তালগাছপ্রেমী চিত্তরঞ্জন দাস

যতদিন বাঁচবেন, নিজের শখের এই কাজ চালিয়ে যাবেন বলেই জানালেন তিনি।
চিত্তরঞ্জন দাস। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরে যখন অনেকেই ঘরে বসে বিশ্রাম নেন কিংবা নিরাপদে কোথাও অবস্থান করেন, তখন রাস্তার পাশে গাছ লাগাতে বা গাছের পরিচর্যা করতে দেখা যায় চিত্তরঞ্জন দাসকে (৬৭)। শুধু গ্রীষ্মই নয়, ঘোর বর্ষা কিংবা তীব্র শীতেও একই কাজ করেন তিনি।

দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে এভাবেই তালগাছ লাগাচ্ছেন চিত্তরঞ্জন। প্রায় প্রতিদিনই তিনি প্রয়োজনীয় সরঞ্জামসহ সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন।

তালগাছপ্রেমী চিত্তরঞ্জনের বাড়ি যশোরের অভয়নগর উপজেলার ধোপাদী গ্রামের দক্ষিণপাড়ায়। নিজকাজের কারণে এখন স্থানীয়দের কাছে পরিচিত ব্যক্তি তিনি। অনেকের কাছে অনুপ্রেরণারও।

যশোরের অভয়নগর ও মণিরামপুর উপজেলাসহ নওয়াপাড়া পৌরসভা এলাকার অন্তত ৪২টি ছোট-বড় সড়কের দুই ধারে ১৬ বছরে দুই লাখ ৮৮ হাজার তালের বীজ বুনেছেন চিত্তরঞ্জন। একইসঙ্গে এসব সড়কে খেজুর গাছেরও প্রায় ৫৬ হাজার বীজ বপন করেছেন তিনি।

চিত্তরঞ্জন দাস দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তালগাছের ছায়ায় বসে মানুষ বিশ্রাম নেয়, গল্প করে, কৃষকরা ভাত খায় বা ঝড় বৃষ্টির সময় পথচারীরা আশ্রয় নেয়—এসব দেখে আমার খুব ভালো লাগে। তালগাছ ছিল না বলে এত বছর ধরে এলাকায় বাবুই পাখির খুব একটা দেখা মিলত না। এখন সেই পাখিরা আবার ফিরছে। ওদের দেখে মন ভরে যায়।'

চিত্তরঞ্জন দাস। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

শুধু বীজ বপনই নয়, নিয়মিত এগুলোর পরিচর্যাও করেন তিনি। প্রায়ই সকালে বিভিন্ন গ্রামের উদ্দেশে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন সাইকেলে। সঙ্গে থাকে কোদাল, পানির বোতল ও দা। চারার নিচে আগাছা হলে তুলে ফেলেন। বৃষ্টিতে গোঁড়া থেকে মাটি সরে গেলে জমি থেকে মাটি নিয়ে তা ভরে দেন। গ্রামবাসীদের তালগাছ রক্ষায় উদ্বুদ্ধ করেন।

আবার নানা কারণে তার লাগানো কয়েক হাজার গাছ নষ্টও হয়ে গেছে। ২০১৬ সালে ভবদহ এলাকার জলাবদ্ধতার কারণে অনেক গাছ মারা গেছে। কিছু গাছ স্থানীয়রা নষ্ট করেছেন। আবার অনেক গাছ উপড়ে ফেলা হয়েছে রাস্তা সংস্কারের সময়। আবার প্রতিনিয়ত হাতপাখা ব্যবসায়ীরা ছোট ছোট গাছের পাতা কেটে নিয়ে যান। এভাবে অনেক চারা নষ্ট হয়েছে। তারপরও হতাশ নন চিত্তরঞ্জন। তিনি তার শখের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

২০০৮ সালের দিকে লাগানো তালগাছগুলো এখন অনেক বড় হয়েছে। সেগুলোতে ফল ধরেছে। নানান প্রজাতির পাখি, বিশেষ করে বাবুই এসে বাসা বেঁধেছে। গ্রামবাসীদের অনেকে এখন কাঁচা তাল পেড়ে খায়। তাল পাকলে অনেকে তা সংগ্রহ করে বাড়ি নিয়ে যায়। এগুলো দেখে চিত্তরঞ্জনের মন ভালো হয়ে যায়।

নানা উপায়ে এই বিপুল সংখ্যক তালবীজ সংগ্রহ করেছেন তিনি। কোথাও এর খোঁজ পেলে চিত্তরঞ্জন ছুটে যান সেখানে। যশোরের ভবদহ অঞ্চলের ৫০টি গ্রাম থেকে তালবীজ সংগ্রহ করেন তিনি। কেউ বিক্রি করেন আবার বিনা পয়সায় কেউ বীজ দিলে খুশি মনে তা নেন। বর্ষায় বাড়ি বাড়ি ঘুরে এমনকি আবর্জনার স্তূপ থেকেও তালবীজ সংগ্রহ করেন তিনি। একেকটা বীজ কিনতে সব মিলিয়ে চার টাকার মতো খরচ হয় তার। নিজের আয়ের একটা অংশ খরচ করেন এর পেছনে। অনেক ব্যক্তি তাকে তাল-বীজ কিনতে সহায়তা করেন। প্রথম দিকে চিত্তরঞ্জনের পরিবারের লোকজন তার ওপর বিরক্ত হতেন। এখন তারাও সহযোগিতা করছেন।

