ডিসি নিয়োগ নিয়ে অসন্তোষ, সচিবালয়ে কর্মকর্তাদের হাতাহাতি
নতুন জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষের জেরে সচিবালয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটেছে।
কথিত আছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বারান্দা দিয়ে হাঁটলেও প্রশাসন ক্যাডার অফিসাররা হিসাব করে কদম ফেলেন, যেন কোনো ভুল না হয়।
আজ মঙ্গলবার সেই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি কক্ষে অফিসারদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটেছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, জনপ্রশাসনের ইতিহাসের এমন ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি।
গত দুই দিনে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় দুই দফায় ৫৯টি জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগের তালিকা প্রকাশ করেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, তালিকায় আওয়ামী লীগ আমলে বঞ্চিত কর্মকর্তারা স্থান না পাওয়ায় এ ঘটনা ঘটে।
তারা আরও জানিয়েছেন, ডিসি নিয়োগ নিয়ে সচিবালয়ে তুলকালাম ঘটনার জন্ম দিয়েছেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা, যাদের নিয়ন্ত্রণকারী জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এই মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্বে রয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, মঙ্গলবার দুপুর দেড়টার দিকে বঞ্চিত দাবি করা উপসচিব মর্যাদার কর্মকর্তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব কে এম আলী আযমের রুমে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। মন্ত্রণালয়ের দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত এই রুম থেকে মাঠ প্রশাসনের (ডিসি-ইউএনও) নিয়োগ ও বদলি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এ সময় কয়েকজন কর্মকর্তাকে ধাক্কাধাক্কি করতে দেখা যায়। তবে এক নারী কর্মকর্তাসহ কয়েকজন ঘটনা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন।
এক পর্যায়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দ্বিতীয় তলায় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর বেশ কিছু সদস্যকে অবস্থান নিতে দেখা যায়। ধাক্কাধাক্কির ঘটনার ভিডিও করতে গেলে একটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তার মোবাইল নিয়ে নেন কর্মকর্তারা। সন্ধ্যার পরে তারা সেটি ফেরত দেন।
বিকেল ৪টা পর্যন্ত দ্বিতীয় তলায় অবস্থান করেন কর্মকর্তারা। এরপর একই ভবনের চতুর্থ তলায় মন্ত্রিপরিষদ সচিবের রুমের সামনে অবস্থান নেন ক্ষুব্ধ উপসচিবরা। বিকেল ৫টার দিকে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে কথা বলার পর সন্ধ্যায় সোয়া ৬টার দিকে রুম থেকে উপসচিবরা বেরিয়ে আসেন।
ডিসি হতে আগ্রহী ২৪ ব্যাচের এক কর্মকর্তা ডেইলি স্টারকে বলেন, আমরা ডিসি নিয়োগের প্রজ্ঞাপন বাতিলের দাবি জানিয়েছি। কেন বাতিল করতে হবে সেটাও তুলে ধরেছি। মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানিয়েছেন, আমাদের দাবি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্যারের কাছে তুলে ধরবেন। আমরা অপেক্ষায় রয়েছি।
ক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা যখন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেনের রুমের সামনে অবস্থান নেন, তখন সচিবসহ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দাপ্তরিক কাজে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে দেখা করতে আসেন এবং দেখা করতে না পেরে ফিরে যান। মন্ত্রিপরিষদ সচিব তার রুম থেকে সাড়ে ৭টার দিকে বের হয়ে যান।
অন্যদিকে জনপ্রশাসন সচিব মোখলেস উর রহমান দিনের বেশির ভাগ সময় তার রুমে অনুপস্থিত ছিলেন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে জনপ্রশাসন সচিব রুম থেকে বের হয়ে যান এবং আর দপ্তরে ফিরেননি।
সংক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা জানান, নিয়োগ পাওয়া ডিসিদের কয়েকজনের শেয়ারবাজারে মোটা অংকের বিনিয়োগ, সহকর্মীকে হেনস্তা, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা, সাবেক মন্ত্রীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল, এদের পদায়ন কোনোভাবেই মানা যায় না।
