তাপদাহ সহ্য করতে পারছে না সড়কের নিম্নমানের বিটুমিন
চলমান তীব্র তাপদাহে দেশের অনেক জেলায় সড়কের উপরিভাগে বিটুমিন গলে যেতে দেখা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়কে যে বিটুমিন ব্যবহার করা হয়েছে সেটি এই তীব্র গরম সহ্য করার উপযোগী নয়।
তাদের অভিযোগ, নিম্নমানের সামগ্রী ও নিম্নমানের নির্মাণ কাজই এমন ক্ষতির কারণ।
গবেষণার ভিত্তিতে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে সমস্যা আরও গুরুতর আকার ধারণ করবে বলে মনে করেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হাদিউজ্জামান।
এই মাসে রেকর্ড ২৫ দিনের বেশি তাপপ্রবাহ চলছে এবং দেশের কোথাও কোথাও তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তারও বেশি ছিল।
জলবায়ু বিষয়ক গবেষকদের মতে, গত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশে চরম তাপমাত্রার ঘটনার পুনরাবৃত্তি এবং স্থায়িত্ব দেখা যাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান এই প্রবণতা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকতে পারে।
সম্প্রতি যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও শরীয়তপুরের বেশ কিছু স্থানে সড়ক-মহাসড়কের উপরিভাগ গলে গেছে, যা সড়ক নিরাপত্তার জন্য হুমকি।
অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সড়কে ৬০/৭০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করা হয়েছে যা ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশেপাশের তাপমাত্রায় নরম হতে শুরু করে। সড়ক ও জনপথ বিভাগের তিন জন প্রকৌশলী এই মতের সাথে একমত এবং আরেকজনের মতে এসব বিটুমিন আসলে আরও অনেক কম তাপেই নরম হয়ে যায়।
সড়কের উপরিভাগের তাপমাত্রা আশেপাশের পরিবেশের চেয়ে ১৫-২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি থাকে কারণ বিটুমিন কালো হওয়ার কারণে তা অনেক বেশি তাপ শোষণ করে এবং গাড়ির চাকার সাথে ক্রমাগত ঘর্ষণের কারণেও তাপ উৎপন্ন হয়।
অধ্যাপক হাদিউজ্জামানের মতে, ক্রমাগত তাপের কারণে সড়কের বিটুমিনের স্থিতিস্থাপকতা হ্রাস পায় এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে, এটি স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম তাপমাত্রায় গলতে শুরু করে।
অধ্যাপক হাদিউজ্জামানের মতোই, সড়কে ব্যবহৃত বিটুমিনের মান নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ।
যোগাযোগ করা হলে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মঈনুল হাসান জানান, সড়ক ঠিক করার জন্য অনেক সময় সড়কে সাময়িকভাবে বিটুমিনের পাতলা স্তর ব্যবহার করা হয়, সেটাই সম্ভবত সমস্যার সৃষ্টি করছে।
'জলবায়ু পরিবর্তনের কিছু প্রভাব তো আছেই তবে আমরা নিশ্চিত নই যে এখানে জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপক কোনো প্রভাব আছে কিনা, আমরা সেটি খতিয়ে দেখছি', বলেন তিনি।
প্রস্তুতির অভাব
এআরআ'র সাবেক পরিচালক অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ প্রস্তুত নয়।
উচ্চ গলনাঙ্কের বিটুমিন ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, 'প্রস্তুতি থাকলে তারা পারফরম্যান্স-ভিত্তিক বিটুমিন বেছে নিত'।
প্রয়োজনীয় গবেষণা না করায় রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা আরও বাড়তে পারে।
পারফরম্যান্সভিত্তিক বিটুমিন ৬০/৭০ গ্রেডের বিটুমিনের চেয়ে ব্যয়বহুল হলেও এটি দিয়ে নির্মিত সড়কের জীবনকাল বেশি ফলে সেদিক থেকে খরচ কমে যায়।
কম রক্ষণাবেক্ষণ খরচ হওয়ায় সড়কে কংক্রিটও ব্যবহার করা যেতে পারে।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী জানিয়েছেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক মেরামত ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক প্রশস্ত করতে পলিমারের মডিফাইড বিটুমিন ব্যবহার শুরু হয়েছে।
পলিমার-মডিফাইড বিটুমিনের দাম ৬০/৭০ গ্রেড বিটুমিনের চেয়ে ১৫-২০ শতাংশ বেশি।
অধ্যাপক হাদিউজ্জামান মনে করেন পলিমার-মডিফাইড বিটুমিন সম্পর্কে নির্মাণ শ্রমিকদের যথাযথ জ্ঞান থাকা জরুরি এবং এটি পরীক্ষা করার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে যথাযথ ব্যবস্থাও থাকা দরকার।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের আওতায় ২২ হাজার ৪৭৬ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ২০২২-২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এর মধ্যে ৩ হাজার ৯৯১ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক, ৪ হাজার ৮৯৭ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং ১৩ হাজার ৫৫৮ কিলোমিটার জেলা সড়ক।
Comments