নতুন নাম-পোশাকে অন্ধকার অতীত ‘ঢাকতে’ চায় র‌্যাব

ছবি: এএফপি

দুই দশক আগে সংঘবদ্ধ অপরাধ ও সন্ত্রাসবাদ দমনের কাজে গঠিত হওয়ার পর থেকে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ আষ্টেপেৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল। মানবাধিকারকর্মী ও সমালোচকরাও এই বাহিনীকে 'সরকারি ডেথ স্কোয়াড' হিসেবে অভিহিত করে আসছেন, যা দায়মুক্তি নিয়ে এর কার্যক্রম পরিচালিত করে আসছিল।

নারায়ণগঞ্জের কুখ্যাত সাত খুন মামলা থেকে শুরু করে কথিত বন্দুকযুদ্ধে কক্সবাজার পৌরসভার কাউন্সিলর একরামুল হক নিহত হওয়া পর্যন্ত নানা ঘটনায় এই বাহিনী বেশ কুখ্যাতি অর্জন করেছে। সর্বশেষ ২০২১ সালে বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

গত ১৫ বছরে বিশেষায়িত এই বাহিনীটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, বিরোধী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সরকারের সমালোচকদের গুম ও তাদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগে ঘরে ঘরে পরিচিত হয়ে উঠেছে। এ সময়কালে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অসংখ্য প্রতিবেদনে এই বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিশদ বিবরণ দেওয়া হয়েছে।

এসব ঘটনার ভেতর র‌্যাবকে 'ভাড়াটে খুনি' হিসেবে ব্যবহার করার বিষয়টিও নারায়ণগঞ্জের আলোচিত 'সেভেন মার্ডার' মামলায় আদালতে প্রমাণিত হয়েছে।

এত কিছুর পরিপ্রেক্ষিতে বছরের পর বছর ধরে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন র‌্যাব সংস্কারের দাবি জানিয়ে আসছিল। গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর এই দাবি আরও জোরালো হয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে র‌্যাব তাদের নাম, লোগো ও পোশাক পরিবর্তনের পরিকল্পনা করছে এবং বাহিনীর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি নতুন আইনের খসড়া তৈরি করছে।

বর্তমানে এই বাহিনীর জন্য আলাদা কোনো আইন নেই। এটি পরিচালিত হয় পুলিশ অধ্যাদেশ অনুসারে।

র‌্যাবের মহাপরিচালক এ কে এম শহিদুর রহমান সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা এই বাহিনীর নাম, নিয়ম ও পোশাক পরিবর্তনসহ সংস্কারের পদক্ষেপ নিয়েছি।'

ইতোমধ্যে বাহিনীর নাম ও পোশাক পরিবর্তনের একটি খসড়া তৈরি করা হয়েছে জানিয়ে র‌্যাব মহাপরিচালক আরও বলেন, 'বাহিনীর জন্য নতুন আইন প্রণয়নের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে, যা খসড়া পর্যায়ে রয়েছে।

কিন্তু সংস্কার নয়, মানবাধিকার কর্মীদের অনেকে এই বাহিনীর বিলুপ্তি চান।

এমন একজন হলেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না। তিনি বলেন, 'র‌্যাব বিলুপ্ত করা উচিত, কারণ এনকাউন্টার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রয়োজন নেই। পুলিশের তিন থেকে চারটি বিভাগ আছে রয়েছে, শান্তি বজায় রাখতে তারা যথেষ্ট।'

এই আইনজীবীর সঙ্গে সহমত পোষণ করেন মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন। তার ভাষ্য, 'একজন মানবাধিকারকর্মী হিসেবে আমার অভিমত হলো বাহিনীটি ভেঙে দেওয়া উচিত। অতীতেও এ কথা আমি বলেছি।'

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গুমের ঘটনা তদন্তে যে কমিশন গঠন করা হয়েছে নূর খান লিটন তার একজন সদস্য। তিনি বলেন, 'তাদের (র‌্যাবের) কর্মকাণ্ড কল্পনারও বাইরে। নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনার পর তাদের প্রতি কোনো সহানুভূতি থাকা উচিত নয়।'

গত ২৮ আগস্ট হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে এই কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। এ পর্যন্ত কমিশন র‌্যাবের বিরুদ্ধে গুমের ১৭২টি অভিযোগ পেয়েছে, যা যেকোনো বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ।

আর ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত পাঁচ সদস্যের এ কমিশনে জমা পড়া অভিযোগের সংখ্যা এক হাজার ৬০০ অভিযোগ। এর ভেতর কমিশন ৪০০টি অভিযোগ যাচাই-বাছাই করেছে। ১৪০ জনের সাক্ষাৎকার নিয়েছে।

কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদন তুলে ধরে নূর খান বলেন, 'র‌্যাবের একটি সেলের ভেতরে আমরা একটি ডায়েরি পেয়েছি। সেলটির দৈর্ঘ্য মাত্র সাড়ে তিন ফুট বাই চার ফুট…একটি ছোট ছিদ্র ছাড়া ওই সেলে আলোর কোনো উৎস ছিল না এবং একটি খোলা ড্রেন ব্যতীত কোনও স্যানিটেশন ব্যবস্থা ছিল না।'

