৫ আগস্ট থেকে শাস্তি পেয়েছেন ৮৬ চিকিৎসক, ১৩৬ মেডিকেল শিক্ষার্থী

তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মেয়াদের জন্য ইন্টার্নশিপ ও একাডেমিক কার্যক্রম স্থগিত, হল থেকে বহিষ্কার, এমনকি মেডিকেল সার্টিফিকেট বাতিলের সুপারিশের মতো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
প্রতীকী ছবি

গত দুই মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলনের 'বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া'সহ বিভিন্ন অভিযোগে দেশের আটটি সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে কমপক্ষে ৮৬ জন চিকিৎসক ও ১৩৬ জন শিক্ষার্থী বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মুখোমুখি হয়েছেন।

এসব প্রতিষ্ঠানের অফিস আদেশ অনুযায়ী, চিকিৎসকদের মধ্যে পাঁচজন অধ্যাপক, তিনজন সহযোগী অধ্যাপক, দুইজন সহকারী অধ্যাপক এবং ৪১ জন ইন্টার্ন রয়েছেন।

তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মেয়াদের জন্য ইন্টার্নশিপ ও একাডেমিক কার্যক্রম স্থগিত, হল থেকে বহিষ্কার, এমনকি মেডিকেল সার্টিফিকেট বাতিলের সুপারিশের মতো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অনেককে আজীবনের জন্য ক্যাম্পাসে 'অবাঞ্ছিত' ঘোষণা করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট ক্যাম্পাসের সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ৫ আগস্ট থেকে ২ অক্টোবরের মধ্যে এই ২২২ জন চিকিৎসক ও মেডিকেল শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের মধ্যে রয়েছে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের বিরোধিতা, আন্দোলনে নাশকতা তৈরির জন্য শিক্ষার্থী ও চিকিৎসকদের হুমকি দেওয়া, আওয়ামী লীগের রাজনীতি করা এবং ছাত্র-নেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থানের সময় শিক্ষার্থী ও চিকিৎসকদের শারীরিক ও মানসিকভাবে লাঞ্ছিত করা।

এই চিকিত্সক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ক্যাম্পাসে ও তার আশেপাশে চাঁদাবাজি, সহিংসতা, মাদক চোরাকারবার ও সেবন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হুমকি, র‌্যাগিং ও ইন্টার্নদের ওপর হামলার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন।

৮৬ জন চিকিৎসকের মধ্যে সিলেটের এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের ৩৬ জন, ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ১৭ জন, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ১৩ জন, বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের ১২ জন এবং ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজের আটজন রয়েছেন।

১৩৬ জন মেডিকেল শিক্ষার্থীর মধ্যে দিনাজপুরের এম আব্দুর রহমান মেডিকেল কলেজের ৩৯ জন, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ২৮ জন, রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ২০ জন, ওসমানী মেডিকেল কলেজের ১৯ জন, রংপুর মেডিকেল কলেজের ১৬ জন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজের ১০ জন এবং স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের চারজন রয়েছেন।

হাসিনা সরকারের পতনের পর স্বাস্থ্যখাতে খানিকটা অস্থিরতার মধ্যেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোর অনেক প্রধান ও শীর্ষ কর্মকর্তা পদত্যাগ করেছেন বা কাজে আসা বন্ধ করে দিয়েছেন। যার ফলে দুর্ভোগে পড়েছেন রোগীরা।

শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে এমন মেডিকেল কলেজগুলোর মধ্য থেকে পাঁচটির পরিচালক ও অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার। তারা দাবি করেন, একাডেমিক কাউন্সিল বা হাসপাতাল পরিচালনা কমিটি অভিযোগ তদন্তের পরে যে সুপারিশ করেছে তার ভিত্তিতে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের পরিচালক ডা. এইচএম সাইফুল ইসলাম বলেন, 'বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়া চিকিৎসক ও শিক্ষার্থীদের তালিকা সরকারি সংস্থাকে দেওয়া এবং তাদের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আমরা এই ব্যবস্থা নিয়েছি।'

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে ১৩ জন চিকিৎসককে ক্যাম্পাসে 'অবাঞ্ছিত' ঘোষণা করা হয়েছে এবং চারজন ছাত্রীকে হল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। গত ২২ আগস্ট হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাজহারুল ইসলাম খানের সই করা অফিস আদেশ থেকে এ তথ্য জানা যায়।

শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে বিভিন্ন অভিযোগে ছয় চিকিৎসককে আজীবন 'অবাঞ্ছিত' ঘোষণা করে ক্যাম্পাস থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ ছয় ইন্টার্নকে দুই বছরের জন্য বহিষ্কার করেছে।

ওসমানী মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ ৫৫ চিকিৎসক ও মেডিকেল শিক্ষার্থীকে শাস্তি দিয়েছে। এদের মধ্যে ১০ জন চিকিৎসক, ১১ জন শিক্ষক, ১৫ জন ইন্টার্ন এবং ১৯ জন শিক্ষার্থী। ১১ শিক্ষকের মধ্যে ছয়জনকে সব ধরনের প্রশাসনিক ও একাডেমিক কার্যক্রম থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। ১৫ জন ইন্টার্নের মধ্যে ১১ জনকে ছয় মাস থেকে দুই বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে।

সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা সম্পর্কে জানতে চাইলে ওসমানী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. শিশির রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, 'এই শিক্ষার্থী ও চিকিৎসকরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। একাডেমিক কাউন্সিলের সুপারিশ ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ তদন্তের পর তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।'

তিনি জানান, যারা শাস্তি পেয়েছেন, তারা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেন।

ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজে আট চিকিৎসক ও ১০ শিক্ষার্থীকে জরিমানা করা হলেও দুই চিকিৎসকের মেডিকেল সার্টিফিকেট বাতিলের সুপারিশ করেছে কর্তৃপক্ষ। ১০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে আটজনকে হল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ২ সেপ্টেম্বর দেওয়া অফিস আদেশ অনুসারে তারা ছয় মাস থেকে দুই বছর পর্যন্ত একাডেমিক কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবেন না।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী রাকিবুল হাসান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '১৫ জুলাই ছাত্রলীগের সমাবেশে যোগ দেওয়ার কারণে আমাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। সেদিন কোনো মারামারি বা সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। আওয়ামী লীগ সরকারকে সমর্থন করেছিলাম বলেই আমাকে টার্গেট করা হয়েছে। আমার মতো অনেকেই রাজনৈতিক কারণে অভিযোগের শিকার হচ্ছেন।'

কলেজ কর্তৃপক্ষ যে ২৮ জন শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করেছে, তাদের মধ্যে রাকিবুল একজন। আরও ১৩ ইন্টার্নকে ডরমেটরি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১১ জনের ইন্টার্নশিপ ছয় মাস থেকে দুই বছরের জন্য স্থগিত করা হয়েছে।

ভয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মেডিকেল কলেজের একজন ইন্টার্ন চিকিৎসক বলেন, 'আওয়ামী লীগের রাজনীতি করায় আমাকে দুই বছরের জন্য বরখাস্ত করা হয়েছে এবং ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে।'

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যশিক্ষা বিভাগের মহাপরিচালক অধ্যাপক নাজমুল হোসেন বলেন, 'বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে খারাপ শাসনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। অনেক শিক্ষক ও চিকিৎসকও এসবের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এতে মেডিকেল কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে।'

তিনি বলেন, 'ঢাকার রাজপথ যখন শত শত তরুণের রক্তে রঞ্জিত ছিল, তখন আমাদের কিছু শিক্ষক ও চিকিৎসক আওয়ামী লীগের সমাবেশে অংশ নেওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ মারাত্মক আকার ধারণ করে।'

তিনি উল্লেখ করেন, সরকারি চাকরিতে সুস্পষ্ট বিধি রয়েছে। কিন্তু চাপ, প্রলোভন, ভয় বা প্ররোচনায় পরে বিধি লঙ্ঘন কখনোই কাম্য নয়।

অধ্যাপক নাজমুল বলেন, 'আমরা যৌক্তিকভাবে সমস্যাটি সমাধান করার চেষ্টা করছি। কিছু ক্ষেত্রে সফল হয়েছি, অনেক ক্ষেত্রে পারিনি। তবে মেডিকেল কলেজগুলোতে শৃঙ্খলা ফেরাতে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।'

তিনি মনে করেন, বেশিরভাগ মেডিকেল কলেজে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে এসেছে, যদিও ক্ষমতাচ্যুত সরকারের পক্ষে সন্দেহজনক ভূমিকা পালনকারী কিছু শিক্ষক ও শিক্ষার্থী এখনও ক্যাম্পাসে রয়েছেন।

'যারা বড় অন্যায় করেছে, তাদের দ্রুত শাস্তি দেওয়া হবে। তবে যাদের সম্পৃক্তা তুলনামূলক কম, তাদের ক্ষমা করা উচিত,' যোগ করেন তিনি।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব চিকিৎসক ও মেডিকেল শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অভিযোগের যথাযথ তদন্তের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন।

তিনি বলেন, 'আমরা দেখেছি, আগের সরকারের সমর্থকরা পুরনো অভিযোগের ভিত্তিতে শাস্তির মুখে পড়েছেন। এসব ক্ষেত্রে যে অভিযোগ উঠেছে, তা একাডেমিক নয়, রাজনৈতিক। সুতরাং, কলেজের প্রেক্ষাপটে এই অভিযোগগুলো বৈধ কি না, তা যাচাই করার দায়িত্ব কলেজ কর্তৃপক্ষের।'

তার ভাষ্য, 'শিক্ষার্থীদের বহিষ্কার করে কী লাভ? বরং তাদের সংশোধনের সুযোগ দেওয়া উচিত। কারো বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ থাকলে কলেজ কর্তৃপক্ষের মামলা করা উচিত।'

Comments

The Daily Star  | English
Awami League leader Matia Chowdhury (1942-2024)

Matia Chowdhury no more

She breathed her last at 12:37pm at Evercare Hospital where she was undergoing treatment

1h ago