নানামুখী চাপে অন্তর্বর্তী সরকার

বারবার পিছিয়ে আসছে নিজেদের সিদ্ধান্ত থেকে
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বঙ্গভবনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে শপথ বাক্য পাঠ করান। ছবি: পিআইডি

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার দুই মাসে কোনো একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে আবার সেখান থেকে পিছিয়ে গেছে, এমন ঘটনা ঘটেছে অন্তত ১০ বারেরও বেশি।

এটাকে অনভিজ্ঞতা, সংকল্পের অভাব এবং নানান দাবির মধ্যে ভারসাম্য রাখার প্রচেষ্টায় তৈরি হওয়া সমস্যার লক্ষণ হিসেবে দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের উচ্চপদস্থ সূত্রের মতে, সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসার মূল কারণ হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হওয়া সমালোচনা এবং পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মানুষের প্রত্যাশার কারণে সৃষ্ট চাপ।

নানাভাবে চাপে রাখার চেষ্টা করা বিভিন্ন গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক শক্তিকে সামলানোর কৌশল হিসেবে কখনো কখনো সরকারকে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে দেখা যায়।

অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস শপথ গ্রহণের পর প্রায় টানা কয়েক সপ্তাহ বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে চলে নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলন। আন্দোলনকারীদের মনে হয়েছিল, তাদের কথা মেনে নেওয়ার মতো, তাদের কষ্ট বোঝার মতো একজন মানুষ অবশেষে তারা পেয়েছেন।

সিনিয়র সচিব বা ডেপুটি কমিশনার নিয়োগ হোক কিংবা সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান বা পাবলিক প্রসিকিউটর—বাস্তবতা ও জনসাধারণের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে ভারসাম্য রাখতে গিয়ে সরকার বারবার নিজের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আল মাসুদ হাসানুজ্জামান মনে করেন, নিজের অবস্থান থেকে পিছিয়ে যাওয়াটা 'সিদ্ধান্তহীনতা'র লক্ষণ ছাড়া আর কিছুই নয়।

তিনি বলেন, 'সরকারকে অনেক দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। কারণ তাদের হাতে সময় খুবই কম এবং এই কারণেই কিছু ভুল হচ্ছে।'

দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, প্রশাসন পরিচালনার জন্য সরকারের যোগ্য লোকের প্রয়োজন ছিল, কিন্তু জনগণের দাবি মানতে হয়েছে।

তিনি বিশ্বাস করেন যে, সরকার সবসময় সঠিক তথ্য পেয়ে কাজ করছে না।

গত মাসে জেলা প্রশাসক নিয়োগের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে উপদেষ্টা পরিষদের ঘনিষ্ঠ এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, যথাযথ যাচাই-বাছাইয়ের পর আদেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সচিবালয়ে এক নজিরবিহীন দৃশ্যের অবতারণা হয়। বিক্ষোভের কারণে আট ডিসির নিয়োগ বাতিল করতে হয় সরকারকে।

ওই কর্মকর্তা বলেন, মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব আমলাতান্ত্রিক পদ। কিন্তু অধিকাংশ আমলা মনে করেন, এই পদে যারা দায়িত্ব পালন করেন, তারা ক্ষমতাসীন দলের প্রতি অনুগত।

এই ধারণার কারণে অন্তর্বর্তী সরকার কয়েকজন কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসে।

নিয়োগের ক্ষেত্রে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বেশ কয়েকবার।

এ কে এম মতিউর রহমানকে গত ৩০ সেপ্টেম্বর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে আবার তিন দিনের মধ্যে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়। ওএসডিকে শাস্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

তাকে নিয়োগ দেওয়ার পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর রেখা তার বই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পরে এবং অনেকেই তার নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। সূত্র বলছে, এই কারণেই অন্তর্বর্তী সরকার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়।

কিন্তু এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার মতে, এ কে এম মতিউর রহমান একজন মেধাবী কর্মকর্তা।

আবার গত ৩০ সেপ্টেম্বর খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসাবে দুই বছরের চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয় অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইলাহী ডি খানকে। এর মাত্র নয় ঘণ্টা পরই সেই চুক্তি বাতিল করা হয়।

সরকার চুক্তি বাতিলের কোনো কারণ উল্লেখ না করলেও সূত্র জানায়, তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের দুর্নীতির অভিযোগ ছিল।

২০তম বিসিএস ব্যাচের কূটনীতিবিদ মোহাম্মদ খোরশেদ আলম খাস্তগীরকে ২৫ সেপ্টেম্বর পোল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের সময় তার ভূমিকার জন্য নিয়োগ দেওয়ার ১০ দিন পর তা বাতিল করা হয়।

অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে শাহদীন মালিককে নিয়োগ দেওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে অধ্যাপক আলী রীয়াজকে দায়িত্ব দেয়।

অর্থনীতিবিদ ও জননীতি বিশেষজ্ঞ মাসরুর রিয়াজ গত ১৩ আগস্ট বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান পদে নিযুক্ত হন। এর চার দিন পর তিনি এই দায়িত্ব পালনে অপারগতার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন।

আইনজীবী এহসানুল হক সমাজীকে গত ২৭ আগস্ট ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের নতুন পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগের একদিন পর বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা এই সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সামনে বিক্ষোভ করেন।

পরের দিন সমাজী দায়িত্ব গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান।

গত ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পর্ষদে সাতজন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেয় বিএসইসি। তাদের মধ্যে একজন মালদ্বীপ ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মাজেদুর রহমান। তিনি এই দায়িত্ব নিতে রাজি হননি।

গত মাসে চলচ্চিত্র নির্মাতা আশফাক নিপুণ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডে নিয়োগ পান। তিনি কেবল এই দায়িত্ব পালনেই অস্বীকৃতি জানাননি, সেন্সর বোর্ড ব্যবস্থাকেই সম্পূর্ণ বাতিল করার পরামর্শ দেন।

গত ২২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড বিলুপ্ত করে 'বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড' গঠন করার ঘোষণা দেয় সরকার।

Comments

The Daily Star  | English

Admin officers protest plan for more non-admin deputy secretaries

Non-admin officers announce strike tomorrow, demanding exam-based promotions

1h ago