চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের বেসরকারি কারা পরিদর্শক হতে শত শত আবেদন

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার। ছবি: সংগৃহীত

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বেসরকারি কারা পরিদর্শক পদ আছে ১২টি। 'অলাভজনক' এবং অবৈতনিক এই পদের ব্যক্তিরা কারাগারের ভেতর বন্দী কিংবা হাজতিদের জন্য ভালো পরিবেশ তৈরি, মানসম্মত খাবার নিশ্চিত করা, মাদক সমস্যার সমাধান, অসুস্থ বন্দীদের ভালো চিকিৎসা নিশ্চিত করা এবং শাস্তির অপপ্রয়োগ কিংবা মানবাধিকার হরণ রোধসহ বিভিন্ন বিষয় দেখভালের দায়িত্ব পান।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আগে এই পদে ছিলেন ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, যুবলীগসহ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকা ব্যক্তি ও তাদের সমমনা লোকজন।

গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগষ্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর আগের পরিদর্শকরা গা ঢাকা দেওয়ার কারণে শূন্য পদে নতুন নিয়োগের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। পদ পেতে কয়েকশ আবেদন জমা পড়েছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন এবং বিভাগীয় কমিশনার অফিসে।

জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আবেদনকারীদের তালিকায় আছেন বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠন এবং অনান্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, সাংবাদিক, উন্নয়নকর্মী, ব্যবসায়ী, সমন্বয়ক ও মানবাধিকারকর্মী পরিচয় দেওয়া অনেকে।

জেলা প্রশাসন এবং চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১২টি পদের মধ্যে আটটি ‍পুরুষদের জন্য এবং চারটি নারীদের জন্য।

কারাগার সূত্র বলছে, কারাগারে বন্দীদের দেখভালের জন্য দুই বছর পর পর ১২ জনকে এ দায়িত্ব দেন বিভাগীয় কমিশনার। তার কাছে নামপ্রস্তাব সুপারিশ করেন জেলা প্রশাসক। সমাজের ভদ্র, গণ্যমান্য, শিক্ষিত ও মানুষের কল্যাণে কাজ করেন এমন ব্যক্তিরাই কারা পরিদর্শক হওয়ার যোগ্যতা রাখেন।

অভিযোগ আছে যে, গত ১৭ বছর ধরে সেবামূলক ও অবৈতনিক এই পদে আসীন হয়েও কারাগারকেন্দ্রিক বিভিন্ন অবৈধ বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন পূর্ববর্তী কারা পরিদর্শকরা। তারা কেবল কারা পরিদর্শকের পদ বাগিয়েই প্রচুর অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও তাদের ঘনিষ্টজনরাই এই পদে আসীন ছিলেন।

আবার অনেক পরিদর্শক তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করেননি। বরং বন্দী-বাণিজ্য, কারাগারে দলীয় নেতাকর্মীদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পাইয়ে দিতে তারা মুখ্য ভুমিকা পালন করেছেন।

পরিদর্শক হিসাবে নিয়োগ পাওয়ার পর বন্দীদের সঙ্গে কথা বলে কারাগারের অভ্যন্তরের পরিবেশ, পরিবেশনকৃত খাবারের মান পরীক্ষা, মাদকের উপস্থিতি, অসুস্থ বন্দীদের সঠিক চিকিৎসার বিষয়ে খোঁজ খবর করা, মিথ্যা মামলায় আটক আছেন এমন বন্দীদের বিষয়ে খোঁজ নেওয়া, সরকারি খরচে অসহায় বন্দীদের মামলা চালানোর বিষয়ে অবহিতকরন এবং কারাগারের সার্বিক ব্যবস্থাপনার খোঁজখবর নেওয়াসহ বিভিন্ন কল্যাণমূলক কাজের সুযোগ থাকে বেসরকারি কারা পরিদর্শকদের।

এর বাইরে জেলখানায় বন্দীদের মানবাধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে কি না, বা শাস্তির অপপ্রয়োগ হচ্ছে কিনা সেদিকে খেয়াল রাখার দায়িত্বও কারা পরিদর্শকদের। এছাড়া জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে এ সংক্রান্ত ত্রৈমাসিক সভায় বন্দীদের কল্যাণে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, সে বিষয়েও কারা পরিদর্শকরা মতামত দেওয়ার সুযোগ পান।

