বন্যাদুর্গত জনপদে একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র যেভাবে পথিকৃৎ হয়ে উঠল
সপ্তাহখানেক আগেও এটি ছিল পাঠাগার, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, সংস্কৃতি স্কুল, আবৃত্তি সংসদ, নাট্য ও চলচ্চিত্র সংসদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সপ্তাহের ব্যবধানেই তা হয়ে উঠলো বন্যাদুর্গত ফেনীর মানবসেবার প্রাণকেন্দ্র। সপ্তাহ পূর্বে যে পাঠাগারের ভেতরে নীরবতা বজায় রাখতে টুঁ শব্দটিও করা বারণ ছিল, এক সপ্তাহের ব্যবধানেই সেখানেই এখন শত স্বেচ্ছাসেবীর ব্যস্ততার কোলাহলে কান পাতাই দায়।
বলছি ফেনীর নবীন চন্দ্র সেন সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কথা। সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটির অধীনে রয়েছে নবীন চন্দ্র সেন পাবলিক লাইব্রেরি, নবীনচন্দ্র সেন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, অগ্নিবীণা সাংস্কৃতিক স্কুল, নবীনচন্দ্র সেন পাঠচক্র, চক্রবাক, নজরুল ব্রিগেড, আদার আই ফিল্ম সোসাইটিসহ বেশ কয়েকটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান।
সবমিলিয়ে সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটিকে বলা হয় ফেনীর সংস্কৃতি চর্চার প্রাণকেন্দ্র। শহরের রাজাঝির দিঘির পূর্ব পাড়ে অবস্থিত এই সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটিই বন্যাদুর্গত ফেনীতে আবির্ভূত হয়েছিল অসহায় মানুষের রক্ষাকবচ হয়ে।
মঙ্গলবার রাতে সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটিতে গিয়ে দেখা যায়, এখনো সেখানে চলছে দুর্গত জনপদে ত্রাণ সংগ্রহ ও বিতরণের এক কর্ম মহাযজ্ঞের। রাত নেই, দিন নেই; এখনো শতাধিক স্বেচ্ছাসেবী বন্যার্ত মানুষের সাহায্যে এখানে দিন-রাত উজাড় করে কাজ করে চলেছেন।
কেউ বস্তা থেকে চাল-ডাল, তেল, পেঁয়াজসহ নানা খাদ্যসামগ্রী বের করে প্যাকেট করছেন। কেউ দাঁড়িপাল্লায় চাল-ডালের ওজন ঠিক করছেন। কেউ ত্রাণ পরদিন কোথায় যাবে সেই তালিকা করছেন, কেউ চিকিৎসা সহায়তার অংশ হিসেবে আসা কার্টন থেকে ওষুধ বের করে সাজাচ্ছেন। আবার কেউবা আজ থেকে চালু হওয়া জরুরি চিকিৎসা সেবার কেন্দ্র কীভাবে কাজ করবে তা নির্ধারণ করছে। সবমিলিয়ে সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটির সর্বত্রই এক কর্মযজ্ঞ চলছিল।
সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সংগঠকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত এক সপ্তাহে বন্যাদুর্গত এলাকায় নিজস্ব তহবিল থেকেই প্রায় তিন হাজারেরও বেশি বন্যার্ত পরিবারকে ত্রাণ সহায়তা দিয়েছে নবীনচন্দ্র সেন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ থেকে ফেনীতে আসা কয়েকশ শিক্ষার্থী ও স্বেচ্ছাসেবী এই সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সহযোগিতায় কয়েক হাজার দুর্গত পরিবারের কাছে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছে দিয়েছিলেন।
কীভাবে এই কর্মযজ্ঞের সূত্রপাত হলো, জানতে চাই নবীনচন্দ্র সেন সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের প্রধান সংগঠক জসীম উদ্দীনের কাছে। তিনি বলেন, 'মঙ্গলবার থেকে ফুলগাজী ও পরশুরামে বন্যা শুরু হয়। প্রথমে আমরা সেখানে সাহায্য করব বলে ঠিক করি। সেদিন রাতেই আমাদের নবীনচন্দ্র সেন ভলান্টিয়ার ফোরামে যে ৫০ জন স্বেচ্ছাসেবী ছিল, তাদের জানিয়ে দেই ভোর থেকেই আমরা কাজ শুরু করব। পরদিন সকালে দেখা গেল ফেনী শহরেও পানি উঠে গেছে। চারপাশ থেকে খবর আসতে লাগল। আমরা তৎক্ষণাৎ ফেনীর মহিপালের একটি মুড়ি ও চিড়া কারখানার সঙ্গে যোগাযোগ করি। কারণ বন্যা পরিস্থিতিতে শুকনো খাবারের বিকল্প নেই।
'আমাদের নিজস্ব তহবিল থেকে বিতরণের জন্য এক ট্রাক মুড়ি ও চিড়া কিনে ফেলি। আমাদের পূর্বানুমান ছিল যেহেতু পানির স্রোত বেড়েছে এবং বন্যা শুরু হয়ে গেছে, তাই বিশুদ্ধ পানির প্রবল সংকট হতে পারে। তৎক্ষণাৎ আমরা কয়েক হাজার লিটার বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করে রাখি। আবার বন্যার কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহও বন্ধ হয়ে যেতে পারে, তাই আমরা কয়েক হাজার মোমও কিনে ফেলি। সময়ের প্রয়োজনেই আমরা কাজটা শুরু করেছিলাম। কিন্তু এটি যে এত বৃহৎ পরিসরে করতে পারব, শুরুতে আমরা কেউই ভাবিনি।'
নবীনচন্দ্র সেন সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের একাধিক সংগঠকের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা বলেন, প্রথমে সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ হলেও একপর্যায়ে ফেনীর বাইরে থাকা পরিচিতজনদের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করেন তারা। পরবর্তীতে বন্যা পরিস্থিতির ক্রমশ অবনতি হলে সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের মাধ্যমে বৃহৎ পরিসরে কাজ শুরু হয়।
