ফিরে দেখা জুলাই গণঅভ্যুত্থান

২০ জুলাই: কারফিউ ভেঙে বিক্ষোভ, শাটডাউন প্রত্যাহারের ‘গুজব’, সমন্বয়কদের প্রত্যাখ্যান

ঢাকার মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের যাত্রাবাড়ী টোল প্লাজার কাছে সশস্ত্র নিরাপত্তা কর্মীরা টহল দিচ্ছেন। ২০ জুলাই, ২০২৪। স্টার ফাইল ছবি

চব্বিশের জুলাইয়ের ১৯ তারিখ দেশজুড়ে বিক্ষোভকারীদের ওপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সরকার সমর্থকদের নির্মম নিপীড়নের পর, ২০ জুলাই কারফিউয়ের মধ্যে সেনাবাহিনীর টহল জোরদার করা হয়।

মধ্যরাত ১২টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত কারফিউ থাকে। মাঝে দুই ঘণ্টার বিরতি দিয়ে দুপুর ২টা থেকে আবার পরদিন ২১ জুলাই দুপুর ৩টা পর্যন্ত কারফিউ ঘোষণা করা হয়। সেইসঙ্গে ২১ ও ২২ জুলাই সাধারণ ছুটির ঘোষণা আসে। পাশাপাশি তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠনগুলো ২১ জুলাই থেকে সারাদেশে সব কারখানা বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়।

১৮ জুলাই থেকেই সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়েছিল। এর ধারাবাহিকতা চলে ২০ জুলাইয়েও। ধারাবাহিকতা বজায় থাকে সাধারণ মানুষ হত্যার ক্ষেত্রেও।

২০ জুলাইয়েও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারি দলের সমর্থকদের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে অন্তত ২১ জন নিহত হওয়ার খবর নিশ্চিত করা যায়, যাদের মধ্যে দুজন ছিলেন পুলিশের সদস্য।

আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে বিএনপি-জামায়াত এবং তাদের সমর্থক সন্ত্রাসীরা জ্বালাও-পোড়াওসহ সহিংসতা চালাচ্ছে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, কোটা আন্দোলনে ভর করে বিএনপি-জামায়াত দেশের মানুষকে জিম্মি করার চেষ্টা করছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাধিক সমন্বয়ক এদিন বলেন, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তাদের ব্যানার ব্যবহার করে কেউ যদি রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে চায়, ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালাতে চায়, তাহলে এটা তারা সমর্থন করবে না।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকার দমন-পীড়ন চালিয়ে নিজেদের রক্ষা করতে পারবে না।

এ দিন ঢাকার যাত্রাবাড়ী, নিউমার্কেট, সায়েন্সল্যাব, বছিলা, উত্তরা, মেরুল বাড্ডা ও মিরপুরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। পুলিশের সঙ্গে তাদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।

মিরপুরে সংঘর্ষের একপর্যায়ে মেট্রোরেলের কাজীপাড়া স্টেশনে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর মেট্রোরেল, এক্সপ্রেসওয়ে ও মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার বন্ধ ঘোষণা করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

সকাল থেকে রামপুরা, বনশ্রী ও বাড্ডা এলাকায় বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। সেখানেও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সকাল থেকে ভাটারা এলাকায় ইউআইইউ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ও আইইউবিসহ বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন। একপর্যায়ে তাদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

রাজধানীতে হেলিকপ্টার টহল অব্যাহত রাখে র‍্যাব। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পয়েন্টে সেনাবাহিনী, র‌্যাব ও পুলিশ চেকপোস্ট বসায়। এ সময় সংবাদকর্মীদের ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাছ থেকে কারফিউ পাস নিয়ে সংবাদ সংগ্রহের কাজ করতে হয়।

এদিন সিদ্ধিরগঞ্জে হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি ভবনে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় আন্দোলনকারীরা। এতে ওই ভবনে থাকা হাইওয়ে পুলিশের সদস্যসহ শতাধিক মানুষ আটকা পড়েন। পরে সেনাবাহিনী, বিজিবি, র‍্যাব ও পুলিশ গিয়ে হেলিকপ্টারের সহায়তায় তাদের উদ্ধার করে।

মধ্যরাতে তুলে নেওয়া হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে—যিনি বর্তমানে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক।

নাহিদের মা সেদিন বলেছিলেন, নাহিদ রাজধানীর খিলগাঁও নন্দীপাড়ায় তার এক বন্ধুর বাসায় ছিলেন। ভোররাত আড়াইটার দিকে ৫০-৬০ জন লোক গিয়ে ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে সেই বাসা থেকে নাহিদকে তুলে নিয়ে যান।

তবে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, নাহিদ নামে কাউকে ডিবি গ্রেপ্তার করেনি।

নাহিদের খোঁজে ডিবি কার্যালয়ের সামনে যান কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সহসমন্বয়ক হাসিব আল ইসলাম। নাহিদের বাবা বদরুল ইসলাম জানান, সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে সিআইডি কার্যালয়ের সামনে থেকে ফেরার পথে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা সারজিস, হাসনাত ও হাসিবকে তুলে নিয়ে যায়।

পরে গভীর রাতে মিন্টো রোডের রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন সমন্বয়কের সঙ্গে বৈঠক করে তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, 'আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে। শিক্ষার্থীরা যেসব দাবি করেছেন, তা যৌক্তিক এবং সমাধানযোগ্য।'

তৎকালীন তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত বলেন, 'আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের তিন সমন্বয়কারী আমাদের সঙ্গে দেখা করে তাদের আট দফা দাবি জানিয়েছেন। আমরা এগুলো নিয়ে আলোচনা করব। আর শিক্ষার্থীদের পক্ষে বিভিন্ন পত্রিকায় যে নয় দফার খবর ছাপা হয়েছে, তা কোনো মহলের ছড়ানো গুজব।'

সরকারের তরফে বলা হয়, এই বৈঠকের পর সারা দেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে 'কমপ্লিট শাটডাউন' তুলে নিতে বলেছেন সমন্বয়করা।

তবে, রাতে গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে পাঠানো বার্তায় অন্যতম সমন্বয়ক আব্দুল কাদের বলেন, 'আমাদের কয়েকজন সমন্বয়ককে সরকারি বাহিনী হেফাজতে নিয়ে তাদের দিয়ে মনগড়া বক্তব্য তৈরি করে তা প্রচার করছে। আমাদের পূর্বঘোষিত নয় দফা দাবি বাস্তবায়ন হওয়ার আগ পর্যন্ত কমপ্লিট শাটডাউন অব্যাহত থাকবে।'

Comments

The Daily Star  | English
Milestone Jet crash

Milestone crash: Brother dies a day after sister

Death toll now 32; Aryan Nasraf Nafi, 9, died at 12:15am; Eldest sister, Nazia Tabassum Lizu, 13, died Monday

1h ago