টিয়ারশেল থেকে রক্ষার দৃশ্যকে হিন্দু শিশুকে অত্যাচার বলে মিথ্যা প্রচারণা
সম্প্রতি ইনস্টাগ্রাম ও ইউটিউবে প্রচার হওয়া একটি ভিডিওতে এক শিশুকে টিয়ারশেল থেকে রক্ষার দৃশ্যকে হিন্দু শিশুকে অত্যাচার বলে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
ফ্যাক্টচেকিং প্ল্যাটফর্ম রিউমর স্ক্যানার গতকাল সোমবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, টিয়ারশেল থেকে রক্ষা করতে এক শিশুকে পুলিশ আগুনের তাপের কাছে নিয়ে যাচ্ছে, এমন একটি ভিডিওতে দাবি করা হয়েছে, হিন্দু শিশুকে পুলিশ অত্যাচার করছে।
রিউমর স্ক্যানার অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রচারিত ভিডিওটিতে কোনো হিন্দু শিশুকে পুলিশ কর্তৃক অত্যাচার করা হয়নি বরং ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের মধ্যকার সংঘর্ষ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ছোঁড়া টিয়ারগ্যাসের ঝাঁঝে এক শিশু জ্ঞান হারিয়ে ফেললে তাকে আগুনের তাপে কয়েকজন পুলিশ সদস্য ও আশেপাশে উপস্থিতদের সুস্থ করার চেষ্টার দৃশ্যকে আলোচিত দাবিতে প্রচার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটির একাধিক কি-ফ্রেম নিয়ে রিভার্স ইমেজ সার্চ করলে আশরাফুল আমিন নামের একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্টে চলতি বছরের গত ২০ নভেম্বর তারিখে প্রচারিত একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। ওই ভিডিওর সঙ্গে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওর সম্পূর্ণ মিল আছে।
পোস্টটিতে বলা হয়, 'ঢাকা কলেজ আর সিটি কলেজ শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করা হয়। টিয়ারগ্যাসের ধোঁয়ায় বয়স্ক মানুষ টিকতে পারেনা সেখানে বাচ্চাটির অবস্থা খারাপ হয়ে যায়।'
এরই সূত্র ধরে অনুসন্ধানে জানা যায়, ভিডিওতে প্রদর্শিত পুলিশ সদস্যের নাম শেফাত চৌধুরী। পরবর্তীতে তার ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি খুঁজে বের করে রিউমর স্ক্যানার। শেফাত চৌধুরীর ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি পর্যবেক্ষণ করলে চলতি বছরের ২২ নভেম্বর ওই ঘটনার চারটি ছবির সংযুক্তিসহ সেদিনের ঘটনার বিষয়ে তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টটিতে একটি বিস্তারিত পোস্ট পাওয়া যায়।
ওই পোস্টে তিনি বলেন, ঘটনাটি চলতি বছরের গত ২০ নভেম্বরের। ঢাকা কলেজ এবং সিটি কলেজের মধ্যকার সংঘর্ষ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছিল পুলিশ ও সেনাবাহিনী। সেসময় সায়েন্স ল্যাবের চার লেনের ব্যস্ত রাস্তাটিতে তীব্র যানজট হতে শুরু করে। বৃষ্টির মতো ইট পাথর নিক্ষেপ করা হয় এবং এতে করে সাধারণ জনগণ, পুলিশ সদস্য এবং সেনাবাহিনীর সদস্যরা আহত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য টিয়ার-শেল নিক্ষেপ করা হয়। এমতাবস্থায় সাধারণ মানুষ গ্যাসের তীব্র ঝাঁঝের কারণে চলে গেলেও দুই কলেজের কোনো শিক্ষার্থী চলে যায়নি। ছবিটিতে যে শিশুকে ভিডিওর পুলিশ সদস্য শেফাতের কোলে, সেই ছোট বাচ্চাটি ও তার মা তৎক্ষনাৎ ওই রাস্তাটি পারাপার হওয়ার সময় টিয়ার শেলের গ্যাসের কারণে মা এবং বাচ্চাটির শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল এবং দুজনই কান্না কাটি করছিলেন। বাচ্চাটি অজ্ঞান (সেন্সলেস) হওয়ায় মা দৌড়ে আসছিলেন। পুলিশ সদস্যরা তখন গ্যাসের কারনে আগুন জ্বালিয়ে নিশ্বাস নিচ্ছিল। বাচ্চাটির মায়ের দৌড়ে আসা এবং কান্না দেখে শেফাত চৌধুরী চিৎকার করে নারীকে কাছে নিয়ে এসে বাচ্চাটি কোলে নেন এবং আগুনের কাছে নিয়ে যান। আগুনের পাশে ধরে রাখার কারনে মেয়েটির সেন্স যখন ফিরে আসছিল তখন আগুন কম থাকায় ওখানে থেকে রাস্তায় গিয়ে সবাই বসে পড়ে এবং সেখানে থাকা একজন তার পরণের টি-শার্ট খুলে সেটিতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। তখন বাচ্চাটিকে আবার আগুনের পাশে কোলে ধরে রাখেন এবং নাকে নিশ্বাস নেওয়ান। বাচ্চাটি দ্বীর্ঘ ১০ মিনিট পর মোটামুটি সুস্থ হয়। পরবর্তীতে বাচ্চাটিকে তার মায়ের কোলে দেওয়া হয়।
অর্থাৎ, পুলিশ সদস্যের বক্তব্য অনুযায়ী প্রথমে প্রদর্শিত হওয়া নারী উক্ত শিশুটির মা। শিশুর মাকে হিজাব বা পর্দা করতে দেখা যায় যা থেকে বুঝা যায়, উক্ত নারী বা শিশু হিন্দু নন বরং মুসলিম ছিলেন।
তাছাড়া, পুলিশের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে ওই স্থান গুগল ম্যাপে অনুসন্ধান করলে নিউ এলিফ্যান্ট রোডের সঙ্গে ওই স্থানের সাদৃশ্য পাওয়া যায়।
পাশাপাশি প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করেও জানা যায়, গত ১৯ নভেম্বর (মঙ্গলবার) সায়েন্স ল্যাব এলাকায় ঢাকা কলেজের ছাত্রদের একটি বাসে ওঠাকে কেন্দ্র করে সিটি কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থীর হাতাহাতি হয়। এর জের ধরে গত ২০ নভেম্বর সকালে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা গিয়ে সিটি কলেজে ভাঙচুর চালায়। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে বিকেল পৌনে ৩টার দিকে সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় বেরিয়ে আসেন। তারা সায়েন্স ল্যাবের দিকে এগোয়। তখন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা বেরিয়ে এসে সায়েন্স ল্যাবের কাছাকাছি অবস্থান নেয়। একপর্যায়ে দুই পক্ষ পরস্পরের দিকে ইটপাটকেল ছুঁড়তে থাকে এবং সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়।
Comments