সংগঠনটির বেশ কয়েকজন সংস্কৃতিকর্মী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত থাকায় তারা নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগ করে তহবিল সংগ্রহ শুরু করেন। এ পর্যায়ে দেশের বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অসংখ্য শিক্ষার্থী নবীনচন্দ্র সেন সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের মাধ্যমে যোগাযোগ করে ফেনীতে এসে সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সহযোগিতায় বন্যাদুর্গত এলাকায় তারা ত্রাণ পৌঁছে দিয়েছিলেন।
দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আগত শিক্ষার্থী, স্বেচ্ছাসেবীদের কার্যক্রম চালানোর জন্য এবং রাতে থাকার জন্য সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের মিলনায়তন, লাইব্রেরি ও সংস্কৃতি স্কুল পুরোপুরি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল। বন্যাদুর্গত বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে আনার পর খাবারের জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছিল পৃথক স্থানেরও। যেখানে প্রতিদিন কয়েক শত মানুষ খাবার খেয়েছেন।
আজ থেকে নবীনচন্দ্র সেন সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে শুরু হয়েছে জরুরি চিকিৎসাসেবা। যেখানে তিনজন চিকিৎসক ক্রমান্বয়ে বন্যার্তদের মধ্যে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করবেন। এ বিষয়ে সাংস্কৃতিককর্মী রাজু আহমেদ বলেন, 'যেহেতু বন্যা অনেকটাই কেটেছে এবং পানিবাহিত রোগের প্রকোপ বেড়েছে, তাই আমরা চিকিৎসাসেবা চালু করেছি। কেবল বন্যা শেষ হওয়া পর্যন্তই নয়, বন্যা-পরবর্তী কার্যক্রমও আমরা চালিয়ে যাব। মানুষ পুনরায় স্বস্তিতে বাড়ি ফেরা পর্যন্ত আমাদের কার্যক্রম চলমান থাকবে।'
এত বিশাল পরিসরে কার্যক্রম চালানো কতটা কঠিন ছিল, জানতে চাইলে সংগঠক নয়ন পাশা বলেন, 'যেহেতু আমাদের সাংগঠনিক তৎপরতা সারা বছরব্যাপী থাকে, তাই আমাদের কাছে সাংগঠনিক প্রক্রিয়া সামলানো সহজ ছিল। আমাদের সঙ্গে যারা যোগাযোগ করে এসেছে, তারা বাদেও যারাই বন্যার্তদের সহযোগিতায় আমাদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছে, আমরা তাদেরকে আমাদের কার্যক্রমের অংশ করে নিয়েছি।'
রেলওয়ে টিকিট সহকারী সঞ্জয় কুমার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে এসেছিলেন পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেটের খোঁজে। স্বেচ্ছাসেবকেরা তাকে তিন পাতা ট্যাবলেট দেন। ট্যাবলেট পেয়ে তিনি বলেন, 'বেশ কয়েক জায়গায় খুঁজেছি। কোথাও না পেয়ে এখানে এসেছি। তারা এবার বন্যায় যেভাবে কাজ করেছে, তা অন্য কোথাও দেখিনি। বছরের অন্য সময় একটা গণ্ডির মধ্যে করে। কিন্তু এবার তাদের কাজগুলো দেখার মতো ছিল।'
সবসময় সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলো একটি নিজস্ব বলয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ফেনীর সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটি কী করে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করল, জানতে চাইলে জসীম উদ্দিন বলেন, 'মানুষ ছাড়া তো আর সাংস্কৃতিক কেন্দ্র চলতে পারে না। মানুষ বাদে এই যে পাঠাগার, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র যদি টিকে থাকে, তাহলে তো কোনো কাজই হবে না। সময়ের প্রয়োজনেই আমরা মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি। আমাদের নিজেদের জেলাই যখন আক্রান্ত, তখন আমরা তো কেবল সাংস্কৃতিক পরিচয় আর পাঠাগার রক্ষায় সীমাবদ্ধ থাকতে পারি না। শুরু থেকেই আমাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল যেকোনো মূল্যে মানুষকে রক্ষা করা। মানুষ যদি ভালো থাকে, তারপর না হয় সংস্কৃতির বিষয়টিই আসবে। আমাদের কেন্দ্রের চেতনা ও আদর্শ মানুষের জন্যই।'
'একটি বিষয় আমাকে বলতেই হয়, বন্যা পরিস্থিতিতে ফেনীতে স্বেচ্ছাসেবকদের যে বিষয়টি আমাকে ভীষণ মুগ্ধ করেছে তা হলো সবার আন্তরিকতা ও সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব। একটা উদাহরণ দিই। আমাদের এখানে বন্যাদুর্গতদের জন্য ত্রাণ নিয়ে ট্রাক এসেছে। চারজনকে বললাম ত্রাণগুলো নামাতে হবে। দেখা গেছে সেখানে ছয়জন গিয়ে জিনিসপত্র নামাচ্ছে। এই যে সবাই স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসেছে, এটি আমাকে ও আমাদেরকে ভীষণ অনুপ্রাণিত করেছে', যোগ করেন তিনি।
Comments