রাজস্ব আদায় নিয়ে নেতিবাচক ধারণার জন্য দায়ী কবি-সাহিত্যিকরা: এনবিআর চেয়ারম্যান

বৃহস্পতিবার রাজশাহীতে ‘উন্নয়নের জন্য রাজস্ব’ বিষয়ক সভায় এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। ছবি: সংগৃহীত

রাজস্ব আদায় নিয়ে নেতিবাচক ধারণার জন্য দায়ী কবি-সাহিত্যিকদের দায়ী করেছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম।

বৃহস্পতিবার রাজশাহীতে সার্কিট হাউস সম্মেলন কক্ষে 'উন্নয়নের জন্য রাজস্ব' বিষয়ক এক সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এমন মন্তব্য করেন।

রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীরের সভাপতিত্বে এ সভায় সরকারি কর্মকর্তা, সাংবাদিক ও ব্যবসায়ী নেতারা উপস্থিত ছিলেন। 

সভায় এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, '২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হতে চাইলে রাজস্ব আদায়ের হার ও কর দ্রুত বাড়াতে হবে। ১৯৭২-৭৩ সালে আমাদের আয়কর দায়ের হার ছিল শতকরা মাত্র ১০ ভাগ। বাকি ৯০ ভাগ রাজস্ব আসত কাস্টমস থেকে। কাস্টমস থেকে রাজস্বের হার ১৯৯১-১৯৯২ সালে ৫৪ শতাংশে নেমে আসে, ভ্যাট থেকে ২৫ শতাংশ ও আয়কর থেকে ২১ শতাংশ।'

তিনি বলেন, '২০১১-১২ সালে কাস্টমস থেকে রাজস্ব আদায় ৪০ শতাংশ, ভ্যাট থেকে ৩০ শতাংশ এবং ইনকাম ট্যাক্স থেকে ২৭ শতাংশ আদায় হয়েছে। ২০২১-২২ এ কাস্টমসের আদায় এসে দাঁড়িয়েছে ২৯ শতাংশ, আয়করের ৩৪ শতাংশ এবং ৩৭ শতাংশ ভ্যাট।'

'দেখা যাচ্ছে কাস্টমস থেকে রাজস্ব আয় ধীরে ধীরে কমছে এবং ইনকাম ট্যাক্স এবং ভ্যাট বাড়ছে,' বলেন তিনি।

এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, '১৯৭২-৭৩ এ আমাদের আর্থিক অবস্থা ছিল কৃষিনির্ভর। তখন কোনো ইন্ডাস্ট্রি ছিল না। ধীরে ধীরে ইন্ডাস্ট্রি বেড়েছে, জিডিপি গ্রোথ বেড়েছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে। মানুষের আয় বেড়েছে মানে কর দেওয়ার সক্ষমতা বাড়ছে, দেশের উন্নতি হচ্ছে।'

জাতীয় রাজস্ব বাজেট ২০০৮ সাল থেকে ২০২২-২৩ পর্যন্ত ৭ গুণ বেড়েছে, কিন্তু রাজস্ব আদায়ের হার গত ১০ বছরে ৪ গুণ বেড়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, 'আমরা যেহেতু খুব দ্রুত উন্নত দেশে পরিণত হতে চাই, কাজেই এই রাজস্ব আদায়ের হার যথেষ্ট নয়। আমাদের এটা আরও বাড়াতে হবে।'

এনবিআর চেয়ারম্যান রাজস্ব দিতে জনগণের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ ব্যাখ্যা করে বলেন, 'সরকার ক্ষুদ্র, মাঝারি ও ভারি শিল্পে এবং উদ্যোক্তা তৈরিতে সহায়তা করবে। পাশাপাশি "বাংলাদেশে তৈরি" ধারণার বিকাশ করা হবে।'
 