আরেক কর্মকর্তা বলেন, আওয়ামী লীগের সময় আমরা বঞ্চিত হয়েছি। আমরা নির্বাচনকে প্রভাবিত করব বলে আমাদের মাঠ প্রশাসনের পদায়ন করা হয়নি, ডিসি হতে পারিনি। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরেও আমরা পেলাম আরও বড় বঞ্চনা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, রাজশাহী জেলার ডিসি নিয়োগ পাওয়া মাহবুবুর রহমানের ফেসবুক প্রোফাইলে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছবি আছে। এমন একটি ছবি কর্মকর্তাদের মধ্যে ভাইরাল হওয়ার পর পরিস্থিতি গরম হতে শুরু করে, যা পরবর্তী সময়ে হাতাহাতি পর্যন্ত গড়ায়।
আরেক কর্মকর্তা জানান, কে এম আলী আজমের রুমে লম্বা দাড়ি ও পাগড়ি পরা একজনকে কয়েক দিন দেখেছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তার সঙ্গে আলী আযম দীর্ঘ সময় শলাপরামর্শ করেছেন, যখন অন্য কর্মকর্তাদের ঢোকার অনুমতি থাকতো না, এসব বিষয় ক্ষুব্ধ কর্মকর্তাদের কাছে রহস্যজনক মনে হয়েছে। তাদের ধারণা, বাইরের ওই লোকটির মাধ্যমে ডিসি নিয়োগে সুপারিশ এসেছে।
সাধারণ প্রশাসনিক কার্যক্রম, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং কালেক্টর হিসেবে ভূমি ব্যবস্থাপনা বিষয়গুলো তদারকি করেন জেলা প্রশাসক। এছাড়া নির্বাচিত সরকারের বিশেষ কর্মসূচি এবং চলমান উন্নয়ন কাজসহ সার্বিক বিষয়াদি দেখাশোনা করেন। সচিবের পর প্রশাসনের এ পদটি অন্যতম মর্যাদপূর্ণ পদ হিসেবে বিবেচিত হয়।
নিয়োগ পাওয়া ২৫ ডিসিকে ঢাকায় অবস্থানের নির্দেশ
দিনভর বিক্ষোভের পর সদ্য নিয়োগ পাওয়া ২৫টি জেলার প্রশাসককে ঢাকায় অবস্থানের নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
আজ বুধবার বিকেল পর্যন্ত তাদের ঢাকায় অবস্থান করতে বলা হয়েছে। এদিন দুপুরে তাদের স্ব স্ব জেলার উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করার কথা ছিল।
এদিন সকাল ৯টায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ডিসিদের অনুষ্ঠেয় বৈঠক স্থগিত করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
গত ২০ আগস্ট দেশের ২৫টি জেলার ডিসিকে একযোগে প্রত্যাহার করে সরকার। দুই সপ্তাহের বেশি সময় পর গত সোমবার সেসব জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি হয়।
অন্যদিকে গতকাল মঙ্গলবার ৩৪টি জেলার ডিসিকে প্রত্যাহার করে নতুন ডিসি নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে মোট ৫৯টি জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগে প্রজ্ঞাপন হয়েছে। এদের কেউই এখনো তাদের কর্মস্থলে যোগ দেননি।
ডিসিরা মাঠ প্রশাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট জেলা প্রশাসনের নেতৃত্ব দেন। এদের নিয়োগ, পদায়ন ও প্রত্যাহারের দায়িত্ব পালন করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। মাঠ প্রশাসন তদারকির দায়িত্ব মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের। নিয়ম অনুযায়ী, সদ্য নিয়োগকৃত ডিসিদের জেলায় যাওয়ার আগে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ আয়োজিত দিনব্যাপী ব্রিফিংয়ে অংশ নিতে হয়।
এ ধরনের ব্রিফিংয়ে ডিসিদের দায়-দায়িত্ব নিয়ে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা বিশেষ নির্দেশনা দেন।
সে অনুযায়ী, প্রথম দফায় নিয়োগকৃত ২৫টি জেলার ডিসিকে গতকাল মঙ্গলবার একদিনের ব্রিফিং দেওয়া হয়েছে। তবে আজ বুধবার তারা জেলার উদ্দেশে রওনা করতে পারবেন নাকি তালিকায় কোনো পরিবর্তন আসবে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
সূত্র জানায়, আজ সকাল ৯টায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সদ্য নিয়োগকৃত ৫৯ জেলার ডিসির সৌজন্য সাক্ষাতের তারিখ নির্ধারিত ছিল। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে ২৫ জেলার ডিসি তাদের পদায়নকৃত জেলায় যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করার কথা। অন্যদিকে ৩৪ জেলার ডিসি তাদের একদিনের ব্রিফিং নিয়ে বৃহস্পতিবার ঢাকা ছাড়ার তারিখ নির্ধারিত ছিল।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আজ সকালে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে অনুষ্ঠেয় বৈঠক বাতিল হলেও ৩৪ জেলার ডিসির ব্রিফিং অনুষ্ঠিত হবে। এরপর নিয়োগকৃত ডিসি তালিকায় পরিবর্তন আসলে সে অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
Comments