‘পুষ্পপাগল’ কৃষ্ণচূড়ার আগুনঝরা দিন

সেই এপ্রিলের শুরু থেকে দেশজুড়ে টানা তাপপ্রবাহের ভেতর দিনের বেলায় এমনিতেই আকাশ থেকে আগুনের গুঁড়ো ঝরে পড়ার বোধ হচ্ছে।
দূরভেদী কৃষ্ণচূড়ার আগুনে রূপের কাছে ম্লান হয়ে গেছে সব রঙ।। ছবি: পলাশ খান/স্টার

সেই এপ্রিলের শুরু থেকে দেশজুড়ে টানা তাপপ্রবাহের ভেতর দিনের বেলায় এমনিতেই আকাশ থেকে আগুনের গুঁড়ো ঝরে পড়ার বোধ হচ্ছে। তীব্র রোদ আর প্রচণ্ড গরমে হাঁসফাঁস করতে থাকা মানুষ একটু স্বস্তি পেতে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করছেন। এর ভেতরেই আমূল বদলে যাওয়া মোগল সুবাদার ইসলাম খানের চার শ বছরের এই প্রাচীন নগরের ভাঁজে ভাঁজে খানিকটা হলেও পেলবতার ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছে 'পুষ্পপাগল' কৃষ্ণচূড়া।

অনেকের কাছে গ্রীষ্ম হচ্ছে পুষ্প উৎসবের ঋতু; যে উৎসবে রাজপথের দুই ধারে শামিল মনোহর জারুল, স্বর্ণাভ সোনালু, গোলাপি মধুমঞ্জরী, নীলাভ জ্যাকারান্ডা ও হলদে-সাদা কাঠগোলাপের মতো মনোহর সব ফুল। কিন্তু দূরভেদী কৃষ্ণচূড়ার আগুনে রূপের কাছে ম্লান হয়ে গেছে সব রঙ।

খররোদের তপ্ত দিনে প্রায় দুই কোটি মানুষের এই ব্যতিব্যস্ত মহানগরে এখন কৃষ্ণচূড়ার রাজত্ব। এই পুষ্পবৃক্ষের ঘন সবুজ পত্রপুঞ্জের ভেতর থেকে বের হয়ে আসা উজ্জ্বল গুচ্ছের ওপর প্রখর রোদের দীপ্তি যে বিপুল বর্ণবৈভব সৃষ্টি করে, তা যেন চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দেয়। তখন ইট-পাথরের এই রুক্ষ নগরকে খানিকটা হলেও মনে হয় অন্যরকম।

ঢাকা শহরে এখন কৃষ্ণচূড়ার সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন জাতীয় সংসদ ভবনের ক্রিসেন্ট লেক সংলগ্ন সড়কটি। ছবি: পলাশ খান/স্টার

কৃষ্ণচূড়ার প্রধান বৈশিষ্ট্য এর অফুরন্ত প্রস্ফুটনের ক্ষমতা। এ কারণেই বোধকরি নিসর্গসখা দ্বিজেন শর্মা এর নাম দিয়েছিলেন 'পুষ্পপাগল'। শহরকে পুষ্পশোভিত করে তুলতে এই বৃক্ষের ভূমিকা অনন্য।

ঢাকার পার্কে–পথে আগুনঝরা এই ফুল দিয়ে নগরবাসীর আহ্লাদের সীমা নেই। ছুটির দিন কিংবা একটু অবসরে অনেকে ছুটে যাচ্ছেন এই ফুল দেখতে। তাদের ফেসবুকের দেয়াল ভরে উঠছে গাছতলা ছেয়ে থাকা ঝরা ফুল আর কচি সবুজ পাতার ঐশ্বর্যে।

ঢাকা শহরে কৃষ্ণচূড়ার সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন জাতীয় সংসদ ভবনের ক্রিসেন্ট লেক সংলগ্ন সড়ক। এছাড়া বিজয় সরণি, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, আগারগাঁওয়ের বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের চারপাশ, রমনা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, বেইলি রোড, হাতিরঝিল, কাকরাইল ও বিমানবন্দর সড়কে কৃষ্ণচূড়ার লাবণ্যময় সারির দেখা মেলে।

কৃষ্ণচূড়ার প্রধান বৈশিষ্ট্য এর অফুরন্ত প্রস্ফুটনের ক্ষমতা। ছাতার মতো মেলে থাকা ফুলগুলো মনে হয় একেকটি পুষ্পস্তবক। ছবি: পলাশ খান/স্টার

