সর্বদলীয় বৈঠকে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ উত্থাপন, যা আছে খসড়ায়
রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে 'জুলাই ঘোষণাপত্র' নিয়ে সর্বদলীয় বৈঠক করেছে বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ।
জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরতে গত ৩১ ডিসেম্বর 'জুলাই ঘোষণাপত্র' জারির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
পরে অন্তর্বর্তী সরকার এই ঘোষণাপত্র জারির দায়িত্ব নেয় এবং সর্বসম্মতভাবে তা তৈরির জন্য সর্বদলীয় বৈঠক আয়োজন করে।
আজ বৃহস্পতিবারের বৈঠকে জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়া উপস্থাপন করা হয় এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের মতামত জানাতে বলা হয়।
যা আছে ঘোষণাপত্রে
তিন পৃষ্ঠার এ ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সংবিধান, ১/১১ ষড়যন্ত্র, আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলের স্বরূপ বর্ণনা করে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয় এবং নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থার অভিপ্রায় জানানো হয়।
এতে বলা হয়, যেহেতু এই ভূখণ্ডের মানুষ স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যুগের পর যুগ সংগ্রাম করেছিল এবং এর ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান আন্দোলনের মাধ্যমে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল;
যেহেতু, এই ভূখণ্ডের মানুষ দীর্ঘ ২৩ বছর পাকিস্তানের শাসকদের বঞ্চনা ও শোষনের বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়েছিল এবং নির্বিচার গণহত্যার বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিল,
যেহেতু স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের সংবিধান স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ ও অংশগ্রহণকারী লক্ষ লক্ষ মানুষের মতামত ও প্রত্যাশাকে প্রতিফলন করতে ব্যর্থ হয়েছিল এবং গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যর্থ করার পথ সুগম করেছিল,
যেহেতু, পরবর্তী সময়ের বিভিন্ন শাসনামলে রাষ্ট্র ও এর প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিনির্মানে ব্যর্থতা ছিল এবং একারণে বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও শাসকগোষ্ঠীর জবাবদিহীতা প্রতিষ্ঠা করা যায়নি,
যেহেতু, ক্ষমতার সুষ্ঠ রদবদলের প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক ব্যর্থতার সুযোগে ষড়যন্ত্রমূলক ১/১১ বন্দোবস্তের মাধ্যমে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার একচ্ছত্র ক্ষমতা ও আধিপত্যের পথ সুগম করা হয়;
যেহেতু, বিগত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের দুঃশাসন, গুম- খুন, আইন বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ এবং একদলীয় স্বার্থে সংবিধান সংশোধন ও পরিবর্তন বাংলাদেশের সকল রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে,
যেহেতু, বিগত সরকারের আমলে একটি চরম গণবিরোধী, একনায়কতান্ত্রিক, মানবিক অধিকার হরণকারী শক্তি বাংলাদেশকে একটি খুনি রাষ্ট্রের রূপ দিয়ে আন্তর্জাতিক ভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করে,
যেহেতু, উন্নয়নের নামে শেখ হাসিনা পরিবারের নেতৃত্বে অবাধে লুটপাট, ব্যাংক লুট, টাকা পাচার এবং অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে বিগত সরকার বাংলাদেশ ও এর সম্ভাবনাকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে এবং এর পরিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্য ও জলবায়ুকে বিপন্ন করে;
যেহেতু, শেখ হাসিনার ফ্যাসিষ্ট সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দল, ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠনসহ সমাজের সর্বস্তরের জনগণ গত প্রায় পনের বছর যাবত নিরন্তর সংগ্রাম করে জেলজুলুম, হামলা মামলা, গুম খুন ও আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়;
যেহেতু, বাংলাদেশে বিদেশি রাষ্ট্রের অন্যায় প্রভুত্ব, শোষন ও খবরদারির বিরুদ্ধে এদেশের মানুষের ন্যায়সংগত আন্দোলনকে তপ্লিবাহক আওয়ামী লীগ সরকার নিষ্ঠুর শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে দমন করে,
