নতুন সভ্যতার জন্য তারুণ্যের শক্তিকে একত্রিত করতে হবে: ড. ইউনূস
নতুন সভ্যতার ভিত্তি স্থাপনে বিশ্বকে বুদ্ধিবৃত্তিক, আর্থিক ও তারুণ্যের শক্তিকে সমন্বয় করার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
আজ বুধবার আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে কপ-২৯ সম্মেলনে দেওয়া বক্তৃতায় তিনি একথা বলেন।
'ওয়ার্ল্ড লিডার্স অ্যাকশন সামিট' শিরোনামে ১২ থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত চলমান কপ-২৯ সম্মেলনে ৯০টিরও বেশি দেশের সরকারপ্রধানের বক্তব্য রাখার কথা রয়েছে।
সম্মেলনে বিশ্ব নেতাদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যের শুরুতে ড. ইউনূস জলবায়ু দুর্যোগকে একটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণে তুলে ধরার প্রস্তাব দেন।
তিনি বলেন, 'এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের জলবায়ু দুর্যোগ সমাধান থেকে শুরু করে অন্যান্য বিপর্যয় থামানোর দিকে নিয়ে যাবে। এটি একটি বড় কাজ, যা অনেক বড় বড় প্রশ্ন নিয়ে আসে। "তিন শূন্যের" নতুন পৃথিবী গড়তে আমার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন আপনাদের কাছে পেশ করতে চাই।'
বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা জলবায়ু সংকট আরও তীব্র হওয়ার দিকটিও তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, 'আমাদের সভ্যতা এখন মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। কারণ আমরা আত্ম-বিধ্বংসী মূল্যবোধ প্রচার করছি। একটি নতুন সভ্যতার ভিত্তি স্থাপনের জন্য আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক, অর্থনৈতিক এবং তারুণ্যের শক্তিকে একত্রিত করতে হবে; একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও আত্মবিশ্বাসে বলিয়ান সভ্যতা তৈরি করতে হবে। আমরা, এই গ্রহের মানব সন্তানরাই গ্রহের ধ্বংসের কারণ হয়ে উঠেছি এবং আমরা স্বেচ্ছায় এ কাজ করছি। আমরা এমন একটি জীবনধারা বেছে নিয়েছি, যা পরিবেশবান্ধব নয়। আর এর পেছনে যুক্তি হিসাবে আমরা অর্থনৈতিক অবকাঠামোর কথা বলি, যাকে দিন-রাত, সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের মতোই প্রাকৃতিক একটি বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। অথচ এই অর্থনৈতিক কাঠামো সীমাহীন ভোগের ওপর নির্ভরশীল। আপনি যত বেশি ভোগ করবেন, তত বড় হবেন। আপনি যত বড় হবেন, তত বেশি উপার্জন করবেন। সর্বোচ্চ মুনাফা আয়ই এই কাঠামোর ভিত্তি, যার মাধ্যমে এর ভেতর সবাই তাদের ভূমিকা পালন করে।'
টিকে থাকতে হলে আমাদের ভিন্ন সংস্কৃতি, জীবনধারা তৈরি করতে হবে বলে মন্তব্য করেন ড. ইউনূস। তিনি এমন একটি ভিন্ন জীবনধারার প্রস্তাব পেশ করেন।
তিনি বলেন, 'এই জীবনধারা শূন্য বর্জ্যের ওপর ভিত্তি করে হবে। আমরা প্রয়োজনীয় চাহিদার মধ্যে খরচ সীমাবদ্ধ রাখব, কোনো বাড়তি বর্জ্য রাখব না। এই জীবনধারা হবে শূন্য কার্বনের ওপর ভিত্তি করে। কোনো জীবাশ্ম জ্বালানি থাকবে না। থাকবে শুধু নবায়নযোগ্য জ্বালানি। এরপর, আমাদের এমন এক অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি করতে হবে যা প্রাথমিকভাবে শূন্য ব্যক্তিগত মুনাফা, অর্থাৎ সামাজিক ব্যবসার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে। এই ব্যবসা অলাভজনক, যা সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করবে। সামাজিক ব্যবসার একটি বড় অংশ মানব সম্প্রদায় ও পরিবেশের সুরক্ষা নিয়ে কাজ করবে। সাশ্রয়ী মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার অধিকার নিশ্চিতের মাধ্যমে মানুষের জীবন রক্ষা পাবে ও গুণগতভাবে উন্নত হবে। এখানে তরুণদের উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ থাকবে। নতুন শিক্ষার মাধ্যমে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রস্তুতি নেবে তারা। আমাদের চাকরিপ্রার্থী তৈরি করা শিক্ষাব্যবস্থার বদলে উদ্যোক্তাকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে।'
এই নোবেলজয়ীর মতে, পরিবেশের নিরাপত্তার জন্যই একটি নতুন জীবনধারা তৈরি করা প্রয়োজন। সেই জীবনধারা কারও ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে না, বরং মানুষ স্বেচ্ছায় তা গ্রহণ করবে।
'তরুণরা এই জীবনধারাকে পছন্দ করে। প্রতিটি তরুণ শূন্য নেট কার্বন নিঃসরণ, সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে শূন্য সম্পদ পুঞ্জিভূতকরণ এবং নিজেদেরকে উদ্যোক্তায় পরিণত করার মাধ্যমে শূন্য বেকারত্ব—নিয়ে বেড়ে উঠবে। প্রতিটি ব্যক্তি তিন শূন্যের ব্যক্তি হিসেবে বেড়ে উঠবে এবং সারা জীবন তিন শূন্যের ব্যক্তিত্ব নিয়ে থাকবে। এভাবেই একটি নতুন সভ্যতা গড়ে উঠবে,' বলেন তিনি।
এরকম একটি সভ্যতা গড়ে তোলা সম্ভব বলে আত্মবিশ্বাস ব্যক্ত করেন ড. ইউনূস।
তিনি তার বক্তব্য শেষ করেন এই বলে, 'আমি আশা করি আমার এই স্বপ্নে আপনারা সবাই যোগ দেবেন। আমরা যদি একসঙ্গে স্বপ্ন দেখতে পারি, তাহলে এই স্বপ্ন সত্য হবেই।'
জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন, কপ-২৯'এ যোগ দিতে সোমবার সন্ধ্যায় বাকুতে পৌঁছেন প্রধান উপদেষ্টা। আগামী ১৪ নভেম্বর তার দেশে ফেরার কথা রয়েছে।
Comments