বান্দরবানে ‘যৌথ অভিযানের নামে বম জাতিসত্তার ওপর নিপীড়নে’ ৪৩ নাগরিকের নিন্দা
সম্প্রতি বান্দরবানে দুটি ব্যাংকের তিনটি শাখায় ডাকাতির ঘটনার জেরে 'যৌথ অভিযানের নামে বম জাতিসত্তার ওপর নিপীড়ন, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের আটকে'র তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন দেশের ৪৩ নাগরিক।
আজ মঙ্গলবার যৌথ বিবৃতিতে তারা বলেন, 'আমরা অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে গত ২ ও ৩ এপ্রিল বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সশস্ত্র দুর্বৃত্ত কর্তৃক সংগঠিত ব্যাংক ডাকাতি ঘটনার জের ধরে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনী যৌথ অভিযানের নামে বম জাতিসত্তার ওপর নিপীড়নমূলক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছে।'
'আমরা সন্ত্রাস দমনের নামে নির্বিচারে সাধারণ নাগরিকদের আটক, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের আটক করার ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই।'
'আমরা সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে চাই যে একজন কেএনএফ সদস্যের অপরাধের জন্য তার স্ত্রী-সন্তানকে গ্রেপ্তার করা বা অপরাধীর গ্রামের সবাইকে দিনব্যাপী রোদের মধ্যে বসিয়ে অভুক্ত রাখা নির্যাতন এবং গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন।'
'৮ এপ্রিল নতুন বছরের উৎসব ও ঈদের ছুটিতে নিজ গ্রামে আসার পথে তিনজন বম শিক্ষার্থীকে নিরাপত্তা চৌকি থেকে ব্যাংক ডাকাতি ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার "সন্দেহে" আটক করা হয়। একইদিনে যৌথবাহিনী রুমা উপজেলার বেথেল পাড়া গ্রামের সাধারণ বম গ্রামবাসীদের কমিউনিটি সেন্টার প্রাঙ্গণে জড়ো হওয়ার নির্দেশ দেয় এবং উপস্থিত সবার মুঠোফোন কেড়ে নেয়।'
'এদিন বম জনগোষ্ঠীর সর্বমোট ৫৪ জন নারী-পুরুষ গণগ্রেপ্তারের শিকার হন। গ্রেপ্তারকৃত নারীদের সঙ্গে তাদের শিশু সন্তানদেরও আটক করা হয়। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে আমরা জানতে পারি যে একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীকেও প্রাথমিকভাবে আটক করা হয়েছিল, পরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।'
'১১ এপ্রিল যৌথবাহিনীর সদস্যরা ইডেন পাড়ার নারী, পুরুষ, বয়োবৃদ্ধ—সব বম গ্রামবাসীদের খোলা প্রাঙ্গণে জড়ো করে প্রখর রোদে পানি ও খাবার ছাড়া পাঁচ ঘণ্টার অধিক সময় বসিয়ে রেখে শারীরিক ও মানসিকভাবে হয়রানি করে।'
'২১ এপ্রিল একই অভিযানে কেএনএফের সদস্যদের আটক করতে না পেরে পরিবারের নারী-শিশুকে গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটেছে। এদিন রুমা উপজেলা সদর বাজারসংলগ্ন গির্জাপাড়া থেকে দুই নারীসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা হলেন—লাল চয় সাং বমের স্ত্রী লাল এং কল বম (২৬), সুশান্ত ত্রিপুরার স্ত্রী লাল রুয়াত ফেল বম (২০)। একইসঙ্গে তাদের চার সন্তানকেও আটক করা হয়।'
'এই পরিপ্রেক্ষিতে গ্রামবাসীদের রিমান্ডে নিয়ে তাদের কাছ থেকে ব্যাংক ডাকাতি ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার বিষয়ে জোরপূর্বক মিথ্যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়ার আশঙ্কাও অমূলক নয়।'
'বিগত প্রায় ৪ সপ্তাহে (এপ্রিল ৩-২৬) প্রতিদিন বান্দরবানের বিভিন্ন নিরাপত্তা চৌকিতে বম যাত্রীদের হেনস্তা করা হচ্ছে। স্থানীয় একাধিক সূত্র থেকে আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে, স্থানীয়দের কাজে যাতায়াতের সময় পরিচয়পত্র দেখাতে হচ্ছে এবং তারা নানা জেরার মুখোমুখি হচ্ছেন। এ ছাড়া, বান্দরবানের দুই উপজেলায় পাঁচ কেজির বেশি চাল বহনের ওপর নিরাপত্তা বাহিনীর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কারণে বমসহ ওই এলাকার অন্যান্য অধিবাসী, যাদের পক্ষে দীর্ঘ পথ যাতায়াত করে প্রতিদিনের খোরাক সংগ্রহ করা সম্ভব নয়, তারা খাদ্য সংকটে পড়েছেন।'
'এ ছাড়া, অভিযোগ আছে যে বিগত ১৬ তারিখ রাঙ্গামাটি থেকে আটজন নিরীহ ত্রিপুরা গ্রামবাসীকে অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ আটক দেখিয়ে কেএনএফ সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে সংবাদমাধ্যমে প্রচার করা হয়। যদিও এর পরের দিন তাদের মুক্তি দেওয়া হয়। নির্বিচারে আটকের শিকার হওয়ার আতঙ্কে বমসহ অন্যান্য জনগোষ্ঠীর অনেকের দৈনন্দিন জীবিকা নির্বাহ এখন কঠিন হয়ে পড়েছে।'
'কেএনএফ "সন্ত্রাসী" তৎপরতা দমনের নামে যৌথবাহিনীর এই অভিযানকে চিটাগাং হিল ট্রাক্টস কমিশন এবং গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল ইতোমধ্যে কালেকটিভ পানিশমেন্ট বা কতিপয়ের অপরাধে পুরো বম জনগোষ্ঠীকে শাস্তি দেওয়ার ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেছেন।'
'আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে পার্বত্য চট্টগ্রামে ধারাবাহিকভাবে যৌথ অভিযান চলাকালে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উত্থাপিত হলেও এসব অভিযোগ কখনোই তদন্ত করে দেখা হয় না, বরং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সরবরাহকৃত তথ্যকেই সত্য হিসেবে গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়।'
