শেখ হাসিনাকে বহনকারী ফ্লাইট যেভাবে যে রুটে ভারতে গিয়েছিল

শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমানবাহিনীর উড়োজাহাজটি গত ৫ আগস্ট ঢাকা ছাড়ার সময় একটি প্রশিক্ষণ ফ্লাইট হিসেবে উড্ডয়ন করে এবং এর ফ্লাইটপথ ও অবস্থান অন্যদের না জানাতে ট্রান্সপন্ডার বন্ধ করে দেয়।

একটি উড়োজাহাজের অবস্থান, নাম, উচ্চতা, গতি এবং স্বয়ংক্রিয় জিওলোকেটার সিস্টেম জানাতে থাকে ট্রান্সপন্ডার। হাসিনাকে বহনকারী উড়োজাহাজটি পশ্চিমবঙ্গে ভারতীয় আকাশসীমার কাছাকাছি পৌঁছানোর আগে এর ট্রান্সপন্ডার চালু করা হয়নি বলে বেশ কয়েকটি সূত্র দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছে।

দ্য ডেইলি স্টার এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল (এটিসি) থেকে ফ্লাইট এজেএএক্স১৪৩১ এর প্রোগ্রেস স্ট্রিপের একটি অনুলিপি পেয়েছে। একটি ফ্লাইটের প্রোগ্রেস স্ট্রিপ হলো এমন একটি ছোট কার্ড, যার মাধ্যমে এটিসি আকাশে উড়তে থাকা নির্দিষ্ট উড়োজাহাজ ট্র্যাক করে, যাতে অন্য কোনো উড়োজাহাজের সঙ্গে সেটির সংঘর্ষ না হয়।

এতে লকহিড সি-১৩০ হারকিউলিস উড়োজাহাজের ককপিট ও ঢাকার এটিসির মধ্যে রেডিও যোগাযোগের একটি রেকর্ডিংও রয়েছে।

ফ্লাইট প্রোগ্রেস স্ট্রিপ অনুযায়ী, হাসিনাকে বহনকারী উড়োজাহাজটি ৫ আগস্ট বিকেল ৩টা ০৯ মিনিটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পশ্চিমে ঢাকার বঙ্গবন্ধু এয়ারবেস থেকে উড্ডয়ন করে।

এর মাত্র ৩০ মিনিট আগে লাখো বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা হাসিনার তৎকালীন সরকারি বাসভবন গণভবনে ঢুকে পড়ে।

হাসিনার পদত্যাগের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে প্রথমে দুপুর ২টায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার কথা ছিল সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ জামানের। এটি পিছিয়ে দুপুর ৩টায় করা হয় এবং শেষ পর্যন্ত তিনি বিকেল ৪টার দিকে ভাষণ দেন।

আগস্টের শেষ সপ্তাহে নিউইয়র্কভিত্তিক নাগরিকটিভি ডট কমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ওয়াকার বলেছিলেন, হাসিনা যে পালিয়ে যাচ্ছেন, তা তিনি জানতেন না।

তিনি বলেন, 'আমি যখন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছিলাম, তখন কেউ একজন আমাকে জানিয়েছিলেন যে তিনি দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, তিনি পালাচ্ছেন। আমি জানতাম না যে তিনি দেশ ছেড়ে যাচ্ছেন। আমি মনে করি, তিনি যদি থেকে যেতেন, তাহলে সেটা তার জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতো। অবশ্যই কেউই চায় না যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হোক। পরিস্থিতি অত্যন্ত অস্থিতিশীল ছিল।'

হাসিনাকে বহনকারী উড়োজাহাজটি ঢাকা-কলকাতা রুটের ওয়েপয়েন্ট 'বিইএমএকে' পৌঁছানোর পর ট্রান্সপন্ডার ও স্বয়ংক্রিয় জিওলোকেটার সিস্টেম চালু করে। এরপর থেকেই এটি রাডারে দেখা যায়।

