‘ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষা আইনের খসড়ায় মানবাধিকার ক্ষুণ্নের ঝুঁকি আছে’

সংবিধান স্বীকৃত ব্যক্তির গোপনীয়তা ও বাকস্বাধীনতার মৌলিক ধারণানির্ভর একটি 'অধিকারভিত্তিক' মৌলিক নীতির আলোকে এবং পুনরায় সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের মতামত নিয়ে ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষা আইনের খসড়াটি ঢেলে সাজানো জরুরি বলে মনে করছে আর্টিকেল নাইনটিন ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

'খসড়া ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষা আইন, ২০২৪: পর্যালোচনা ও সুপারিশ' শীর্ষক শিরোনামে আয়োজিত যৌথ সংবাদ সম্মেলনে 'ব্যক্তিগত উপাত্তের' সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞায়ন, দেশের সীমানায় উপাত্ত মজুতকরণের বাধ্যবাধকতা রহিতকরণ, উপাত্তের সুরক্ষা নিশ্চিতে একটি স্বাধীন 'উপাত্ত সুরক্ষা কমিশন' গঠন, ব্যক্তিগত উপাত্তে কর্তৃপক্ষের প্রবেশগম্যতায় বিচারিক তদারকি নিশ্চিত করা, বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে অবারিতভাবে ব্যক্তিগত উপাত্ত সংগ্রহের বিধান বাতিল এবং আইনটি কার্যকর করার বাস্তবসম্মত সময় নির্ধারণের বিষয়গুলো পুনর্বিবেচনা করার জোর দাবি জানিয়েছে সংস্থা দুইটি।

আজ রোববার টিআইবির ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী ব্যবস্থাপনা বিভাগের উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, আর্টিকেল নাইনটিনের আঞ্চলিক পরিচালক (বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়া) শেখ মনজুর-ই-আলম ও টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। সংবাদ সম্মেলনে সংস্থা দুইটির পক্ষ থেকে খসড়া ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষা আইনের ওপর পর্যালোচনা ও সুপারিশ তুলে ধরেন শেখ মনজুর-ই-আলম।

টিআইবি থেকে দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি জানানো হয়।

এতে বলা হয়, পর্যালোচনায় সংস্থা দুইটি খসড়া আইনটির বিভিন্ন পর্যায়ে নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন সব প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সম্পৃক্ত করা এবং তাদের সুপারিশের আলোকে বেশ কিছু ধারায় সংযোজন ও বিয়োজনের জন্য সরকারকে সাধুবাদ জানায়। তবে এ জাতীয় সংযোজন ও বিয়োজন নিছক একটি সংখ্যার খেলায় পর্যবসিত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। কারণ যেই বিষয়গুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ছিল এবং জোরালোভাবে মতামত উত্থাপন করেছিল, তার প্রায় প্রতিটিই উপেক্ষিত হয়েছে।

উপস্থাপনায় বলা হয়, সংবিধানে আমাদের গোপনীয়তার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে এবং মত প্রকাশের অধিকারকে অবিচ্ছেদ্য অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সুতরাং আমাদের প্রথম দাবি যে, আইনটির প্রস্তাবনায় যেন এটা উল্লেখ করে দেওয়া হয়—সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দিতেই এই আইনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। উদ্বেগের বিষয়গুলো যদি প্রস্তাবনায় উল্লেখ থাকে, সেক্ষেত্রে আইনের মূল ধারাতেও তার প্রতিফলন ঘটবে।

বর্তমান খসড়ায় ব্যক্তির সংজ্ঞায় 'আইনগত ব্যক্তি' অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানকেও সম্পৃক্ত করার কারণে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টির সুযোগ রয়েছে। পরবর্তী সংজ্ঞায় 'ব্যক্তিগত উপাত্তের' সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তা যথেষ্ট সুনির্দিষ্ট হওয়ার কারণে, এই ভুল বোঝাবুঝি আরও প্রকট আকার ধারণ করবে এবং এর অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাবে। এক্ষেত্রে আমাদের পরামর্শ—ইউরোপীয় ইউনিয়নের জিডিপিআরে যে ধরনের সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা সম্বলিত 'ব্যক্তিগত' উপাত্তের সংজ্ঞা আছে, সে রকম একটি ব্যাখ্যা আমাদের এই খসড়ায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি আলোচ্য আইনের ক্ষেত্রে ব্যক্তি সংজ্ঞার কোনো প্রয়োজনীয়তা না থাকায়, সেই সংজ্ঞাটি বাদ দেওয়া যৌক্তিক হবে। একইভাবে উপাত্ত জিম্মাদার ও প্রক্রিয়াকারীর যে সংজ্ঞা এবং কর্মপরিধি উল্লেখ করা হয়েছে, সেই বিষয়েও আমরা একটি সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়ার জোর দাবি জানাই।

আইনটির পূর্বের খসড়ায় সব ধরনের উপাত্ত স্থানীয়ভাবে মজুতের কথা বলা হয়েছিল, সেখান থেকে সরকার সরে এসে এখন যেকোনো শ্রেণিকৃত ব্যক্তিগত উপাত্তের কথা বলছে। কিন্তু এখানেও সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে, অর্থাৎ সরকার ইচ্ছা ও মর্জি অনুযায়ী যেকোনো ব্যক্তিগত উপাত্তকে প্রয়োজন অনুযায়ী 'শ্রেণিকৃত উপাত্ত' হিসেবে ঘোষণা করতে পারবে। অধিকন্তু অবকাঠামোগত দুর্বলতাসহ স্থানীয় পর্যায়ে সব উপাত্ত মজুত করা হলে নিরাপত্তা ঝুঁকি রয়েছে। অন্যদিকে সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বৈশ্বিক মানদণ্ড অনুযায়ী উপাত্ত সংরক্ষণ ও মজুতের নীতি মেনে চলতে হবে। সেক্ষেত্রে অধিকাংশ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনায় বাধার সম্মুখীন হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, উপাত্ত স্থানীয়করণের মাধ্যমে সাংবিধানিক অধিকারের লঙ্ঘন হতে পারে, কেননা স্থানীয় সার্ভারে সরকারের বিভিন্ন এজেন্সি কোনো রকম বাধা ছাড়াই অনুপ্রবেশ করতে পারবে এবং জনগণের ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না।