এ ফুলের আরেক জগত জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান। ন্যাশনাল বোটানিক্যাল গার্ডেন নামে পরিচিত মিরপুরের এ উদ্যানের ভেতরের গাছগুলোতে প্রতি বছর প্রচুর কৃষ্ণচূড়া ফোটে। সেইসঙ্গে ঢাকার ওয়ারী এলাকার বলধা গার্ডেন, পুরানো ঢাকার বাহাদুরশাহ পার্কেও ফোটে এই ফুল।

মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের কাছে রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধের সামনেও ফুটন্ত কৃষ্ণচূড়া দেখা মেলে। আর হলুদ কৃষ্ণচূড়া দেখা যায় হেয়ার রোড ও ফুলার রোডে ব্রিটিশ কাউন্সিলের ভেতরে।

পাশাপাশি বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন পথের পাশে, দপ্তর প্রাঙ্গণে বা কোনো পুরোনো বাড়ির উঠানের কোণ থেকেও কৃষ্ণচূড়ার রক্তিম উদ্ভাস ব্যস্ত পথিকের দৃষ্টি ছুঁয়ে যায়। তাতে স্নিগ্ধতার স্পর্শ পায় মন।

গাছের নিচেও কৃষ্ণচূড়ার আগুনে রঙ শোভা পায়। ছবি: পলাশ খান/স্টার

কৃষ্ণচূড়ার ফুল উজ্জ্বল লাল ও হলুদ বর্ণের। পাপড়িগুলো প্রায় আট সেন্টিমিটারের মতো লম্বা হতে পারে। কৃষ্ণচূড়ার পাতা সবুজ। প্রতিটি পাতা ৩০ থেকে ৫০ সেন্টিমিটার লম্বা ও ২০ থেকে ৪০টি উপপত্রবিশিষ্ট। এর বৈজ্ঞানিক নাম ডেলোনিক্স রেজিয়া (Delonix regia), যা ফ্যাবেসি (Fabaceae) পরিবারের অন্তর্গত। ইংরেজিতে এটি পরিচিত ফ্লেম ট্রি (Flame Tree) হিসেবে।

বৃক্ষসখা দ্বিজেন শর্মা জানাচ্ছেন, আফ্রিকার মাদাগাস্কার থেকে উনিশ শতকের প্রথম দিকে এই গাছ প্রথমে ইউরোপ, তারপর উপমহাদেশে আসে। সে হিসেবে বাংলা মুলুকে কৃষ্ণচূড়ার আবির্ভাবের বয়স তিন শ বছরের মতো।

আবার কৃষ্ণচূড়া কখন যেন আমাদের চেতনার অনুষঙ্গেও জড়িয়ে গেছে। কবি শামসুর রাহমান কৃষ্ণচূড়াকে দেখেছিলেন ভাষা শহীদের 'ঝলকিত রক্তের বুদ্বুদ' হিসেবে। লিখেছিলেন সেই অমর পঙ্ক্তি—'আবার ফুটেছে দ্যাখো কৃষ্ণচূড়া থরে থরে শহরের পথে/ কেমন নিবিড় হ'য়ে। কখনো মিছিলে কখনো-বা/ একা হেঁটে যেতে যেতে মনে হয়-ফুল নয়, ওরা/ শহীদের ঝলকিত রক্তের বুদ্বুদ, স্মৃতিগন্ধে ভরপুর।/একুশের কৃষ্ণচূড়া আমাদের চেতনারই রঙ।'

কৃষ্ণচূড়া কখন যেন আমাদের চেতনার অনুষঙ্গেও জড়িয়ে গেছে। ছবি: পলাশ খান/স্টার

রবীন্দ্রনাথের গানে পাওয়া যায়, 'গন্ধে উদাস হাওয়ার মতো উড়ে তোমার উত্তরী/কর্ণে তোমার কৃষ্ণচূড়ার মঞ্জরী।'

গাছের নিচেও কৃষ্ণচূড়ার আগুনে রঙ শোভা পায়। ঝরা ফুলের এই সৌন্দর্য দেখার আসল সময় ভোরবেলা।

কৃষ্ণচূড়ার আরেক নাম গুলমোহর। উপমহাদেশের প্রখ্যাত শিল্পী 'মেলোডি কিং' মোহাম্মদ রফির গানেও এসেছে এই ফুলের কথকতা। রফি গেয়েছিলেন, 'গুলমোহরের ফুল ঝরে যায়, বনে বনে শাখায় শাখায়/ কেন যায় কেন যায়/ বাহারের মন ভেঙে যায়...'।

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh bank reform plan 2025

Inside the 3-year plan to fix banks

Bangladesh has committed to a sweeping overhaul of its troubled financial sector, outlining a detailed three-year roadmap as part of its latest agreement with the International Monetary Fund.

10h ago