‘হাজার চেষ্টা করেও গোলাপ ফুল ফোটায় না কলমিলতা’

বারান্দা কিংবা ছাদের টবে লাগাতে অতি সাবধানে ফুটন্ত ফুলসহ একটি চারা নিয়ে যাচ্ছেন এক গোলাপপ্রেমী। সম্প্রতি ঢাকার মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে ছবিটি তুলেছেন সাবিনা ইয়াসমিন।

গোলাপের পাপড়ির নরমে মন খুঁজতে গিয়ে কাঁটার আঘাতে না হলেও চড়া দামের ধাক্কায় নাকাল হওয়ার বিষয়টি প্রতিবছর ভালোবাসা দিবস কিংবা বসন্ত উৎসব আসলেই টের পাওয়া যায়। কিন্তু দামের কারণে প্রেমের এই নৈবেদ্য থেকে কোনো প্রেমিক কিংবা প্রেমিকা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন, এমনটি কমই চোখে পড়ে।

এখন প্রশ্ন হলো—বাজারে আরও অনেক ফুলের সমাহার থাকতে গোলাপের এমন আলাদা কদর কেন? বাহারি এই ফুল কীভাবেই বা প্রেমের কিংবা বেদনার ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে অবিকল্প হয়ে উঠল?

ইংরেজ কবি জন কিটসের দুটি পংক্তিতে এর জবাব মিলতে পারে—'আর গোলাপই শুধু পেয়েছে সেই/গন্ধ-সুধা যা বিশ্বে নেই।'

আবার এই 'অবিকল্প' গোলাপ নিয়েই শিল্পী কবির সুমন গেয়ে ওঠেন, 'জোর করে কি ফুলের বাহার শুকনো গাছে বানানো যায়?/জোর করে কি চাঁদের পাহাড় এই মাটিতে নামানো যায়?/…কক্ষনো না, কক্ষনো না, এসব শুধু কথার কথা/হাজার চেষ্টা করেও গোলাপ ফুল ফোটায় না কলমিলতা।'

প্রাচীন গ্রিস এবং রোমে গোলাপকে প্রেমের দেবী আফ্রোদিতে বা ভেনাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে ভাবা হত। ধারণা করা হয়, গোলাপ আর প্রেমের সম্পর্ক সেই সময় থেকেই কল্পিত হয়ে আসছে।

আবার খ্রিস্টধর্মের উদ্ভবের কালে গোলাপকে তুলনা করা হত জিশুর জননী মেরির সঙ্গে। গোলাপের ইংরেজি নাম 'রোজ' থেকেই খ্রিস্টীয় জপমালা 'রোজারিও'র উদ্ভব।

এদিকে ইংল্যান্ডের দুই অভিজাত গোষ্ঠী ইয়র্কিস্ট এবং ল্যাঙ্কাস্ট্রিয়ানদের মধ্যে বত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা একটি যুদ্ধ 'গোলাপের যুদ্ধ' হিসেবে পরিচিত। এই যুদ্ধে দুই পক্ষই তাদের পতাকায় গোলাপের চিহ্ন বহন করেছিল। ইয়র্কিস্টদের পতাকায় ছিল সাদা গোলাপ আর ল্যাঙ্কাস্ট্রিয়ানদের পতাকায় ছিল লাল গোলাপের ছবি। যুদ্ধ শেষ হয় দুই পক্ষের মধ্যে এক বিয়ের মধ্যে দিয়ে। এর মাধ্যমে নতুন রাজবংশ হিসাবে টিউডররা আত্মপ্রকাশ করে। তখন রাজকীয় প্রতীকে গোলাপই থাকে। কিন্তু লাল গোলাপের ভেতরে সাদা অংশ রাখা হয়।

গোলাপ এমনই এক ফুল, যার রক্তিম রহস্যের হাতছানি পৃথিবীর অনেক কবিই এড়িয়ে যেতে পারেননি। এই গোলাপে মুগ্ধ কবি পূর্ণেন্দু পত্রী গত শতকের আশির দশকের মধ্যভাগে বিভিন্ন ভাষার কবিতা থেকে বাছাই করা গোলাপ সম্পর্কিত সমুজ্জ্বল উক্তি ও পংক্তি নিয়ে আস্ত একটি সংকলনই প্রকাশ করেছিলেন।

'গোলাপ যে নামে ডাকো' শীর্ষক ওই সংকলনে পূর্ণেন্দু পত্রী বলছেন, ভারতবর্ষের কবিতায় মোগল যুগের আগ পর্যন্ত একচ্ছত্র সাম্রাজ্য চালিয়ে গেছে পদ্ম। যেমন জাপানের কবিতায় চেরি।