জেলকোডের ৫৬ নম্বর বিধিতে বলা আছে, দুইজন সংসদ সদস্যকে তাদের সংসদীয় আসনে বা তারা সাধারণত যে জেলায় বসবাস করেন সে জেলার প্রতিটি কেন্দ্রীয় বা জেলা কারাগারের বেসরকারি কারা পরিদর্শক হিসেবে নিয়োগ করা হবে। যদি সদস্যসংখ্যা অনুরূপ সংখ্যার চেয়ে বেশি হয় তবে সুবিধাজনক মেয়াদে পর্যায়ক্রমে তাদের নিয়োগ করা হবে। বিভাগীয় কমিশনারগণ উক্ত নিয়োগ প্রদান করবেন এবং তা গেজেটে প্রকাশিত হবে। যদি কোন সংসদ সদস্যের সদস্যপদ অবসান হয়ে যায় তবে বেসরকারি পরিদর্শক পদও অবসান হবে। 

বিষয়টি নিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিভাগীয় কমিশনার অফিসের একজন কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অনেকেই আগ্রহ দেখাচ্ছেন। কারা পরিদর্শকের সুনির্দিষ্ট যোগ্যতা সম্পর্কে বলা নেই। এই পদের জন্য বিএনপি, জামায়াত এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত পরিচয় দিয়ে অনেকে আবেদন করেছেন। আগে আওয়ামী লীগ থেকে অনেক চাপ দেওয়া হত এই পদে নিয়োগের জন্য। এখন বিএনপির লোকজন এই পদে বড় বড় সুপারিশ নিয়ে আসছেন।'

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, 'আবেদনকারীদের মধ্যে অনেকে মামলার আসামি। এখন যাচাই বাছাই ছাড়া তাদের এই পদে নিয়োগ দিলে বন্দীদের জন্য প্রকৃত কল্যাণ সাধন হবে না। এক্ষেত্রে গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট কিংবা পুলিশের মাধ্যমে ভেরিফিকেশন করে নিয়োগ দিলে প্রকৃত কাজের লোকরা কারা উন্নয়নে কাজ করতে পারবে।'

বেসরকারি কারা পরিদর্শক হতে জেলা প্রশাসনে ব্যবসায়ী পরিচয়ে আবেদন করেছেন শাহাদাত হোসেন জুয়েল নামের এক ব্যক্তি। নিজেকে নগর ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি পরিচয় দিয়ে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি বিভিন্ন সামাজিক কাজের সঙ্গে যুক্ত আছি। আমি একজন ব্যবসায়ী। কারাগারের ভেতরটা নানা সমস্যায় জর্জরিত। তাই আমি পরিবর্তন আনার জন্য এই কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে চাই।'

জুয়েলের বিরুদ্ধে পাঁচটি রাজনৈতিক মামলা ছিল জানিয়ে তিনি নিজেই বলেন, 'এখন নেই। তবে আমি জেলে যাইনি। আমি তাই ব্যবসায়ী হিসাবে আবেদন করেছি, অন্য পরিচয়ে নয়।'

জুয়েলের জন্য সুপারিশ করেছেন ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল মামুন নামের একজন।

আবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে মো. রুবাইয়াত ইবনে জামাল নামের একজন আবেদন করেছেন বিভাগীয় কমিশনার অফিসে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমি কাস্টমস সিএনএফ ব্যবসায়ীদের সমন্বয়ক পরিচয়ে সেখানে আবেদন করেছি। আমি নিজেও একজন ব্যবসায়ী। আমার সিএনএফের কাজের অভিজ্ঞতা আছে। যারা মিথ্যা মামলায় বন্দী আছেন, আমি তাদের জন্য কাজ করতে কারা পরিদর্শক হতে চাই।'

এক পর্যায়ে রুবাইয়াত নিজেকে 'দৈনিক বর্তমান কথা' নামের একটি পত্রিকার ক্রাইম রিপোর্টার হিসাবে পরিচয় দেন।

পরিদর্শক নিয়োগের বিষয়ে কথা বলতে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তা ধরেননি চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার তোফায়েল ইসলাম। পরে খুদে বার্তা পাঠানো হলে জানান যে, তিনি চট্টগ্রামের বাইরে আছেন।

বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট সৈয়দ মাহবুবুল হক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অনেকেই আবেদন করছেন। এই প্রক্রিয়া চলমান আছে। যাচাই-বাছাই হবে। যারা সত্যিকার অর্থেই বন্দীদের কল্যাণে কাজ করবেন, তাদেরকেই এই পদে নিয়োগ দেওয়া হবে।"

Comments

The Daily Star  | English

‘Shockingly insufficient’

"The proposed decision to allocate USD 250 billion per year for all developing countries is shockingly insufficient," said the adviser

5h ago