'বাজারে যখন যাই দেখা যাই, সব পণ্য মেড ইন চায়না, মেড ইন মালয়শিয়া, মেড ইন থাইল্যান্ড, মেড ইন ইন্দোনেশিয়া। আমাদের মার্কেটকে পুঁজি করে অন্য দেশ তাদের জিডিপি উন্নত করছে। এটা হতে দেওয়া যায় না। আমাদের বাজারে শুধু আমাদের পণ্য থাকবে,' বলেন তিনি। 

এনবিআর চেয়ারম্যান আরও বলেন, '২০২০ সালে নেওয়া মেড ইন বাংলাদেশ কনসেপ্ট হলো, আমরা চাই যে মধ্যবিত্তের ব্যবহার্য পণ্যগুলো বাংলাদেশে তৈরি করা হোক। মেড ইন বাংলাদেশ কনসেপ্টের ফলে স্মার্টফোন, টেলিভিশন, এসি, মোটরসাইকেল শতকরা ৯৫ ভাগ পণ্য এখন বাংলাদেশ মেড ইন বাংলাদেশ।'

আমাদের ভারি ও নতুন শিল্প দরকার উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আমরা উন্নত দেশ হব, কিন্তু অ্যালুমিনিয়ামের পাতিল, বালতি, প্লাস্টিকের বদনা বানাব আর বাইরের মানুষের কাপড় সেলাই করব, এই দিয়ে তো উন্নত দেশ হতে পারব না। উন্নত দেশ হতে হলে ভারি শিল্প তৈরিতে ঝুঁকতে হবে। ভারি শিল্প কঠিন কিছু না, যেটা আমাদের দেশের মানুষ পারবে না।'

তিনি বলেন, 'সামন্ত রাজাদের আমল থেকে রাজস্ব সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারণার প্রচলন আছে। সামন্ত রাজারা রাজস্ব আদায় করত, তখন থেকেই একটা নেতিবাচক ধারণা চলে আসছে। এর জন্য অনেকটা দায়ী আমাদের লেখক, কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকাররা। কারণ তারা প্রতিবারই দেখিয়েছেন যে সামন্ত রাজারা জোর করে কর আদায় করে। যে কারণে আমাদের মাথার মধ্যে ঢুকে গেছে যে রাজস্ব দেওয়া মানেই রাজার অত্যাচার, রাজার জুলুম।'

'কিন্তু কখনো আমাদের মাথায় চিন্তা আসেনি যে, কর দিয়ে রাজা কী করে। সিনেমায় দেখা যায়, রাজা কর আদায় করে চকচকে পোশাক পড়ে, মদ খায়, বাইজির নাচ দেখে। কিন্তু এটা কেউ দেখে না, রাজ্য রক্ষা কে করে, বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রাজ্য রক্ষা কে করে, ভেতরের চোর-ডাকাত থেকে প্রজাদের রক্ষা করে কে, রাস্তাঘাট কে বানায়, পুকুর খনন কে করে, পানির ব্যবস্থা কে করে। এই কাজগুলো রাজাকে করতে হয়। এটা ব্যক্তি করতে পারে না। এর জন্য রাজার অর্থ দরকার হয়,' বলেন তিনি।

এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, 'সামন্ত রাজাদের সময়ে রাজার দায়িত্ব ছিল রাজ্য রক্ষা করা ও প্রজাদের রক্ষা করা। তাদের অর্থের উৎস ছিল ভূমিকর এবং বাণিজ্য কর। আধুনিক রাষ্ট্রের চিন্তা হলো, ওই দুটি ছাড়াও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা, প্রজাদের আয় বৃদ্ধি করা এবং সবার আর্থিক উন্নয়ন ঘটিয়ে দেশের উন্নয়ন করা এবং দেশকে পৃথিবীর মধ্যে সমৃদ্ধশালী দেশে পরিণত করা। এখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব যেমন বেশি, তেমনি, রাজস্ব বাড়ানোর দায়িত্বও বেশি।'

 

Comments

The Daily Star  | English

Yunus meets Chinese ambassador to review China visit, outline next steps

Both sides expressed a shared commitment to transforming discussions into actionable projects across a range of sectors

5h ago