এই কবির ভাষ্য, গোলাপ পৃথিবীর কবিতায় একইসঙ্গে অসুখ এবং আরোগ্যের ফুল। পদ্মের কাছে তার শুধু এক জায়গাতেই পরাজয়। পদ্ম যেমন ধর্মে, তেমনি শিল্পে, তেমনি কবিতায়। কিন্তু গোলাপ ধর্মে বিবর্জিত। তার শরীর এত বেশি মানুষী-বাসনায় আরক্ত যে সে পূজায় অচ্ছুৎ। আর হয়তো সেই কারণেই সমাধিতে গোলাপ এমন বেদনাদায়করূপে সুন্দর।

নিসর্গসখা দ্বিজেন শর্মা মনে করতেন, ফুলহীন বিশ্বে মানুষের সৌন্দর্যচিন্তার বিকাশ অবশ্যই খণ্ডিত হত।

এক্ষেত্রে গোলাপ ছাড়া যে সেই চিন্তার বিকাশ সম্পূর্ণ হতো না, সে কথা তো বলাই যায়।

পূর্ণেন্দু পত্রীর করা গোলাপ নিয়ে ওই সংকলনে বলা হচ্ছে, ভারতবর্ষের মাটিতে যে মোগল রাজপুত্র প্রথম চারা পুঁতেছিলেন গোলাপের, তার নাম বাবর। কেন পুঁততে বাধ্য হয়েছিলেন তার ব্যাখ্যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পারস্যের চিঠির একটি অংশ উদ্ধৃত করেন তিনি—'এ পর্যন্ত সমস্ত পারস্যে দেখে আসছি এরা বাগানকে কী ভালোই না বাসে। এখানে চারিদিকে সবুজ রঙের দুর্ভিক্ষ, তাই চোখের ক্ষুধা মেটাবার এই আয়োজন। বাবর ভারতবর্ষে বাগানের অভাব দেখে, অবজ্ঞা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি এসেছিলেন মরুপ্রদেশ থেকে, বাগান তাদের পক্ষে শুধু কেবল বিলাসের জিনিস ছিল না, ছিল অত্যাবশ্যক। তাকে বহু সাধনায় পেতে হয়েছে বলে এত ভালোবাসা।'

পূর্ণেন্দু পত্রীর ভাষায়, বাবরের এই বাগান আগ্রা থেকে ক্রমশ তার শিকড় ছড়াল ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে। ভিনদেশের গোলাপ ভারতবর্ষের জলহাওয়াকে আপন করে নিল অচিরাৎ ফুটন্ত ডালপালায়। মোগল-মিনিয়েচারে বাগানের গোলাপ উঠে এল রাজপুত্র রাজকন্যাদের হাতে।

আবার কবিতায়, গানে অজস্র গোলাপ ফোটানো রবীন্দ্রনাথ ১৯০১ সালে পাবনা থেকে লেখা চিঠিতে বন্ধু প্রিয়নাথ সেনকে গোলাপের ব্যবসায় নামার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন।

প্রিয়নাথ সেনকে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, 'কুষ্ঠিয়ার আর একটা কাজ হতে পারে—নদীর ধারে খানিকটা জমি নিয়ে গোলাপের ক্ষেত করে কলকাতা market- এ ফুল supply করা। তাতে হাজার দুয়েক টাকা মূলধন লাগবার কথা—নগেন্দ্র সেই কাজে প্রবৃত্ত হবার সংকল্প করচে—তুমি যদি ইচ্ছা কর তার সঙ্গে যোগ দিতে পার—কাজটা লাভজনক বলে অনেকে ভরসা দেয়। তুমি ফুলের মার্কেটে খবর নিলেই জানতে পারবে গোলাপ তারা কি মূল্যে খরিদ ও বিক্রী করে। এ অঞ্চলের নদী তীরের বেলে জমি গোলাপের পক্ষে অত্যন্ত অনুকূল soil,…গোলাপের ব্যবসায় তোমার মতো সৌন্দর্যপিপাসুর উপযুক্ত হতে পারে…।'

বিশ্বকবি শেষ পর্যন্ত গোলাপের ব্যবসায় নেমেছিলেন কি না, তা ঠিক জানা যায় না। তবে এই চিঠি লেখার ১২৫ বছর পর বাংলাদেশে গোলাপসহ অন্যান্য ফুল-বাণিজ্যের যে বাড়বাড়ন্ত, তাতে ব্যবসায়ী হিসেবেও যে তিনি দূরদর্শী ছিলেন তার পরিচয় পাওয়া যায়।

Comments

The Daily Star  | English

Trump slaps allies Japan, South Korea with 25% tariffs

In near-identically worded letters to the Japanese and South Korean leaders, Trump said the tariffs would apply from August 1

22m ago