সর্বোপরি ব্যক্তি উপাত্তের সুরক্ষা নিশ্চিতে সেই শুরু থেকেই সরকারের প্রভাব বলয়ের বাইরে একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ 'উপাত্ত সুরক্ষা কমিশন' গঠনের জোর দাবি জানানো হলেও আলোচ্য খসড়ায় 'বাংলাদেশ উপাত্ত সুরক্ষা বোর্ড' গঠনের কথা বলা হয়েছে, যা মূলত একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। যেই প্রতিষ্ঠান সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, সেই প্রতিষ্ঠান কোনোভাবেই সরকার ঠিকভাবে আইন মেনে তথ্যের সুরক্ষা দিচ্ছে কি না, সেটা নিশ্চিত করতে পারবে না। এটা অবাস্তব, এই ধারাটি পরিবর্তন করতে হবে। সরকারের অধীনে একটি বোর্ড না করে একটি স্বাধীন 'উপাত্ত সুরক্ষা কমিশন' গঠনের জোর দাবি জানাচ্ছি।

অন্যদিকে সরকারের অধীনস্ত সংস্থাকে জাতীয় নিরাপত্তা ও জনগণের স্বার্থরক্ষার নামে ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করার এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে এটি একটি ব্যত্যয় বা এক্সেপশান। বিচারবিভাগীয় তদারকি ছাড়া সরকারি সংস্থাকে ডেটা সার্ভারে বাধাহীন অনুপ্রবেশের সুযোগ দিলে, তা অপব্যবহার হওয়ার যথেষ্ট ঝুঁকি আছে এবং দিন শেষে এই ব্যতিক্রম চর্চাকেই আইনের মূল ধারা হিসেবে বিবেচনা করা হতে পারে। নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থা হিসেবে আমাদের জন্য এটা মেনে নেওয়া কঠিন। পাশাপাশি আইনটি পর্যায়ক্রমে প্রতিষ্ঠানভেদে কার্যকর করতে হবে। শুরুর দিকে অতিগুরুত্বপূর্ণ নাগরিক উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে আইনটি বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের প্রতিষ্ঠানে ধাপে ধাপে এর প্রয়োগ নিশ্চিত করার সুপারিশ করছি।

টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'মোটামুটি প্রশংসনীয় অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ায় যে খসড়াটি মন্ত্রিপরিষদে অনুমোদিত হয়েছে, তাতে টিআইবি ও অন্যান্য অংশীজনের বেশ কিছু পরামর্শ ইতিবাচকভাবে বিবেচিত হয়েছে। ফলে খসড়া ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইন ২০২৪ আগের তুলনায় ভালো একটি অবস্থানে এসেছে। তবে সাধারণ জনগণের জন্য সবচেয়ে উদ্বেগের ক্ষেত্রগুলো এখনো রয়েই গেছে, যে কারণে আইনটিকে ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষার নামে নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার সমূহ ঝুঁকি রয়েছে।'

ড. জামান মনে করেন, 'আইনের মূল চেতনায় ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা-সংক্রান্ত সাংবিধানিক অঙ্গীকার ও বাকস্বাধীনতা নিশ্চিতের বিষয় প্রতিফলিত হয়নি। ব্যক্তি ও ব্যক্তিগত তথ্যের সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞায়নের অনুপস্থিতির কারণে অপব্যাখ্যার মাধ্যমে সরকারের হাতে এর অপপ্রয়োগের ঝুঁকি রয়েছে। ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন রাখার যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তা এ আইনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্র। প্রতিষ্ঠানটি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে স্বাধীন কমিশন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত না হলে, এ আইনের বাস্তবায়ন স্বার্থের দ্বন্দ্বে দুষ্ট হয়ে এর মূল উদ্দেশ্য ধূলিসাৎ হওয়ার ব্যাপক ঝুঁকি থাকবে। তা ছাড়া জাতীয় নিরাপত্তা ও জনস্বার্থের নামে সরকারি প্রতিষ্ঠানকে যে ব্যাপক অভিগম্যতা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে, সেক্ষেত্রে বিচারিক নজরদারির নিশ্চয়তা না থাকলে এ আইন ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষার পরিবর্তে নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারিকে আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক স্বাভাবিকতা প্রদান করবে।'

আর্টিকেল নাইনটিনের আঞ্চলিক পরিচালক (বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়া) শেখ মনজুর-ই-আলম বলেন, 'আইনটিকে যুগোপযোগী করার পাশাপাশি এটি যাতে কোনোভাবেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অনুরূপ নিবর্তনমূল না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। একইসঙ্গে আমাদের জীবন এখন ডিজিটাল হয়ে গেছে। আমাদের সরকার এখন ডিজিটাইজেশন করার ওপর প্রচণ্ড গুরুত্ব দিচ্ছেন। সুতরাং আমাদের এই ডিজিটাল যে জীবন, সেখানে আমাদের মতপ্রকাশের যে স্বাধীনতা ও গোপনীয়তার যে সুরক্ষা, আমাদের সংবিধান যেভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে, তার সুরক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে আইনটি ঢেলে সাজাবার আহ্বান জানাচ্ছি।'

Comments