অবশ্য প্রথম দিকে গ্রামের অনেকে ভালোভাবে নেয়নি চিত্তরঞ্জনের এই কাজ। তবে এখন তাদের অনেকের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছে।

তবে এত গাছ থাকতে তালগাছ লাগানো কেন শুরু করলেন, জানতে চাইলে চিত্তরঞ্জন ডেইলি স্টারকে জানান, ২০০৮ সালের কোনো এক বর্ষায় তিনি চায়ের দোকানে বসে বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করছিলেন। পাশেই দেখলেন এক ভদ্রলোক পত্রিকা পড়ছেন। চিত্তরঞ্জন নিজে পড়ালেখা না জানলেও পত্রিকায় তালগাছের ছবি দেখে কৌতূহলী হন। পরে সেই ভদ্রলোক চিত্তরঞ্জনকে বললেন, 'দেখেন আমেরিকার এক বিজ্ঞানী বলেছেন, তালগাছের অনেক গুণ। সবচেয়ে বড় কথা মাথা উঁচু এ গাছটি বজ্রপাতকে দুর্বল করে দেয়।' তালগাছ নিয়ে বিজ্ঞানীর কথাটা খুব মনে ধরেছিল চিত্তরঞ্জনের। শুনেই মনে হয়েছিল, প্রায়ই তো আশপাশের গ্রামে বাজ (বজ্রপাত) পড়ে মানুষ মরে। মাঠে-ঘাটে আরও তালগাছ থাকলে নিশ্চয়ই এটা হতো না।

তারপর থেকে শুরু করলেন তার বাবার লাগানো গাছ পরিচর্যার কাজ। এরপর তালবীজের খোঁজে আশপাশের গ্রামে ঢু মারলেন। কয়েকদিনের মধ্যে হাজারখানেক বীজ সংগ্রহ করে তা লাগিয়ে দিলেন অভয়নগরের প্রায় দুই কিলোমিটার দীর্ঘ ধোপাদী-মশিয়াহাটী সড়কের দুই ধারে। এভাবে প্রথম বছর প্রায় আড়াই হাজার বীজ লাগিয়েছিলেন তিনি।

চিত্তরঞ্জন দাস। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

এখন যশোরের সীমানা পেরিয়ে দেশের অন্যান্য জেলায় এই কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে দিচ্ছেন চিত্তরঞ্জন। গত বছর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা ও পিরোজপুরের কাউখালীতে ১০ হাজার তালবীজ লাগিয়েছিলেন। কাজে সন্তুষ্ট হয়ে সে সময় তাকে দুই জায়গা থেকে ২০ হাজার করে মোট ৪০ হাজার টাকা পেয়েছিলেন। এমন পুরস্কার পেয়ে খুশি চিত্তরঞ্জন। সেটাই ছিল তার জীবনে পাওয়া প্রথম পুরস্কার। ওই পুরস্কারের টাকার অর্ধেক খরচ হয়েছিল। বাকি টাকার সঙ্গে নিজের ৩০ হাজার মিলিয়ে এবার মোট ৫০ হাজার টাকার তালগাছের মাথা (গাছের তাল আর পাতা) কিনেছেন। এ বছর আরও ২০ হাজার টাকার বীজ কিনবেন বলে জানালেন।

তিন ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে চিত্তরঞ্জনের সংসার। বৃক্ষপ্রেমী মানুষ হলেও কৃষিকাজে জীবিকার পুরো ব্যবস্থা না হওয়ায় বাড়তি আয়ের জন্য চিত্তরঞ্জন মাঝেমধ্যে গাছ কিনে চেরাই করে বিক্রি করেন। অভাব-অনটনের মধ্যেও নিজের লক্ষ্যের দিকে তিনি এগিয়ে চলেছেন।

অভয়নগরের সুন্দলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিকাশ রায় কপিল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ যুগে তার মতো সাদা মনের মানুষ বিরল। উপজেলার অন্যান্য ইউনিয়নে তার রোপণ করা অসংখ্য তালগাছ এখন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। অভাবে থাকা এই মানুষটা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ভালো হতো।'

যতদিন বাঁচবেন, নিজের শখের এই কাজ চালিয়ে যাবেন বলেই জানালেন চিত্তরঞ্জন দাস।

Comments

The Daily Star  | English
Pro-Awami League journalist couple arrested

The indiscriminate arrests and murder charges

Reckless and unsubstantiated use of murder charges will only make a farce of the law, not bring justice to those who deserve it.

14h ago