পিছিয়ে পড়া খেয়াং নারীদের পথ দেখাচ্ছে ‘গুংগুরু পাড়া উপজাতীয় মহিলা উন্নয়ন সংস্থা’

‘যে নারীরা এখানে সম্পৃক্ত হয়েছেন, তারা তাদের আয় থেকে পরিবারের সদস্যদের ভরণপোষণ করেন, কেউ কেউ ছোট ভাই-বোনদের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে যাচ্ছেন।’
সমিতির অফিস ঘরে কাজ করেন খেয়াং নারীরা। ছবি: মংসিং হাই মারমা/স্টার

বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি—দুই জেলায় বসবাসরত খেয়াং সম্প্রদায় সব দিক থেকেই সেখানকার অন্যান্য জনগোষ্ঠীর তুলনায় অনেক পিছিয়ে। তাদের মধ্যে নারীদের অবস্থা আরও শোচনীয়। পিছিয়ে পড়া এই নারীদের আত্মনির্ভরশীল করতে কাজ করে যাচ্ছে 'গুংগুরু পাড়া উপজাতীয় মহিলা উন্নয়ন সংস্থা' নামের একটি স্থানীয় সমিতি।

বান্দরবান জেলা শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে গুংগুরু খেয়াং পাড়ায় তিন শতাধিক খেয়াং পরিবার থাকে। এই গ্রামেই 'গুংগুরু পাড়া উপজাতীয় মহিলা উন্নয়ন সংস্থা'র অবস্থান। এই পাড়ার বেশ কয়েকজন শিক্ষিত ও সচেতন নারীর উদ্যোগে ১৯৯৯ সালে যাত্রা শুরু করে এই সমিতি।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, পাড়ার সবচেয়ে উঁচু একটি টিলার ওপর এই সংস্থার অফিস ঘর। টিনের বেড়ার ঘরটির ভেতরে চলছে নানা ধরনের কাজ। সেখানে কেউ সুতা মাড় করে রোদে শুকাতে দিচ্ছেন, কেউ তাঁত বুনছেন, কেউ মোম তৈরি করছেন। সব মিলিয়ে বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে এই সমিতির ঘরে।

কথা হয় তাঁতশ্রমিক আপুমে খেয়াংয়ের (২৪) সঙ্গে। তিনি জানান, নতুন কাজ শুরু করেছেন। এখনো সচ্ছলতা না আসলেও আগের চেয়ে ভালো আছেন।

ছবি: মংসিং হাই মারমা/স্টার

তাঁতশ্রমিক খ্যইসিং নু খেয়াংয়ের (২৪) বাবা চার বছর আগে মারা যান। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। বাবা মারা যাওয়ার পর মায়ের সঙ্গে সংসারের হাল টেনে নিয়ে যাচ্ছেন তিনিও।

আরেক তাঁতশ্রমিক অংক্রাচিং খেয়াংয়ের (২১) মা-বাবা আর তিন ভাইবোন মিলে সুখের সংসার ছিল। বাবা হঠাৎ অসুস্থ হওয়ায় ২০২১ সালে এসএসসি পাস করার পরও আর লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। গত বছর বাবা মারা যাওয়ার পর পরিবারের আর্থিক অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। ছোট বোন একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে, ছোট ভাই পড়ছে নবম শ্রেণিতে। এক বছর ধরে এখানে কাজ করে যা আয় হয়, তা দিয়ে মা ও ভাইবোনদের সহায়তা করছেন কিছুটা।

পাশেই তাঁত বুনতে থাকা বিজিম খেয়াং এখানে কাজ করছেন প্রায় তিন বছর ধরে। প্রতিদিন তিন-পাঁচ ঘণ্টা কাজ করেন। সিনিয়র হিসেবে কখনো আট হাজার, কখনো নয় হাজার টাকা পর্যন্ত পারিশ্রমিক হিসেবে এই সংস্থা থেকে পান বলে জানান।

থুইজো খেয়াংয়ের (৩০) পরিবারে ছয় জন সদস্য। অর্থের অভাবে নতুন ঘর করতে পারছিলেন না। সমিতি থেকে এক লাখ টাকা ব্যয়ে নতুন ঘর করে দেওয়া হয়েছে। তাতে খুব খুশি বলে জানান তিনি।