ঢাকা বিমানবন্দরে রাডার স্ক্রিনের স্ক্রিন গ্র্যাব অনুসারে, এটি প্রথমে কলকাতার দিকে যাত্রা করে। পরবর্তীতে সেটি ভারতের রাজধানী থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে গাজিয়াবাদের হিন্দন বিমান ঘাঁটির দিকে যায়।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সম্ভবত উড়োজাহাজটি সরাসরি দিল্লি না গিয়ে প্রথমে কলকাতার দিকে যাত্রা করার কারণ হচ্ছে, এটি বাংলাদেশের আকাশসীমায় যতটা সম্ভব কম সময় থাকতে চেয়েছিল।

ঢাকা থেকে দিল্লি যেতে উড়োজাহাজগুলো রাজশাহীর ওপর দিয়ে উড়ে যায় এবং এই রুটে ঢাকা থেকে কলকাতা রুটের চেয়ে বাংলাদেশের আকাশসীমায় কয়েক মিনিট বেশি থাকতে হয়।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ৬ আগস্ট দেশটির রাজ্যসভায় বলেন, হাসিনা 'সংক্ষিপ্ত নোটিশে' ভারতে আসার অনুমতি চেয়েছিলেন।

ফ্লাইট প্রোগ্রেস স্ট্রিপ অনুসারে, উড়োজাহাজটি ভারতীয় আকাশসীমায় প্রবেশ করছে এটা দেশটির কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছিল।

হাসিনাকে বহনকারী ফ্লাইটটিকে স্কোয়াক কোড ৪১৩১ দেওয়া হয়েছিল। এটিসি তার আকাশসীমায় উড়তে থাকা প্রতিটি উড়োজাহাজকে চার সংখ্যার একটি কোড দিয়ে চিহ্নিত করে।

উড্ডয়নের আগে ক্রু ম্যানুয়ালি এই কোডটি উড়োজাহাজের ট্রান্সপন্ডারে প্রবেশ করে।

ঢাকা এটিসির রাডার মনিটরের একটি স্ক্রিন গ্র্যাব দেখায়, ফ্লাইট এজেএএক্স১৪৩১ ভারতীয় আকাশসীমায় প্রবেশের কিছুক্ষণ আগে তার ট্রান্সপন্ডার চালু করে।

যখন একটি ফ্লাইট পরিকল্পনা অনুমোদন দেওয়া হয়, তখন এর স্কোয়াক কোড গন্তব্যের এটিসিকে পাঠানো হয়। হাসিনাকে বহনকারী উড়োজাহাজের ক্ষেত্রে কলকাতায় এই কোড পাঠানো হয়।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, উড়োজাহাজ কাছাকাছি আসার বিষয়ে একে অপরকে অবহিত করতে ঢাকা ও কলকাতার এটিসির মধ্যে সরাসরি হটলাইন রয়েছে।

উড়োজাহাজটি সেকেন্ডারি রাডারে দেখা না গেলেও ককপিট ক্রুরা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ট্রাফিক কন্ট্রোলার এবং সম্ভবত কলকাতার এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ রেখেছিল।

সি-১৩০ এবং ঢাকার গ্রাউন্ড কন্ট্রোলারের মধ্যে রেডিও যোগাযোগের রেকর্ডিং থেকে জানা যায়, ফ্লাইট এজেএএক্স১৪৩১ বঙ্গবন্ধু এয়ারবেস থেকে রানওয়ে ৩২-এ যাওয়ার জন্য ট্যাক্সিওয়ে সাউথ আলফা বেছে নেয়।

গ্রাউন্ড কন্ট্রোলার উড়োজাহাজটিকে সতর্ক করে যে দুটি আন্তোনভ এএন-৩২ সেখানে রয়েছে এবং সতর্কতা অবলম্বন করতে।

উড়োজাহাজটিকে ২০ হাজার ফুটের প্রাথমিক উচ্চতায় উড়ে চলার জন্য বলে এটিসি।

৫ আগস্ট এজেএএক্স১৪৩১ এর ফ্লাইটপথ দেখা যায় ফ্লাইটরাডার২৪ ডটকমে। এজেএএক্স১৪৩১ চার হাজার ফুট অতিক্রম করার পর পাইলট ঢাকা এরিয়া কন্ট্রোল সেন্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

