সফলতার সঙ্গে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছি: মেয়র তাপস

‘যে সংস্থা একসময় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দিতে হিমশিম খেতো সে সংস্থা আজ স্বয়ংসম্পূর্ণ, আত্মনির্ভরশীল ও মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছে।’
শেখ ফজলে নূর তাপস। ফাইল ফটো

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র হিসেবে চার বছরের দায়িত্বে সফলতার সঙ্গে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ, বর্জ্য অপসারণ ও জলাবদ্ধতা নিরসনের পাশাপাশি সিটি কর্পোরেশনে সুশাসন নিশ্চিত করেছেন বলে জানিয়েছেন শেখ ফজলে নূর তাপস।

আজ রোববার ডিএসসিসিতে মেয়রের দায়িত্বভার গ্রহণের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত 'উন্নত ঢাকার উন্নয়ন অগ্রযাত্রার ৪ বছর' শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি।

মেয়র বলেন, 'বৈশ্বিক করোনা মহামারির সংকটকালে আমি দায়িত্বভার গ্রহণ করি। তথাপি করোনা মহামারির মাঝেই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করতে প্রায় সকল খাতেই আমরা আমূল পরিবর্তন আনতে সচেষ্ট হই। একটি উন্নত, বাসযোগ্য ঢাকা বিনির্মাণে বিগত চার বছরে করপোরেশনের বিভিন্ন খাতে বিদ্যমান অনিয়ম-দুর্নীতি দূর করে সুশাসন নিশ্চিত, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন সাধন, আদি বুড়িগঙ্গা চ্যানেলসহ মান্ডা, শ্যামপুর, জিরানি ও কালুনগর খাল পুনরুদ্ধার ও নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টিতে উদ্যোগ গ্রহণ, বছরব্যাপী সমন্বিত মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন, ঢাকার সচলতা আনয়নে বহুমাত্রিক উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, দশকের পর দশক ধরে চলা দখল সাম্রাজ্যের অবসান ঘটানো, প্রতিটি ওয়ার্ডে খেলার মাঠ-উদ্যান-কাঁচাবাজার, গণশৌচাগার প্রতিষ্ঠা, জলাবদ্ধতা নিরসনে কার্যকর ও বাস্তবভিত্তিক কার্যক্রম বাস্তবায়ন এবং সর্বোপরি ঢাকার ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে ঢাকাকে বিশ্বের বুকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে নানাবিধ কর্মকাণ্ড পরিচালন ও বাস্তবায়ন করা হয়েছে এবং তা অব্যাহতভাবে চলমান রয়েছে।'  

মেয়র বলেন, 'দায়িত্বভার গ্রহণের পর মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম ঢেলে সাজাতে আমরা সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দেই। সে লক্ষ্য বাস্তবায়নে ২০২০ সালের ৬ জুন আমরা বছরব্যাপী সমন্বিত মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম শুরু করি। বর্তমানে সূচি অনুযায়ী সারাবছরই আমরা এই কার্যক্রম পরিচালনা করে চলেছি।' 

'শুধু তাই নয়, মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বেগবান করতে আমরা নতুন মশককর্মী নিয়োগ দিয়েছি। পূর্বে ৪২৪ জন মশককর্মী এই কার্যক্রম পরিচালনা করতো। বর্তমানে এক হাজার ৫০ মশককর্মী ও মশক সুপারভাইজার নিয়মিতভাবে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। একইসঙ্গে আমরা প্রয়োজনীয় যান-যন্ত্রপাতিও বৃদ্ধি করেছি।'

তিনি বলেন, 'আমার দায়িত্বভার গ্রহণের পূর্বে ৫৫১টি ফগার মেশিন, ৪৩১টি হস্তচালিত মেশিন ও ১৭টি হুইলব্যারো মেশিন দিয়ে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হতো। গত চার বছরে আমরা নতুন আরও ৫৩৫টি ফগার মেশিন, ৬০০টি হস্তচালিত মেশিন ও ২৯টি হুইলব্যারো মেশিন ক্রয় করেছি।'
 