লিটন জানান, এক টুকরো রুটি হাতে পাওয়ার পর সেলের বন্দীরা বুঝতে পারতেন যে সকাল হয়েছে। তিনি বলেন, 'আমরা সেলের দেয়ালে ১৮০ থেকে ১৯০ দিন পর্যন্ত দিন গণনার হিসাব পেয়েছি। দেয়ালে কেউ লিখে রেখেছিলেন "আমি আমার পরিবারকে ভালোবাসি"। এমন পরিবেশে কাউকে বন্দী রাখাটাও একটা গুরুতর নির্যাতন।'

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে, ২০১৫ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে অন্তত ৪৬৭টি কথিত বন্দুকযুদ্ধে জড়িত ছিল র‌্যাব।

বিএনপি সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ পুলিশ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীসহ আটটি বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে র‌্যাব প্রতিষ্ঠা করা হয়।

সংঘবদ্ধ অপরাধ ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে দ্রুত অভিযানের জন্য এই বাহিনী প্রাথমিকভাবে প্রশংসিত হয়েছিল।

বর্তমানে সারাদেশে এই বাহিনীর ১৫টি ব্যাটালিয়ন আছে, যা একজন মহাপরিচালকের অধীনে পরিচালিত হয়, যিনি অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক পদমর্যাদার একজন পুলিশ কর্মকর্তা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক মনে করেন, বিতর্কিত ভূমিকার জন্য র‌্যাব এককভাবে দায়ী নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় র‌্যাবের কিছু ইতিবাচক অবদান রয়েছে।

তৌহিদুল হক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সরকারে যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা কীভাবে বলপ্রয়োগ করেছেন এটা তার উপরেও নির্ভর করে।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, "সরকারে যারা দায়িত্বে আছেন তারা কে, কীভাবে বলপ্রয়োগ করেছেন এটা তার ওপরেও নির্ভরশীল।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ শিক্ষক গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ যে কোনো অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত র‌্যাব সদস্যদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানান।

খসড়া আইন

র‌্যাবের নতুন আইনের খসড়ায় সংবিধান, বিদ্যমান ফৌজদারি আইন ও সার্বজনীন মানবাধিকারের মূলনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাহিনীর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।

বাহিনীর প্রশাসনিক ও অপারেশনাল কার্যক্রম পরিচালনা ও তদারকি, নিয়োগ, পদায়ন এবং শৃঙ্খলাও এই আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে বলে জানান র‌্যাব কর্মকর্তারা।

আইনে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা, আসামিদের গ্রেপ্তার এবং অপরাধ তদন্তের বিধিবদ্ধ ক্ষমতাও নির্দিষ্ট করা হবে বলে জানান এই কর্মকর্তারা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে র‌্যাবের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, ২০২১ সালে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়ায় ইতোমধ্যে বাহিনীর সদস্যদের মানবাধিকার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার চেষ্টা চলছে।

ওই কর্মকর্তা বলেন, 'র‌্যাব সদস্যদের বেআইনি কর্মকাণ্ডে জড়ানো থেকে বিরত রাখতে কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স অ্যাপ্রোচ ব্যবহার করা হয়। যেসব ক্ষেত্রে তারা জড়িত থাকেন সেসব ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীন তদন্তের মাধ্যমে জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়।'

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক র‌্যাব সদর দপ্তরের আরেক কর্মকর্তা বলেন, 'নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের মতো বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ বাহিনীর চার হাজার সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।'

নিজস্ব তথ্যের বরাত দিয়ে কর্মকর্তারা জানান, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত খুন ও ধর্ষণের অভিযোগে তারা ১ হাজার ৪৬০ জন সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করেছেন। একই সময়ে ডাকাতির অভিযোগে ৬১৭ জন, ছিনতাইয়ের অভিযোগে ৬৮০ জন, অপহরণের অভিযোগে ৫০০ জন, প্রতারণার অভিযোগে ২৪৮ জন ও মানবপাচারে অভিযোগে ৩৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এছাড়া প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত খুন ও ধর্ষণের অভিযোগে মোট ৬ হাজার ৫৩১ জন সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। এছাড়া এ সময়কালে ডাকাতির অভিযোগে ৩ হাজার ৭৮৩ জন, ছিনতাইয়ের দায়ে ১১ হাজার ৮৫৫ জন, অপহরণের অভিযোগে ৫ হাজার ৬২৮ জন, প্রতারণার অভিযোগে ৭ হাজার ৬৪১ জন ও মানবপাচারের অভিযোগে ১ হাজার ৮০২ জনকে গ্রেপ্তার করেছেন বাহিনীর সদস্যরা।

Comments

The Daily Star  | English

Those involved in Ijtema ground deaths won't be spared: home adviser

The home adviser met with both factions of Tabligh Jamaat today at the Secretariat

1h ago