যেহেতু, ধারাবাহিক তিনটি নির্বাচনী প্রহসনের মধ্য দিয়ে অবৈধ আওয়ামী লীগ সরকার এদেশের মানুষকে ভোটাধিকার ও প্রতিনিধিত্ব থেকে বঞ্চিত করে,
যেহেতু, ফ্যাসিষ্ট আওয়ামী আমলে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যত্র ছাত্র ও তরুণদের নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করা হয় এবং সরকারী চাকুরীতে দলীয় নিয়োগের একচেটিয়া ও কোটাভিত্তিক সুবিধা সৃষ্টি করে ছাত্র, চাকুরী প্রত্যাশী ও নাগরিকদের মধ্যে চরম বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়,
যেহেতু, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক ব্যাপক দমন-পীড়ন ও গণহত্যা চালানোর ফলশ্রুতিতে সারা দেশে দল-মত নির্বিশেষে ছাত্র-জনতার উত্তাল গণবিক্ষোভ গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়,
যেহেতু, গণঅভ্যুত্থান চলাকালে ছাত্রদের প্রণীত ৯ দফা দমনে সরকার আরো নির্মমতার আশ্রয় নেয় এবং ইন্টারনেট বন্ধ করে, কারফিউ জাহ্রী করে এবং বররেইড করে ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে গুড়িয়ে দেয়ার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে,
যেহেতু, ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে অদম্য ছাত্র আন্দোলনে রাজনৈতিক দল, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, শ্রমিক প্রতিষ্ঠানসহ সমাজের সকল স্তরের মানুষ যোগদান করে এবং আন্দোলনের একপর্যায়ে সামরিক বাহিনীর সদস্যগণ জনগণের গণতান্ত্রিক লড়াইকে সমর্থন প্রদান করে,
যেহেতু, শেখ হাসিনার পতন, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপ ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনের প্রেক্ষিতে জনগণ ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ পরিচালনা করে এবং অবৈধ ও অনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান,
যেহেতু, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকট মোকাবেলায় গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত জনগণের সার্বভৌমত্বের অভিপ্রায় ও পরম অভিব্যক্তি রাজনৈতিক ও আইনি উভয় দিক থেকে যুক্তিসঙ্গত, বৈধ এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত;
আমরা, ছাত্র-জনতা সেই অভিপ্রায়বলে আত্মমর্যাদা, সাম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচারের যে আদর্শ মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে সেই আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য সার্বভৌম জনগোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের সংগঠিত করিলাম,
আমরা, প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার আহবান জানাচ্ছি এবং ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও অখন্ডতা রক্ষার্থে ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের আহবান জানালাম;
আমরা সুশাসন ও সুষ্ঠ নির্বাচন এবং ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার পুনরাবৃত্তি তেয়াগ নিশ্চিত করার জন্য অন্তবর্তী সরকার প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করবে এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করলাম।
আমরা ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারকে লালন করার দলিল ১৯৭২ সালের সংবিধান সংশোধন বা প্রয়োজনে বাতিল করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করিলাম।
আমরা জুলাই গণঅভ্যুত্থানকালে ফ্যাসিষ্ট আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক সংগঠিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুটপাটের অপরাধগুলোর উপযুক্ত বিচার করা হবে এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করিলাম,
আমরা এই ঘোষণা প্রদান করিলাম যে ১৯৭২ এবং ১/১১ কালের রাজনৈতিক বন্দোবস্তের পরিবর্তন ঘটানোর আমাদের একটি নতুন জনতন্ত্র (রিপাবলিক) প্রয়োজন যা রাষ্ট্রে সকল ধরনের নিপীড়ন, শোষন ও বৈষম্যর অবসান ঘটাবে এবং এদেশের তরুণ সমাজের প্রত্যাশাকে ধারন করতে পারবে।
আমার এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করিলাম যে এই ঘোষণাপত্রকে উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় ও সংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হবে।
আমাদের এই ঘোষণাপত্র ৫ই আগস্ট ২০২৪ সাল থেকে কার্যকর বলে ধরে নেয়া হবে।
Comments