'এ ছাড়াও, বার্ষিক কর্মপরিকল্পনার আলোকে সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজনদের সঙ্গে নিয়মিত মতবিনিময়, করপোরেশনের আওতাধীন এলাকার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (এক হাজার ৮৬টি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসা), মসজিদ-মন্দির, থানা ও পুলিশ ফাঁড়িসহ সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে বিশেষ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও মশক নিয়ন্ত্রণ অভিযান পরিচালনা, কোনো ওয়ার্ডে সপ্তাহে ১০ জনের বেশি ডেঙ্গু রোগী সনাক্ত হলে সে ওয়ার্ডকে লাল চিহ্নিত এলাকা (রেড জোন) ঘোষণা করে চিরুনি অভিযান পরিচালনা, কর্পোরেশনের ১০টি অঞ্চলেই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছে।'
  
তাপস বলেন, 'একটি বিষয় সকলের কাছে পরিষ্কার করতে চাই। আমাদের কাছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ডেঙ্গু রোগীর প্রাত্যহিক যে তথ্য সরবরাহ করা হয়, করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগের তত্ত্বাবধানে আমাদের সম্মানিত কাউন্সিলরবৃন্দ, আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাগণ ও মশকর্মীরা সে ঠিকানা পরিদর্শন করে এবং ডেঙ্গু রোগীর বাসস্থল ও চারপাশের ৩০০ গজ এলাকায় বিশেষ চিরুনি অভিযান পরিচালনা করে থাকে।' 

'কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে সরবরাহকৃত তথ্যে নানাবিধ অসংগতি থাকে। ফলে এডিস মশার প্রজননস্থল নিধন কার্যক্রমে আমাদের সময়ক্ষেপণ হয় এবং প্রকৃত রোগী খুঁজে বের করতে আমাদের বেশ বেগ পেতে হয়। তারপরও আমাদের গভীর তদারকির ফলে আমরা সকল রোগীর বাসাবাড়ি পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম সম্পাদন করে থাকি। এমন একজন রোগীও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যার বাসাবাড়িতে আমরা যাইনি এবং এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করা হয়নি', বলেন তিনি।  

মেয়র বলেন, 'এভাবে যাচাই-বাছাই শেষে গত বছরের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত আমরা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় নয় হাজার ৭৬৪ জন ডেঙ্গু রোগী পেয়েছি (তখন সারাদেশে রোগী ছিল দুই লাখ ৭১ হাজার ১৭৫ জন), যা সারাদেশের মোট রোগীর মাত্র ৩ দশমিক ৬০ শতাংশ। ফলে সফলতার সঙ্গে আমরা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছি।' 

তিনি বলেন, 'দায়িত্বভার গ্রহণের প্রথম দিন হতেই করপোরেশনের সকল স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গাফিলতি, অনিয়ম, দুর্নীতি দূর করার মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আমি শূন্য সহনশীলতা নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে চলেছি। প্রশাসনিক সংস্কারের আওতায় এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। দায়িত্ব পালনে অবহেলা, গাফিলতি ও দুর্নীতির দায়ে গত চার বছরে বিভিন্ন স্তরের ৩৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। একইসঙ্গে করপোরেশনের প্রাত্যহিক কার্যক্রম সম্পাদনে জনবলের যে তীব্র সংকট ছিল তা উত্তরণে গত চার বছরে ভারী গাড়ির ১৪৩ জন চালক, ৬৬ জন উপ-সহকারী প্রকৌশলী, ৭৭ জন হিসাব সহকারী, ২৭ জন রেভিনিউ সুপারভাইজার, ৩১ জন পরিচ্ছন্ন পরিদর্শক, ২০ জন স্প্রে-ম্যান সুপারভাইজারসহ বিভিন্ন বিভাগে সর্বমোট ৮৭৯ জন জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এবং ২১৭ জনের নিয়োগ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।' 