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, 'আমরা মনে করি, জনগণের টাকায় প্রতিপালিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রম জনগণের কাছে জবাবদিহির ঊর্ধ্বে থাকতে পারে না।'
'এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই, বম জনগোষ্ঠী, সর্বোপরি পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের জনজীবনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যাবে না।'
যৌথ বিবৃতিতে তারা তিনটি দাবি তুলে ধরেছেন। সেগুলো হলো—
১। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য তদন্তের মাধ্যমে ব্যাংক ডাকাতি ঘটনার সঙ্গে কেএনএফসহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতদের শনাক্ত করে তাদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে আইনের আওতায় আনতে হবে।
২। অবিলম্বে বম জনগোষ্ঠীকে কালেকটিভ পানিশমেন্ট প্রদানের কৌশলকে প্রত্যাহার করতে হবে এবং নির্বিচারে আটককৃত বম বাসিন্দাদের মুক্তি দিতে হবে।
৩। যৌথবাহিনীর অভিযানকালে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে আনীত সব মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে এবং যেসব আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য বম জনগোষ্ঠীর ওপর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করেছে, তাদেরকে বিচারের আওতায় আনতে হবে।
বিবৃতিদাতারা হলেন:
১. অধ্যাপক বাঞ্চিতা চাকমা, প্রাক্তন সদস্য, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন
২. নিরুপা দেওয়ান, প্রাক্তন সদস্য, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন
৩. মেঘনা গুহঠাকুরতা, নির্বাহী পরিচালক, রিসার্চ ইনিশিয়েটিভস, বাংলাদেশ; প্রাক্তন সদস্য, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন
৪. গীতি আরা নাসরীন, শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
৫. গৌতম দেওয়ান, সভাপতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটি এবং প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান, স্থানীয় সরকার পরিষদ
৬. অধ্যাপক মংসানু চৌধুরী, শিক্ষাবিদ
৭. শহিদুল আলম, আলোকচিত্রী
৮. ইলিরা দেওয়ান, মানবাধিকার কর্মী
৯. সাঈদ ফেরদৌস, শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
১০. কাজলী সেহরীন ইসলাম, শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১১. তানজীম উদ্দিন খান, শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১২. কবিতা চাকমা, স্থপতি, গবেষক ও লেখক
১৩. মুক্তাশ্রী চাকমা, মানবাধিকার কর্মী এবং গবেষক
১৪. মাহা মির্জা, খণ্ডকালীন শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
১৫. বীথি ঘোষ, সঙ্গীত শিল্পী, সমগীত
১৬. মাহমুদুল সুমন, শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
১৭. সামিনা লুৎফা, শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১৮. অরূপ রাহী, লেখক ও সঙ্গীতশিল্পী
১৯. অমল আকাশ, সঙ্গীত শিল্পী, সমগীত
২০. মোশাহিদ সুলতানা, শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
২১. পাভেল পার্থ, লেখক ও গবেষক
২২. ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান, সংগীত শিল্পী
২৩. ওমর তারেক চৌধুরী, লেখক ও অনুবাদক
২৪. শ্যামলী শীল, সভাপতি, নারী সংহতি
২৫. মঈন জালাল চৌধুরী, শিক্ষক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
২৬. নাজনীন শিফা, গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী
২৭. জান্নাতুল মাওয়া, আলোকচিত্রী
২৮. মারজিয়া প্রভা, অ্যাকটিভিস্ট
২৯. ইকবাল কবীর, রাজনৈতিক কর্মী এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী
৩০. নাসরিন সিরাজ, নৃবিজ্ঞানী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা
৩১. সায়েমা খাতুন, লেখক ও গবেষক
৩২. নাসরিন খন্দকার, নৃবিজ্ঞানী ও গবেষক
৩৩. রোজিনা বেগম, মানবাধিকার কর্মী ও উচ্চ শিক্ষার্থী, মাহিডল বিশ্ববিদ্যালয়, থাইল্যান্ড
৩৪. মাইদুল ইসলাম, পিএইচডি গবেষক, পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
৩৫. হানা শামস আহমেদ, পিএইচডি গবেষক, ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা
৩৬. দিলশান পারুল, রাজনৈতিক সংগঠক
৩৭. ওলিউর সান, শিক্ষক, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ
৩৮. দিলীপ রায়, সাধারণ সম্পাদক, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী
৩৯. ফেরদৌস আরা রুমী, কবি ও অধিকারকর্মী
৪০. মোশফেক আরা শিমুল, নির্বাহী পরিচালক, স্পেস-এ ফাউন্ডেশন ফর পিস অ্যান্ড কেয়ার
৪১. আব্দুল্লাহ আল নোমান, মানবাধিকার কর্মী এবং আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
৪২. রানী য়েন য়েন, মানবাধিকার কর্মী এবং উপদেষ্টা, চাকমা সার্কেল
৪৩. সায়দিয়া গুলরুখ, সাংবাদিক ও গবেষক
Comments