ঢাকার বাড়িঘরে ডাকাতি: প্রতিরোধে শিক্ষার্থী ও স্থানীয়রা

সন্ত্রাসীদের মোকাবিলায় মধ্যরাতে মসজিদের মাইক থেকে এলাকার বাসিন্দাদের রাস্তায় নেমে আসার কথা বলা হচ্ছে
ঘরবাড়িতে ডাকাতি ও লুট থেকে রক্ষায় রাতজেগে পাহারা দিচ্ছেন এলাকাবাসী ও শিক্ষার্থীরা। ছবি: সাব্বির আহমেদ/ ফেসবুক থেকে নেওয়া

গত দুইদিন ধরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনুপস্থিতিতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরসহ অনেক এলাকায় ঘরবাড়িতে দুর্বৃত্তদের ডাকাতি ও লুটপাটের ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে মানুষ।

একই ঘটনা ঘটছে দেশের অন্যান্য অনেক এলাকাতেও।

মঙ্গলবার রাত থেকে গতকাল ভোর পর্যন্ত ডাকাতি আর লুটপাট আতঙ্কে মোহাম্মদপুরে অনেক পরিবার রাত জেগে কাটিয়েছেন।

সন্ত্রাসীদের মোকাবিলায় মধ্যরাতে মসজিদের মাইক থেকে এলাকার বাসিন্দাদের রাস্তায় নেমে আসতে বলেন স্থানীয়রা।

অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাহায্য চান। তাৎক্ষণিকভাবে এতে সাড়া দিয়ে শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন ও মোড়ে মোড়ে পাহাড়া দেন।

মোহাম্মদপুরের নবোদয় হাউজিং, মোহাম্মদিয়া হাউজিং, চান মিয়া হাউজিং, চাঁদ উদ্যান, ঢাকা উদ্যান ও চন্দ্রিমা হাউজিং এলাকায় ডাকাতির আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

খবর পেয়ে সেনাবাহিনীর একটি দল নবোদয় হাউজিং ও বাঁশবাড়ি এলাকায় টহল দেয়।

এসময় মোহাম্মদপুরের বাঁশবাড়িতে একটি ট্রাকে থাকা একদল লোককে আটক করা হয়। তবে তারা নিজেদের বালু শ্রমিক হিসেবে দাবি করে এবং পরে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।

নবোদয় হাউজিং এলাকার একজন বাসিন্দা বলেন, 'গতকাল রাতে একদল লোক দেশীয় অস্ত্র নিয়ে পাশের একটি বাড়িতে হামলা চালায়। তারা জোর করে বাড়ির মেইন গেইট খুলে ফেলে এবং বাড়িতে থাকা নগদ টাকা ও গয়না লুট করে নিয়ে যায়।'

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই এলাকার এক বাড়ির মালিক দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, এলাকারই বাসিন্দা সিরাজের ছেলে আলমগীর বাড়ির দরজায় এসে ধাক্কা দেয়।

'গেইট খুললে তারা (আলমগীর ও তার সাথে থাকা অন্যরা) আমার গলায় ধারালো চাপাতি ধরে ও পাঁচ লাখ টাকা দাবি করে।'

এসময় তারা তাকে মারধর করে বলেও জানান বাড়ির মালিক।

এক পর্যায়ে হামলাকারীরা সৌদি রিয়ালসহ নগদ ২ লাখ টাকা নিয়ে চলে যায়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ডাকাতির পর আলমগীর ও বাকিরা মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায়।

বাঁশবাড়ির একটি বাড়ির নিরাপত্তারক্ষী ইমরান হোসেন বলেন, কয়েকজন যুবক একটি ট্রাকে করে আশেপাশের এলাকা ঘুরে বেড়াচ্ছিল, আর কয়েকজন ছিল মোটরসাইকেলে।

এদিকে, মোহাম্মদপুর ও শ্যামলী এলাকায় স্থানীয়রা, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই শিক্ষার্থী, তাদের নিজ নিজ এলাকায় সতর্কতার জন্য দল গঠন করেছে।

গতকাল রাতে শ্যামলী হাউজিং এলাকায় গিয়ে দেখা যায় একদল বাসিন্দা প্রতিবেশীদের একত্রিত হয়ে দুর্বৃত্তদের মোকাবিলার জন্য উৎসাহিত করছিলেন। কোনো ধরনের হুমকি দেখলেই অন্যদের সতর্ক করছিলেন।

মোহাম্মদপুর ছাড়াও রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, বাড্ডা, রামপুরা, ভাটারাসহ রাজধানীর অন্যান্য এলাকা থেকেও এ ধরনের ডাকাতির খবর জানা গেছে।