তাপস বলেন, 'কয়েকটি ব্যতিক্রম বাদে গত তিন দশকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। অতিরিক্ত দায়িত্ব, চলতি দায়িত্ব দিয়ে করপোরেশনের প্রাত্যহিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হতো। এমন অনেকেই আছেন, যারা চাকরিতে যে পদে যোগদান করেছিলেন সে পদ হতেই পিআরএলে গেছেন। আমরা যোগ্যতার যথাযথ মূল্যায়ন করতে চাই। সেজন্য এই পদোন্নতি জট খুলে গত চার বছরে আমরা ১৫৭ জন যোগ্য প্রার্থীকে পদোন্নতি দিয়েছি। ফলে যেমন সুশাসন নিশ্চিত করা হয়েছে, তেমনি মাঠ পর্যায়সহ করপোরেশনের সকল স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে কর্মোদ্যম সঞ্চারিত হয়েছে বিধায় দুর্নীতি কমেছে এবং রাজস্ব আয় বেড়েছে।'  

তিনি বলেন, 'মেয়র নির্বাচনের প্রাক্কালে আমি ঢাকাবাসীর ওপর কোনো রকমের করের বোঝা না চাপিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেছিলাম। সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী গত চার বছরে আমরা কোনো খাতে কোনো কর বৃদ্ধি করিনি। বরং এ সময়ে ২৫টি নতুন খাত সৃষ্টি করা হয়েছে এবং ১৪টি নতুন খাত হতে আমরা রাজস্ব আদায় শুরু করেছি। ফলে করোনা মহামারির মতো বৈশ্বিক সংকটের মাঝেও রাজস্ব আদায়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ইতিহাস সৃষ্টি করে চলেছে, যা আজ পর্যন্ত অগ্রসরমান। ২০১৯-২০ অর্থবছরে করপোরেশনের রাজস্ব আদায় ছিল মাত্র ৫১৩ কোটি ৯৬ লাখ টাকা, যা ২০২০-২১, ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে যথাক্রমে ৭০৩ কোটি ৩১ লাখ, ৮৭৯ কোটি ৬৫ লাখ ও এক হাজার ৩১ কোটি ৯৭ লাখ টাকায় উন্নীত হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত যে রাজস্ব আদায় হয়েছে তা আগের অর্থবছরের তুলনায় ৫৪ কোটি টাকা বেশি। ফলে চলমান অর্থবছরে আমরা পূর্বেকার মাইলফলক অতিক্রম করতে পারব বলে আশাবাদী।' 

মেয়র বলেন, 'ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এক সময় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাদি ও তাদের জিপিএফ-সিপিএফের লভ্যাংশ, ঠিকাদারদের বকেয়া, ডিপিডিসি-ওয়াসা-তিতাস গ্যাসসহ সেবা সংস্থাগুলোর বকেয়া পাওনা দীর্ঘদিন পরিশোধ করতে পারেনি। সুশাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমে সকলের সহযোগিতায় এবং আমাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্তরিক ও দায়িত্বশীল ভূমিকার ফলে আমরা পূর্বেকার প্রায় সকল বকেয়াসহ প্রাত্যহিক পাওনা পরিশোধ করেছি। একইসঙ্গে করপোরেশনের প্রায় সকল গাড়ির নিবন্ধন করেছি। দীর্ঘ ৫০ বছরের ভূমি উন্নয়ন করসহ অন্যান্য পুঞ্জীভূত বকেয়া পাওনাদিও আমরা পরিশোধ করেছি।' 

তিনি বলেন, 'পূর্বে সকল উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য কর্পোরেশনকে প্রকল্প নির্ভর থাকতে হতো। কিন্তু রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে ঢাকাবাসীর কল্যাণে অনেক উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য আমাদের এখন আর প্রকল্প নির্ভর থাকতে হয় না। গত চার বছরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নিজস্ব অর্থায়নে এক হাজার ২০০ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে নানাবিধ অবকাঠামো নির্মাণ, উন্নয়ন ও সংস্কার করেছে।' 

তাপস বলেন, 'আমরা নিজস্ব অর্থায়নে ২০২০-২১ সালে ১২১ কোটি ৮৫ লাখ, ২০২১-২২ সালে ৩০৯ কোটি ৪৪ লাখ, ২০২২-২৩ সালে ৩৯০ কোটি ১৬ লাখ এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪০০ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে অন্তর্বর্তীকালীন বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্র, খাল-নর্দমা-বক্স কালভার্ট হতে বর্জ্য অপসারণ, সড়ক, জলাবদ্ধতা নিরসনে অবকাঠামো, সামাজিক অনুষ্ঠান কেন্দ্র, গণশৌচাগার ইত্যাদি অনেক উদ্যোগ ও অবকাঠামো নির্মাণ, উন্নয়ন ও সংস্কার করেছি।' 