পাইলট বলেন, 'ঢাকা কন্ট্রোল এজেএক্স ১৪৩১ ১১০ (১১ হাজার ফুট) অতিক্রম করে ২০০তে (২০ হাজার ফুট) যাচ্ছে এবং আমরা বামে মোড় নেওয়ার মাত্র ১৫ মাইল বাকি।'

ঢাকায় নিয়ন্ত্রক এর অনুমোদন দেন।

ক্রু অবশেষে ২৪ হাজার ফুটের জন্য অনুমতি চাইলে ঢাকা এটিসি অনুমতি দেয়।

এরপর এটিসি ককপিট ক্রুদের ট্র্যাফিক সম্পর্কে সতর্ক করে জানায়, একটি এয়ারবাস এ৩২০ ঢাকার দিকে যাচ্ছে। এতে বলা হয়, এয়ারবাসটি তাদের উপরে ছিল এবং ২৬ হাজার ফুট নিচে নামছিল।

এরপরেই ঢাকা এটিসি বলেছিল, 'এজেএক্স ১৪৩১ কলকাতা কন্ট্রোলের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।'। যার অর্থ, এরপর থেকে ক্রুদের কলকাতা এটিসির সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে এবং তাদের আগমন সম্পর্কে ঘোষণা দিতে হবে।

সূত্র জানায়, সাধারণত ফ্লাইট সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছালে এই ঘোষণা দিতে হয়।

হাসিনাকে বহনকারী উড়োজাহাজটি যখন উড্ডয়ন করে তখন এটিসি টাওয়ারে ছিলেন বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সদস্য (পরিচালনা ও পরিকল্পনা) এয়ার কমোডর এএফএম আতিকুজ্জামান। তিনি উড়োজাহাজটি উড়তে দেখেছেন।

দ্য ডেইলি স্টারকে আতিকুজ্জামান বলেন, 'আমার কোনো ধারণাই ছিল না যে ওই ফ্লাইটে কারা আছে। আমি ওইসময় টাওয়ারে স্বাভাবিক দায়িত্ব পালন করছিলাম। তখন বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ ফ্লাইট উড্ডয়ন করছে, সেটাই জানতাম। ভেতরে কারা ছিল, সে বিষয়ে একেবারেই কিছু জানতাম না।'

ইন্ডিয়া টুডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাসিনার উড়োজাহাজটি সীমান্ত অতিক্রম করার পর পশ্চিমবঙ্গের হাশিমারা বিমানঘাঁটিতে ১০১ স্কোয়াড্রনের দুটি ডাসাল্ট রাফালে যুদ্ধবিমান এটিকে এসকর্ট করে।

যুদ্ধবিমান দুটি সি-১৩০ এর জন্য অপেক্ষা করছিল।

ইন্ডিয়া টুডে ৬ আগস্ট জানিয়েছে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সীমান্ত থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে থাকতেই ফ্লাইটটির ওপর নজরদারি শুরু করে।

সূত্রের দাবি, হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা বা ফ্লাইট ক্রু ও সিকিউরিটি সার্ভিসেস ফোর্স (এসএসএফ) সদস্যরা কেউই ঢাকা ছাড়ার আগে ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করেননি।

হাসিনার কূটনৈতিক পাসপোর্ট ছিল এবং রেহানার ছিল ব্রিটিশ পাসপোর্ট।

ভারতীয় গণমাধ্যমের মতে, উড়োজাহাজটি ঢাকা সময় সন্ধ্যা ৬টা ১৫ মিনিটে হিন্দন বিমানঘাঁটিতে অবতরণ করে।

এরপর হাসিনাকে উত্তর প্রদেশের নয়ডায় ভারত সরকারের দেওয়া একটি নিরাপদ বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়।

এসএসএফ সদস্য ও ক্রুরা একদিন পরে বাংলাদেশে ফিরে আসেন।

 

Comments

The Daily Star  | English

One killed in multi-vehicle crash on Dhaka-Mawa highway

The chain of crashes began when a lorry struck a private car from behind on the Mawa-bound lane

37m ago