রায়েরবাজারের হাসেম খান রোডের বাসিন্দা এবং পেশায় ব্যবসায়ী মাহবুবুর রহমান জানান, কাজের খাতিরেই তাকে অনেক রাত পর্যন্ত বাসার বাইরে থাকতে হয়। কিন্তু চলমান পরিস্থিতির কারণে তাদের বাড়ির মালিক সবাইকে রাত ১০টার মধ্যে বাসায় ফেরার কথা জানিয়ে দিয়েছেন।

তিনি বলেন, 'রাত ১১টা-১২টার দিকে রাস্তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর না থাকার সুযোগে এলাকায় অনেকগুলো দল ডাকাতি ও লুটপাটের জন্য ঘোরাফেরা করে। গত দুই দিন ধরে এমন চলছে। সাহায্যের জন্য আমরা কার কাছে যাব?'

দোকানপাট ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে বলেও খবর পাওয়া গেছে। দ্রুত থানাগুলো চালু না হলে এ ধরনের ঘটনা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।

পুলিশ স্টেশনগুলো ফাঁকা ও থানা থেকে অস্ত্র, গোলাবারুদ লুট হওয়ায় ঢাকাসহ অন্যান্য এলাকায় চরম নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করছে।

মোহাম্মদপুরের জাফরাবাদের বাসিন্দা ইন্দ্রজিৎ বড়ুয়া গতকাল রাতে ডেইলি স্টারকে জানান, রাত ১০টার দিকে ধারালো অস্ত্রে সজ্জিত অন্তত ১৫ কিশোরের একটি দল ইত্যাদি মোড়ে তার পাশের বাড়িতে হামলা চালায়।

এসময় আমরা অনেকের চিৎকার শুনতে পাই। আমরা অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ঘরের লাইট নিভিয়ে দিয়ে আমরা ভয়ে বাড়ি থেকে বের হতে পারিনি।  

পরে সেনাবাহিনীর একটি দল এসে হামলাকারীদের কয়েকজনকে আটক করে বলে জানান তিনি।

মঙ্গলাবারের মতো গতকাল রাত ১১টার দিকে মোহাম্মদপুরের স্থানীয়রা মসজিদের মাইকের মাধ্যমে বাসিন্দাদের সম্ভাব্য হামলার বিষয়ে সতর্ক করতে শুরু করেন। একইভাবে গত রাতে ধানমন্ডি, উত্তরা, শেখেরটেক ও আদাবরেও সতর্ক থাকার কথা জানানো হয়।

ধানমন্ডি ১৩/এ রোডের বাসিন্দা অভিনেতা মাসুম বাশার বলেন, 'পাশের তাকওয়া মসজিদ থেকে প্রায় ১০০ জন মানুষ জড়ো হয়। তারা ধানমন্ডির বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে নিরাপত্তা দেওয়ার চেষ্টা করেন।'

আজ ভোর ১টার দিকে রাজধানীর বসিলার আরশিনগরের বাসিন্দা মাহমুদা দীপা ডেইলি স্টারকে বলেন, সম্ভাব্য হামলার বিষয়ে গত সন্ধ্যায় একটি ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। 'রাত ১১টার দিকে স্থানীয়রা হামলার খবর দিলে রাত ১২টা ৫০ মিনিটের দিকে আশপাশের সব ভবনের বাসিন্দারা জড়ো হয়ে দুর্বৃত্তদের ধাওয়া দেয়।'

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ওই এলাকা থেকে ধারালো অস্ত্রসহ একজনকে আটক করেছে সেনাবাহিনী।

মিরপুরের ইসিবি চত্বরে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাত ১১টা ৪৫ মিনিটের দিকে ধারালো অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে শতাধিক লোকের একটি দল সেখানে আসে। এ সময় স্থানীয়রা সেনাবাহিনীকে ফোন কর। তারা হামলাকারী কয়েকজনকে আটক করে। এ সময় গুলির শব্দ শোনা যায়।

সোমবার শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে সহিংস জনতার হামলায় অনেক থানা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।

আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মধ্যে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে গতকাল জরুরি প্রয়োজনে নিকটস্থ সেনা ক্যাম্পে যোগাযোগের জন্য নাগরিকদের অনুরোধ জানানো হয়েছে।

এতে বলা হয় জনসাধারণ, সম্পত্তি ও গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনী মোতায়েন থাকবে।

তবে জনগণকে মিথ্যা তথ্য ও গুজব দিয়ে সেনাবাহিনীকে বিভ্রান্ত করা থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।

আইএসপিআরের পক্ষ থেকে নির্ধারিত কিছু মোবাইল ফোন নম্বরও দেওয়া হয়েছে

Comments