তিনি বলেন, 'রাস্তা-মার্কেটের দোকান, অলি-গলি, কাঁচাবাজার, পথচারীদের হাঁটার পথ, নর্দমা এমনকি নদী-নালায়ও ভূমিদস্যুরা পাকাপোক্ত আস্থানা গেড়ে বসেছিল। দখলদারিত্ব যেন নিয়মে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু অবৈধ দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে শুরু থেকেই আমরা কঠোরতা দেখিয়ে চলেছি এবং দখলদারদের বিরুদ্ধে আমাদের অনমনীয় মনোভাব আগামী দিনেও অব্যাহত থাকবে। আমরা যেমন দীর্ঘদিন ধরে অনিয়মের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হওয়া ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট, সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেট, গুলিস্তান ট্রেড সেন্টারের বেইজমেন্ট, নিউ সুপার মার্কেটসহ অনেকগুলো মার্কেটের নকশা বহির্ভূত দোকান নির্মাণকারী অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করেছি, তেমনি দখলমুক্ত করা হয়েছে বুড়িগঙ্গা আদি চ্যানেল ঘিরে গড়ে ওঠা ১৫৫টি স্থাপনা। আমরা আদি বুড়িগঙ্গা চ্যানেলে অবৈধভাবে গড়ে তোলা ১০তলা ভবন, পান্না ব্যাটারি ও ম্যাটাডোর বলপেনের অবৈধ বর্ধিতাংশসহ কয়েক ডজন অবৈধ বহুতল ভবন ও স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিয়েছি।'
 
মেয়র বলেন, 'দখলমুক্তির ধারাবাহিকতায় আমরা দীর্ঘ এক শতাব্দী পর নলগোলা ভাওয়াল রাজবাড়ি (রাজকুঠি), ৮০ বছর পর সূত্রাপুরের মাইশা খাল, তিন দশক পর রায় সাহেব বাজার মোড়, দুই যুগ পর লক্ষ্মীবাজারে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পার্কিংয়ের জায়গা, চার দশক পর ধলপুর ক্লিনার কলোনি হতে অবৈধ দখলদারিত্বের অবসান ঘটিয়েছি। ফলে গত চার বছরে শতাধিক উচ্ছেদ অভিযানের মাধ্যমে ৫৭ দশমিক ৭২৪ একর ভূমি উদ্ধার করেছি, যার আনুমানিক বাজার মূল্য চার হাজার ৯৮৩ কোটি টাকার অধিক।' 
 
তিনি বলেন, 'সামষ্টিকভাবে বলতে পারি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের অটল, অদম্য ও অনমনীয় কর্মোদ্যোগের ফলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে সুশাসন নিশ্চিত হয়েছে। পাশাপাশি ঢাকাবাসীর আস্থা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে যে সংস্থা একসময় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দিতে হিমশিম খেতো সে সংস্থা আজ স্বয়ংসম্পূর্ণ, আত্মনির্ভরশীল ও মর্যাদাপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছে।'

তাপস বলেন, 'ঢাকা মহানগরীর অভ্যন্তর ও চারপাশ ঘিরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক খালের সম্মিলনে চমৎকার এক অন্তর্জাল বিদ্যমান ছিল। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর অবহেলা, উদাসীনতা ও ভূমিদস্যুদের কালো থাবায় সেসব খাল যেন বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছিল। সে অবস্থা হতে উত্তরণে আমরা উদ্যোগী হই। অবশেষে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের সহযোগিতায় এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সদয় নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘ ৩৪ বছর পর ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর শাখা-প্রশাখাসহ ১১টি অচল খাল, বর্জ্যে জমাটবদ্ধ দুটি বক্স কালভার্ট ও প্রায় ২০০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের নলিকা নর্দমার মালিকানা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নিকট হস্তান্তর করা হয়। হস্তান্তরের পরদিন হতেই আমরা এ সকল খাল, বক্স কালভার্ট ও নর্দমা হতে বর্জ্য অপসারণ ও দখলমুক্তি কার্যক্রম শুরু করি। ২০২১ ও ২০২২ সালে এসব খাল, বক্স কালভার্ট ও নর্দমা হতে যথাক্রমে প্রায় আট লাখ ২২ হাজার ও পাঁচ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক বর্জ্য ও পলি অপসারণ করা হয়েছে। ২০২৩ সালে প্রকল্পভুক্ত চার খাল ও আদি বুড়িগঙ্গা চ্যানেল বাদে অন্যান্য খাল, বক্স কালভার্ট ও নর্দমা হতে এক লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন পলি ও বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে। ২০২৪ সালেও এই কার্যক্রম আরও বৃহৎ পরিসরে পরিচালিত হচ্ছে।'