সংস্থার সদস্যরা জানান, বর্তমানে সদস্য সংখ্যা নিয়মিত ও অনিয়মিত মিলে মোট ৮০ জন। এ বছর থেকে সদস্য সংখ্যা আরও বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। খেয়াং সম্প্রদায়ের নারীরা ভোটার আইডি কার্ড ও ছবি দিয়ে সদস্য হতে পারেন।

ছবি: মংসিং হাই মারমা/স্টার

গুংগুরু পাড়া উপজাতীয় মহিলা উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি উম্রাচিং খেয়াং বলেন, 'প্রত্যেক সদস্যের সঞ্চয় ১০০ টাকা ও বিবিধ খরচ ২০ টাকা। সংস্থার সদস্যদের কৃষিকাজে পাঁচ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ছয় মাস মেয়াদি ঋণ দেওয়া হয়। উচ্চশিক্ষা লাভের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়। সমিতির সদস্যরা সমিতিতে কাজ করে স্বল্পসুদে ঋণ পরিশোধের সুযোগ পাচ্ছেন।'

তিনি আরও বলেন, 'সমিতির সদস্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত নারীদের সমিতির পক্ষ থেকে সুদমুক্ত টাকায় গরু দেওয়া হয়েছে। পরে গরু বিক্রি করে মূল টাকা সমিতিতে পরিশোধ করে বাকি লভ্যাংশ টাকা ভোগ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। যেসব সদস্য ঘর তৈরি করতে পারছেন না, সমিতি তাদের নতুন ঘর করে দিয়েছে। এ পর্যন্ত ১৫ জন সদস্যকে নতুন ঘর নির্মাণ করে দেওয়াসহ ২১ জনের ভাঙা ঘর মেরামত করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।'

গুংগুরু পাড়া উপজাতীয় মহিলা উন্নয়ন সংস্থার সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে সংস্থাটির উপদেষ্টা হ্লা ক্রই প্রু খেয়াং বলেন, 'সংস্থাটিতে বর্তমানে ১২ জন নারী শ্রমিক নিয়মিত কর্মরত আছেন। ১৫ জন সদস্যকে নতুন ঘর করে দেওয়া হয়েছে। এখানে যারা কাজ করেন অধিকাংশই দরিদ্র, অসহায়, এতিম। তাদের কর্মসংস্থানে সংযুক্ত করা হয়েছে, যাতে তারা আত্মনির্ভরশীল হতে পারেন।'

ছবি: মংসিং হাই মারমা/স্টার

'যে নারীরা এখানে সম্পৃক্ত হয়েছেন, তারা তাদের আয় থেকে পরিবারের সদস্যদের ভরণপোষণ করেন, কেউ কেউ ছোট ভাই-বোনদের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের জনগোষ্ঠীর নিজস্ব পোশাক ছিল না আগে। এখন খেয়াং নারীরা আমাদের তাঁতে উৎপাদিত পোশাক পরছেন', যোগ করেন শিক্ষক হ্লা ক্রই প্রু খেয়াং।

বান্দরবান মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আতিয়া চৌধুরী বলেন, 'বান্দরবানে যে ১১টি নৃগোষ্ঠীর নারীরা অনেক পিছিয়ে, তাদের মধ্যে খেয়াং জনগোষ্ঠী অন্যতম। গুংগুরু পাড়া উপজাতীয় মহিলা উন্নয়ন সংস্থা খেয়াং নারীদের উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অসাধারণ অবদান রেখে চলেছে। তারা অত্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে সংস্থার সব কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন।'

'পিছিয়ে পড়া নারীদের অগ্রযাত্রায় অবদান রাখায় মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর গুংগুরু পাড়া উপজাতীয় মহিলা উন্নয়ন সংস্থাকে প্রতি বছর বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে আসছে এবং ভবিষ্যতেও করে যাবে', যোগ করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Yunus congratulates Nihon Hidankyo on winning Nobel Peace Prize

'Your advocacy and tireless efforts to ensure that the horrors of Hiroshima and Nagasaki are never forgotten resonate deeply in our quest for a safer world,' said the CA

47m ago