সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন, 'ভাবার কোনো সুযোগ নাই যে, অন্যায় করে পৃথিবীতে মানুষ টিকে থাকে। আওয়ামী লীগ সরকার আজ যে কাজটি করেছে আগামী দিনের সরকার যদি সেই কাজটি করে তাতে যে আমাদের সমর্থন থাকবে তা তো নয়।'

সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, এই সরকার মানুষের জবান কেড়ে নিয়েছে। আল্লাহর দেওয়া জবান, সেটা তারা কেড়ে নিয়েছে। সেই জবান আমাদের ছিনিয়ে আনতে হবে। আমরা যারা মনে করি আপস করে সাংবাদিকতা করব, যারা মনে করছি—ফ্ল্যাট, গাড়ি-বাড়ির বিনিময়ে আজকে আমরা সুখে আছি, যারা ১৪ বছর সুখে আছেন, দিন গুনুন, আগামী দিন আপনাদের সুখের দিন নয়, আগামী দিন আপনাদের চরম দুঃসময়ের দিন। সমস্ত শক্তি ভেঙে পড়েছে। তাকিয়ে দেখুন, পেছনে তাকান।'

'আমি মনে করি সত্য প্রকাশ করা, ন্যায্য কথা বলা, সত্য লেখা এবং ন্যায়ের পক্ষে জীবন দান করাই হলো সাংবাদিকতা। আমি এর বাইরে হিসাব বুঝি না। এই অভিজ্ঞতা বলতে গেলে আমার অনেক কষ্ট হয়। আমি ঘুমাতে পারি না। আমি অনেক সংকটের মধ্যে সময় পার করছি। আপনারা পাশে থাকলে আমরা মুক্ত হব। আমরা গণতন্ত্র পাব, জিতব এবং আমাদের জিততেই হবে।'

Comments

The Daily Star  | English
Anti-Discrimination Students Movement

Students to launch a party by next Feb

Student leaders who spearheaded the July-August mass uprising are planning to launch a political party by early February 2025 and contest the next general election.

7h ago