তিনি বলেন, 'ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত এলাকার খালগুলোর মধ্যে শ্যামপুর, জিরানি, মান্ডা ও কালুনগর খাল অন্যতম। আমরা সেসব খাল পুনরুদ্ধার ও নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টির উদ্যোগ গ্রহণ করি এবং ২০২২ সালের ১১ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একনেকে এই চার খালের প্রকল্প অনুমোদন দেন। ৮৯৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ব্যয়ে "খাল পুনরুদ্ধার ও নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টি" নামক এই প্রকল্প ২০২৬ সালের জুনের মধ্যেই বাস্তবায়ন করা হবে।'

মেয়র বলেন, 'ইতোমধ্যে প্রকল্পের আওতায় চারটি খাল হতেই বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এ ছাড়াও, প্রকল্পের আওতায় ভূমি উন্নয়ন, বাইসাইকেল লেন ও অ্যাপ্রোচ রোড নির্মাণ, দৃষ্টিনন্দন এলইডি বাতি স্থাপন, জনগণের চলাচলের সুবিধার্থে ওয়াকওয়ে নির্মাণ, বসার বেঞ্চ স্থাপন, এম্পিথিয়েটার ও নর্দমা অবকাঠামো নির্মাণ, ব্যায়াম করার সেড স্থাপন, আর. সি. সি. রিটেইনিং ওয়াল ও ঢাল সুরক্ষা নির্মাণ, দৃষ্টিনন্দন সুরক্ষা বেষ্টনী ও গণশৌচাগার নির্মাণ ইত্যাদি অনুষঙ্গ রয়েছে। এ ছাড়াও, খালের দুই পাড় ঘেঁষে বৃক্ষরোপণ ও ল্যান্ডস্কেপিং করার মাধ্যমে খাল ঘিরে নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টি করা হবে।' 

তিনি বলেন, 'কামরাঙ্গীরচরের মুসলিমবাগ থেকে রায়েরবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত বুড়িগঙ্গা আদি চ্যানেলের প্রায় পুরোটাই ভূমিদস্যুদের কব্জায় চলে গিয়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অভিপ্রায় অনুযায়ী আমরা আদি বুড়িগঙ্গা চ্যানেল পুনরুদ্ধার ও নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টিতে বলিষ্ঠ উদ্যোগ গ্রহণ করি। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে আজ অবধি আদি বুড়িগঙ্গা চ্যানেল হতে নিজস্ব অর্থায়নে চার লাখ ৫০ হাজার টন বর্জ্য, পলি ও উন্নয়ন কাজের উচ্ছিষ্টাংশ অপসারণ করা হয়েছে। সম্পন্ন হয়েছে চ্যানেলের সীমানা পিলার স্থাপন কার্যক্রম। চ্যানেল ঘিরে উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য ইতোমধ্যে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মহাপরিকল্পনা চূড়ান্ত হলে ডিপিপি প্রণয়ন সম্পন্ন করা হবে।'

তাপস বলেন, 'জলজট ও জলাবদ্ধতা এই শহরের পুঞ্জিভূত সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম। সামান্য বৃষ্টিতেই তলিয়ে যেত এই শহরের প্রায় ৭০ শতাংশ এলাকা। এই সমস্যা নিরসনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন খাল, বক্স কালভার্ট ও নর্দমা হতে বাৎসরিক সূচি অনুযায়ী বর্জ্য ও পলি অপসারণ করে চলেছে। এ ছাড়াও, জলাবদ্ধতাপ্রবণ মোট ১৬১টি স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে এবং ২৫২ কোটি টাকা ব্যয়ে নিজস্ব অর্থায়নে ১০৯টি স্থানে জলাবদ্ধতা নিরসনে অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন করা হয়েছে। ২৬টি স্থানে অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন কাজ চলমান রয়েছে এবং বাকী ২৬টি স্থানে অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে শ্যামপুর বাণিজ্যিক এলাকা, মিডফোর্ড রোড, নটরডেম কলেজের সামনের সড়ক, বঙ্গভবনের দক্ষিণ ও পশ্চিম অংশের রাস্তা, বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে সড়ক, বাংলাদেশ সচিবালয়, লালবাগ রোড, আজিমপুর মোড়সহ অনেক এলাকায় জলাবদ্ধতা ও জলজট সমস্যার সমাধান হয়েছে। ফলে জলাবদ্ধতা সমস্যা ৭০ শতাংশ হতে ১০ শতাংশে নেমে এসেছে।' 

তিনি বলেন, 'সরকারের অন্যান্য সংস্থার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন চলমান থাকায় বর্তমানে কমলাপুর ও গ্রিন রোড এলাকার মতো সুনির্দিষ্ট কয়েকটি স্থানে এবং নিউমার্কেট এলাকা (বিজিবি কর্তৃক পানি নিষ্কাশন নর্দমা বন্ধ করে দেওয়ায়), পুরান ঢাকা এবং শহরের গুটিকয়েক এলাকা ছাড়া অন্য কোথাও জলাবদ্ধতা হয় না। সেসব এলাকায় জলাবদ্ধতা নিরসনে আমরা উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। অচিরেই সেসব স্থানেও জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান হবে।'

মেয়র বলেন, 'একসময় ঢাকা শহরের অলিগলি হতে শুরু করে মূল সড়ক পর্যন্ত সর্বত্রই যত্রতত্র উপচে পড়া বর্জ্যে সয়লাব ছিল। কিন্তু গত চার বছরে আমরা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে আমূল পরিবর্তন সাধন করেছি। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম আধুনিকায়নে অন্তর্বর্তীকালীন বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্র অন্যতম একটি অনুষঙ্গ। কিন্তু গত ৫০ বছরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকায় মাত্র ২৪টি অন্তর্বর্তীকালীন বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছিল। গত চার বছরে আমরা নতুন ৪১টি অন্তর্বর্তীকালীন বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্র নির্মাণ করেছি। বাকী ওয়ার্ডগুলোতেও অন্তর্বর্তীকালীন বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্র নির্মাণে আমাদের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।'

'এ ছাড়াও, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম আধুনিকায়নে গত চার বছরে আমরা নতুন ২৫টি ডাম্প ট্রাক ক্রয়, প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রাথমিক বর্জ্য সংগ্রহকারী নিবন্ধন (পিসিএসপি), পুরাতন পাঁচটি অঞ্চলে চিকিৎসা বর্জ্য সংগ্রহকারী নিবন্ধন করেছি। নতুন পাঁচটি অঞ্চলে চিকিৎসা বর্জ্য সংগ্রহকারী নিবন্ধন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সর্বোপরি সূচি অনুযায়ী নিয়মিতভাবে বিভিন্ন সড়ক, অলিগলি এসভিও দেওয়া ও রাতের মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্র হতে মাতুয়াইল কেন্দ্রীয় ভাগাড়ে বর্জ্য স্থানান্তর নিশ্চিত করা হয়েছে। পাশাপাশি নতুন ১৫টি ডাম্প ট্রাক ও ১০টি পে-লোডার ক্রয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ফলে সামষ্টিকভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে আধুনিকায়ন নিশ্চিত হয়েছে। এতে শহরের সৌন্দর্য যেমন বেড়েছে তেমনি নগরবাসীকে এখন আর যত্রতত্র উপচে পড়া বর্জ্যের উৎকট গন্ধে পথ চলতে হয় না।' 

Comments